দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান শিক্ষাবিদ, শিক্ষা প্রশাসক, ইসলামী চিন্তাবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আব্দুল বারী (রহি.) তাঁর মেধা, দক্ষতা এবং বলিষ্ঠ অবদানের মাধ্যমে এদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জ্ঞানের জগতকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। তিনি ছিলেন এদেশের একজন অসাধারণ প্রতিভাধারী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভিসি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নির্বাচিত ভিসিসহ তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
এই মনীষী ১৯৩০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বগুড়া জেলায় শিবগঞ্জ থানাধীন সৈয়দপুরগ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। সুশিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান মুহাম্মাদ আব্দুল বারীর পৈত্রিক নিবাস দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর থানার নুরুলহুদা গ্রামে।
তাঁর বাবা মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহিল বাকী (রহি.) ছিলেন উপমহাদেশের খ্যাতনামা একজন চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ ও ইসলামী পণ্ডিত। খিলাফত আন্দোলন ও বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গণপরিষদ সদস্যসহ নানা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ তিনি অলংকৃত করেন।
মুহাম্মাদ আব্দুল বারী-র পড়ালেখার হাতেখড়ি তাঁর ঐতিহ্যবাহী পরিবারেই হয়। ছোটকাল থেকেই অত্যন্ত মেধাবী আব্দুল বারী পারিবারিক ঐতিহ্যর সাথে সংগতি রেখে নিজ গ্রামের জুনিয়র মাদরাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। এরপর নওগাঁ কো-অপারেটিভ হাই মাদরাসায় ভর্তি হন। অতঃপর সেখান থেকেই ১৯৪৪ সালে সমগ্র বাংলায় প্রথম শ্রেণীতে একাদশ স্থান অধিকার করে হাই মাদরাসা (SSC) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ) হতে ১৯৪৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান করেন। এরপর ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগ হতে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বরসহ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে বিএ (অনার্স) ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৫০ সালে তিনি একই বিভাগ হতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। আরবির ছাত্র হয়ে ইংরেজিতে পারদর্শিতার জন্য তিনি তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তিনি ‘নীলকান্ত গোল্ড মেডেল’, ‘বাহরুল উলুম ওবায়দী সুহরাওয়ার্দী গোল্ড মেডেল’সহ নানা পুরস্কার ও বৃত্তিলাভ করেন। ১৯৫৩ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি বিশ্ববিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ফিলোসফি (ডি.ফিল) ডিগ্রী লাভ করেন। তাঁর গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ ঐতিহাসিক প্রফেসর এইচএআর গিব এবং প্রফেসর যোসেফ শাখত। আমেররিকার হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি কিছুকাল গবেষণা করেন। ১৯৬১ সালে তিনি ‘নাফিন্ড ফাউন্ডেশন ‘ ফেলোশিপ লাভ করে পূর্ব লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক্টোরাল রিসার্চ সম্পন্ন করেন।
প্রফেসর আব্দুল বারী (রহি.) কর্মজীবন ছিল অত্যন্ত বর্ণাঢ্য ও চিত্তাকর্ষক। অক্সফোর্ড থেকে দেশে ফিরে অতি তরুণ বয়সে ড. আব্দুল বারী ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তান শিক্ষা সার্ভিসে সরাসরি অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। প্রথমে তিনি ঢাকা কলেজ এবং পরবর্তীতে রাজশাহী কলেজের আরবি বিভাগে তিনি অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ‘রীডার’ পদে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে একই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও প্রফেসর হিসেবে দীর্ঘকাল দায়িত্বপালন করেন।
তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডীন, জিন্নাহ হলের প্রভোস্ট, সিন্ডিকেট সদস্যসহ প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে মাত্র ৪০ বছর বয়সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। উল্লেখ্য যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য হতে তিনিই সে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নির্বাচিত ভিসিও তিনি। দু’দুবার সেখানে ভিসির দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ পদে দু’মেয়াদে দীর্ঘ আট বছর তিনি সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।১৯৮৯ সালে তিনি অনুমোদনকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রজেক্টের উপদেষ্টা পদে নিয়োগলাভ করেন। এতে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর প্রায় একক প্রচেষ্টায় বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের ন্যায় এদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৯২ সালে তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন।
