প্রমদারঞ্জন রায়ের লেখা "বনের খবর" আর বাকি দশটা শিকার কাহিনীর মতো নয়। তার প্রধান কারণ লেখক কোনো প্রফেশনাল বা শখের শিকারী নন। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ভূমি জরিপের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। এ ছুঁতোয়া ঘুরেছেন সুদূর বেলুচিস্তানের ধু ধু বিরান প্রান্তর থেকে মায়ানমারের শান স্টেটের আজন্ম অন্ধকার বনভূমি। গিয়েছেন মানুষখেকো বাঘের আড্ডাখানা খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড়, ঘুরেছেন জোঁকের লীলাভূমি আসামের কাছাড়, ত্রিপুরায়।
'বনের খবর' বাংলা সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রচিত এক অসামান্য স্মৃতিকথা। প্রমদারঞ্জন রায়ের সার্ভেয়ার জীবনে ১৮৯৯ থেকে ১৯২০ সালের বন-অরণ্যে ও মরুভূমি-প্রায় অঞ্চলে জরিপকালীন সময়ের রোমাঞ্চকর সব অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে এ বইয়ে।
তাঁর ব্যাপক বিস্তৃত অদ্ভুত এডভেঞ্চারের উদাহরণ দেয়ার জন্য কয়েকটি লেখা উল্লেখ না করে পারছিনা।
.
রক্তখেকো জোঁক নিয়ে তাঁর গা শিউরে উঠা বর্ণনা -
"....জোঁক যদি দেখতে চাও কাছাড়ের বনে একবারটি যাও। অনেক দেশে, অনেক জায়গায় ঘুরেছি, এমন জোঁক আর কোথাও দেখিনি৷ সে জোঁকই বা কত রকমের, কত রঙ বেরঙের। ছোট বড় মাঝারি। এক একটা দু ইঞ্চি আড়াই ইঞ্চি লম্বাও আছে৷ সে যখন রক্ত খেয়ে পটলের মত মোটা হয়, তখন তাকে দেখলে ভয়ে প্রাণ উড়ে যায়...."
কিংবা বুনোশুয়োর নিয়ে তাঁর সতর্কবাণী-
"....আমাদের দেশে বলে - বাঘ শিকারীর ভাত রেঁধো। শুয়োর শিকারীর রেঁধোনা৷ সে যে ফিরে আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।"
"....বুনো কুকুর বড় নিষ্ঠুর জানোয়ার। সকলের আগে ওই জীবন্ত হরিণটার চোখ দুটো কামড়ে নিয়েছিলো। বেচারা অন্ধ হয়ে আর গুঁতোতেও পারেনি, পালাতেও পারেনি, কাজেই তারা সুবিধা পেয়ে তার পিছন থেকে মাংস ছিঁড়ে খেতে আরম্ভ করেছিলো। এমনি করে প্রায় দু তিন সের মাংস খেয়ে ফেলেছিলো।"
.
প্রমদারঞ্জন রায়ের ভ্রমণকাহিনীতে আছে মায়ানমারের শান স্টেটের নাম, আছে থাইল্যান্ডের নিকটবর্তী কেংটুং রাজ্য, আছে আসামের ডিমাপুর, নাগা হিলস, খাসিয়া পাহাড়, জৈন্তিয়া পাহাড়, আছে ত্রিপুরার গহিন অরণ্য। আবার বনহীন বেলুচিস্তানের ধূসর প্রান্তর - সেখানকার অসহনীয় শীত আর গরমের কথাও আছে। যেখানে সোয়েটারের ওপর তিন তিনটা কম্বল চাপিয়েও শীত মানেনা। তাপমাত্রা উঠানামা করে ১৭° থেকে ১১৭° ফারেনহাইট। ঠান্ডায় জল জমে বরফ হয়ে আসে।
.
পাঠানদের নির্মমতা, তাদের গোষ্ঠী দ্বন্ধ, কথায় কথায় গুলি চালানোর গল্প এসেছে। এসেছে কিভাবে প্রমদারঞ্জন ভাগ্যের জোরে দুই দুইবার ডাকাতের হাত থেকে বেঁচে ফিরেছেন সেই অভিজ্ঞতাও।
.
শান, মুসো, মিকির, নাগা কত ধরণের জাতির সাথে যে মোলাকাত হয়েছে প্রমদারঞ্জনের, লেখাজোকা নেই...
এই বইয়ে এগারো ফুট অজগর হা করে তেড়ে আসে, মানুষখেকো বাঘ চুপিসারে ঝাঁপিয়ে পড়ে হতভাগা খালাসির ওপর, বুনো হাতির দল তাঁবুর ওপর হামলে পড়ে সব ভেঙেচুরে রেখে যায়, বুনো কুকুরের দল জ্যান্ত ছিড়ে খায় শিকারকে, গগনবেড়ের মাংসের গন্ধে আত্নারাম খাঁচাছাড়া হয়, সন্তানহারা হনুমান কেঁদে কেঁদে ফিরে, পা থেকে দা দিয়ে জোঁক সরাতে সরাতে জেরবার হয়ে যায় সকলে।
.
বইটির মূল আকর্ষণ বাঘ। বারবার এসেছে বাঘের কথা। আসাম থেকে ত্রিপুরা হয়ে মিয়ানমার - পুরোটা যেন গিজগিজ করছে বাঘে। কতবার যে বাঘের মুখ থেকে ফিরে এসেছেন প্রমদারঞ্জন ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা। একবার বাঘ তাঁবুতে উঁকি মারে তো একবার নড়বড়ে পুল পেরিয়ে এগিয়ে আসে, একবার গাছতলায় পাহারা দেয় উপরে বসে কাঁপতে থাকা খালাসীদের তো একবার কাঠের মত ঘাঁটি গেড়ে অপেক্ষায় থাকে কবে আগুন নিভবে আর কবে আটকে থাকা মানুষগুলোর ঘাড় মটকাবে।
বিশেষ করে জৈন্তিয়া পাহাড়ে হাবিলদার সিংবীর থাপার পরিত্যক্ত গ্রামে টানা আটচল্লিশ ঘন্টা মানুষখেকোর মোকাবেলা করা আর প্রমদারঞ্জন রায়ের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে পেছনের পাথরের চাঁইয়ে থাকা বাঘের অস্তিত্ব টের পাওয়া - এই দুই কাহিনী পড়লে যেন গায়ে কাঁটা দেয়।
.
এছাড়া বইটিতে আছে অজস্র ছোটবড় অভিজ্ঞতা। কম ডিসকাশন হয় এমন প্রাণী যেমন হনুমান, শূকর, ময়ুর, বার্কিং ডিয়ার, বনকুকুর, ভাল্লুক, গন্ডার এরা বারবার এসেছে তাঁর লেখায়। শুধু বাঘ নিয়ে পড়ে থাকেননি।
.
বইটি একটি জীবন্ত ইতিহাসের দলিল। কি বিস্তৃত বনভূমি ছিল ভারতবর্ষের উত্তর পূর্ব জুড়ে - বইটি পড়লে তা সহজেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এমন ঘোর জঙ্গল ছিল ত্রিপুরা ও মিজোরামে যে, দিনের বেলায়ও সন্ধ্যা নেমে থাকত অরণ্যে। আজ সে বনভূমি আছে কিনা জানা নেই। হয়ত মানুষের লোভে হারিয়ে গেছে।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....