পথের পাঁচালি | লেখক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়

বই পথের পাঁচালি
লেখক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়


মূল চরিত্রঃ অপু, দূর্গা, হরিহর রায়, সর্বজয়া, পিসি ইন্দির ঠাকরুণ, মিঠাইওয়ালা...... প্রমুখ।

❝মেয়েটি করুণ চোখে বলিল, তা হোক পিতি, তুই খা- দুটো পাকা বড় বীচে-কলার একটা হইতে আধখানা ভাঙ্গিয়া ইন্দির ঠাকরুণ তাহার হাতে দিল। এবার খুকীর চোখ-মুখ উজ্জ্বল দেখাইল- সে পিসিমার হাত হইতে উপহার লইয়া মনোযোগের সহিত ধীরে ধীরে চুষিতে লাগিল। ও ঘর হইতে তাহার মা ডাকিল, আবার ওখানে গিয়ে ধন্না দিয়ে বসে আছে? উঠে আয় ইদিকে! ইন্দির ঠাকরুণ বলিল, থাক বৌ- আমার কাছে বসে আছে, ও কিছু করচে না। থাক বসে-।❞

❝চিরায়ত বাঙালি পরিবারের আপাদমস্তক দৃশ্য একটি, খোলা চোখে আবেগ দেখা না গেলেও সবকিছু যেন পরিপূর্ণ। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়- এর লেখা একটি বিখ্যাত সামাজিক বাস্তব উপন্যাস। এটি উপন্যাস হলেও পড়ার সময় একটিবারের জন্যও মনে হবে না যে, এটা উপন্যাস। বরং, লেখকের স্বচ্ছ -সাবলীল ভাষা আমাদের সমাজের বাস্তব ও জীবন্ত ছবির এক সহজ-স্বাভাবিক রূপ তুলে ধরা আছে এই উপন্যাসে। যখন একজন পরিচারিকা তার জীবনের শেষ দিনে চলে আসে, তখন তার সামাজিক পরিস্থিতি কেমন হয়? যখন কোন নারী অল্পবয়সে স্বামী হারা হয় এবং সমাজ তাকে আবার বিয়ে করবার অনুমতি না দেয়, তখন সেই নারীর সামাজিক অবস্থান কোথায় দাঁড়ায়? এই সব প্রশ্নের উত্তর অত্যান্ত নিখুঁতভাবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পথের পাঁচালী” উপন্যাসে। এই উপন্যাসের প্রথম অংশে, তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি বাল্যবিবাহ ও যৌতুককে দানবীয় আকার ধারণ করতে দেখা যায়। ইন্দির ঠাকুরনের বিয়ে অল্পবয়সে এমন এক লোকের সাথে লোকের সাথে দেয়া হয়, যে বেশি যৌতুকের লোভে অন্যত্র বিয়ে করে। এরপর, আর কখনও সে ফিরে আসে না। তখন আয়হীন ইন্দির ঠাকুরনের আবাসস্থল হয় তার পিতার বাড়িতে, এবং তাদের ও তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার দূরসম্পর্কের আত্মীয় হরিহরের বাড়িতে স্থান হয়। সেখানে প্রতিমুহূর্তে মনে করিয়ে দেওয়া হতো, সে একজন আশ্রিতা, করুণার পাত্রী ছাড়া আর কেউ নয়। সে প্রায়শ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত, কিন্তু দিন শেষে তার পথ এসে শেষ হত হরিহরের বাড়িতে। একবার ঘটনাক্রমে বাড়ি থেকে তাকে একেবারে বের করে দেয়া হয়! সমাজ জীবন! মনুষ্যত্বহীন পরিবার!! এই উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ ‘আম আঁটির ভেঁপু’- এ অত্যন্ত সুচারুভাবে হরিহরের সন্তানদ্বয়- বড়মেয়ে দূর্গা ও ছোট ছেলে অপুর টক-মিষ্টি সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত পাঠ প্রতিক্রিয়া বলতে গেলে অনেটা অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়বো। কারণ, বইটির প্রতিটি অংশের মাঝে মানবজীবনের উপখ্যানকে লেখক এক অনন্যরূপ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। এমনকি, উপন্যাসের শেষ অংশ ‘অক্রুর সংবাদে’ চিরাচরিত বাংলার বড়লোক-গরীবের বৈষম্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে। লেখক সাফল্যের সাথে দেখিয়েছেন, একজন ব্রাক্ষ্মণ নারীর (সর্বজয়া) কি অবস্থা হয়, যখন অর্থের জন্য তাকে কাজের লোকের কাজ করতে হয়। পরিবারের এক সদস্যের অকাল মৃত্যুর পর তারা গ্রাম ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। সেখানে এক পর্যায়ে জ্বরে অন্য এক সদস্য মারা গেলে তার চোখের অশ্রু মোছার জন্যও কেউ ছিল না। সবাই তার কষ্টের সুযোগ নিতে চায়, সাহায্যের হাত কেউ বাড়ায় না। অবশেষে, সে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তার নিজ গ্রাম নিশ্চিন্দি পুরের পথে রওনা হয়, কিন্তু, সে তার সঠিক পথ খুঁজে পায় না। বলা বাহুল্য যে, এই সামাজিক বৈষম্য আজকের একবিংশ শতাব্দিতে এই উন্নত সমাজেও পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত এই উপন্যাস আদি ও বর্তমান সামাজিক উত্থান-পতন ও সামাজিক কুসংষ্কারের প্রতিচ্ছবি। বইপ্রেমী, সাহিত্যপ্রমী এবং সমাজ প্রেমীদের এই অনবদ্য উপন্যাসটি পড়ার সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।❞

ছবি কালেকক্টেড

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