প্রফেসর আব্দুল বারী তাঁর বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফলতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে আপন যোগ্যতা ও বিরল দক্ষতার প্রমাণ রাখেন। শিক্ষক হিসেবে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘‘শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক’ (Pride of performance) নির্বাচিত হন এবং স্বর্ণপদক লাভ করেন। পেশাগত ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও আঞ্জাম দিয়েছেন। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইসলামী প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত দু’টি কমিটিরই চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে দায়িত্বপালন করেন। জাতীয় শিক্ষা সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান (২০০২), মাদরাসা শিক্ষা সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান (১৯৯০), ইসলামী বিশ্বকোষ প্রণয়ন সম্পাদনা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বহু গুরত্বপূর্ণ দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠিত অসংখ্য আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও কনফারেন্সে যোগদান করেন।
এ সমস্ত অবদানের পাশাপাশি তাঁর সাংগঠনিক ও ধর্মীয় প্রচার-প্রসারেও যথেষ্ঠ অবদান রয়েছে।
‘বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস’ নামক ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটি তাঁর সাংগঠনিক যোগ্যতা ও ধর্মীয় জ্ঞানের গভীরতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করছে। অত্যন্ত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ১৯৬০ সাল থেকে আমৃত্য এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব অতি নিষ্ঠা ও যোগ্যতার সাথে আঞ্জাম দিয়ে এদেশে ইসলামী দাওয়াতের প্রসারে ভূমিকা রাখেন। এ সংগঠনের মাধ্যমেই তিনি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেছেন হাজারও মাদরাসা, মসজিদ ও ইয়াতিমখানাসহ নানা জনকল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা।
তাঁর রচনা-শৈলি ছিল অতি উচ্চাঙ্গের। আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর বেশ কিছু গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও তাঁর রচিত কয়েকটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সুখী জীবনের অধিকারী প্রফেসর আব্দুল বারী ২ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। ২০০৩ সালের ৪ জুন এ মহান মনীষী ৭৩ বছর বয়সে ঢাকায় ইন্তিকাল করেন। পৈত্রিক নিবাস দিনাজপুরের নুরুল হুদায় পারিবারিক গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
প্রফেসর আব্দুল বারী আপন কর্মজীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সততার মূর্তপ্রতীক রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। নৈতিক শক্তির বলে তিনি যে ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলেছিলেন তা ছিল অত্যন্ত দৃঢ়, প্রত্যয়দীপ্ত ও আকর্ষণীয়। তাই তো তিনি কখনো ক্ষমতাসীনদের অন্যায় আবদারের কাছে নীতি বিসর্জন দিয়ে আপন স্বার্থ হাসিলের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি। সফলতা ও খ্যাতি আজীবন তাঁর পদচুম্বন করেছে। স্বীয় বিরল যোগ্যতার কারণে উচ্চমর্যাদা ও খ্যাতি জীবনের শেষপর্যন্ত তাঁকে আগলে রেখেছে। মৃত্যুর মাত্র কয়েকমাস আগে পর্যন্ত তিনি জাতীয় শিক্ষা সংস্কার সংক্রান্ত সরকারি বিশেষ কমিটির দায়িত্ব পালন করে অত্যন্ত সময়োপযোগী ও যুগান্তকারী সুপারিশমালা উপস্থাপন করে গেছেন।
ধর্মীয় মূল্যবোধে দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল ও সচেতন শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি এমন একটি পরিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট ছিলেন যেখানে চরিত্রবান ও আদর্শ মানুষ তৈরি হবে। মাতৃভাষার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ভাষায় প্রফেসর আব্দুল বারীর দখল ছিল। বিশেষ করে ইংরেজী ও আরবিতে তাঁর যোগ্যতা সকলকে মুগ্ধ করত। তাঁর বাগ্মীতার খ্যাতি সারাদেশময়। শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, সাধারণ শিক্ষিত, কিংবা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত প্রতিটি শ্রোতাই মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর বক্তব্য শ্রবণ করত। একজন প্রকৃত জ্ঞান সাধক হিসেবে আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার সাথে কুরআন ও সুন্নাহর চমৎকার সমন্বয় করে তিনি ব্যাখ্যা করতেন।
সহজ-সরল অথচ প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও দৃঢ় নৈতিক চরিত্রের অধিকারী প্রফেসর আব্দুল বারী ছিলেন একজন প্রগতিশীল চিন্তা ও মননের অধিকারী। ইসলাম যে অসাম্প্রদায়িক বিশ্বধর্ম এবং এ ধর্মের সাথে আধুনিকতার কোন বিরোধ নেই, এতে গোঁড়ামীর কোন স্থান নেই একথা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তাঁর প্রতিফলন নিজের জীবনে ঘটিয়েছেন। তিনি কোন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করেননি, সত্য কথা দৃঢ়ভাবে বলতেন, সেটা যাদের পক্ষেই যাক না কেন। তবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র ও ভন্ডামীর ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোষহীন। এ ব্যাপারে তাঁর অবস্থান সুস্পষ্ট করে গেছেন তিনি।
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের শীর্ষ স্থানীয় দায়িত্বশীল অসংখ্য পদ অলংকৃত করেও কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত পন্থায় তিনি জীবনযাপনে সচেষ্ট থেকে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। মুসলিম বিশজুড়ে তাঁর পরিচিতি ছিল অবাক করার মতো। তাঁর এ সকল বহুমুখী প্রতিভা আর অসামান্য অবদানের কথা জাতি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করবে চিরকাল।
লেখক : প্রফেসর ড. ইফতিখারুল আলম মাসউদ
আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং
নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর হেরিটেজ স্টাডিজ।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....