রাজকীয় উৎসর্গ লেখক : আল কাফি নয়ন | Rajokio Utshorgo

‘এটাই বইয়ের অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। কোন পা নাড়ানো ছাড়াই বই আপনাকে যে কোন জায়গা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।’

কি দারুণ সুন্দর সত্যি কথা, তাই না? আমি নই, বই নিয়ে দারুণ এই উক্তিটি করেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক ঝুম্পা লাহিড়ি।

  • বই : রাজকীয় উৎসর্গ 
  • লেখক : আল কাফি নয়ন
  • জনরা : হাই/এপিক ফ্যান্টাসি
  • প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০২২ 
  • প্রচ্ছদ : সজল চৌধুরী 
  • চিত্র অলংকরণ : ওয়াসিফ নূর
  • প্রকাশনা : ভূমিপ্রকাশ 
  • মুদ্রিত মূল্য : ৫০০ টাকা মাত্র
  • পৃষ্ঠা : ৩২০
এই কথা টানার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কিছুদিন আগে আমিও পা নাড়ানো ছাড়াই ঘুরে এসেছি এমন জায়গা থেকে যেখানে আসলে পা নাড়ালেও যাওয়ার সুযোগ হতো না। এমনি এক জায়গা সেটা, যেখানে টাকা খরচ করলেও আসলে ঘুরতে যাওয়া সম্ভব না।

বলছিলাম কিছুদিন আগে ভূমি প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হওয়া বই ‘রাজকীয় উৎসর্গ’ নিয়ে। বইপাড়ার সবাইই মনে হয় এই বইটি নিয়ে ইতোমধ্যে জেনে গিয়েছেন। যারা জানেননি, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, ‘রাজকীয় উৎসর্গ’ উপন্যাসটা হচ্ছে ফ্যান্টাসি উপন্যাস। আর ফ্যান্টাসি উপন্যাস বলেই আমি বলেছি, টাকা খরচ করলেও আসলে ‘রাজকীয় উৎসর্গ’ এর সেকেন্ডারি ওয়ার্ল্ড ‘ফিকটাস ওয়ার্ল্ডে’ ঘুরে আসা সম্ভব না। ‘ফিকটাস ওয়ার্ল্ড’ হচ্ছে এমন একটা জায়গা যেটা তৈরী হয় একজন মানুষের ভাবনা অনুযায়ী। মানে সে মনে মনে কোন একটা দেখা/অদেখা জায়গাকে যেমন করে তৈরী করতে চায় তেমনি একটা জায়গা তৈরী হয়ে যায় আর সেখান থেকে ঘুরে আসতে পারে লোকজন (অবশ্যই সাথে গাইড হিসেবে থাকে যে সেই ওয়ার্ল্ডটা তৈরী করেছে সে)। আর এই বিশেষ ওয়ার্ল্ড যারা তৈরী করতে পারে, তাদেরকে বলা হয় ‘ক্যান্তর’। রাজ্য ‘ডাবরি’তে বসবাস করা এই ক্যান্তরদের সাথে স্বশরীরে যাবার টিকেট মেলে ‘সোনার নালী’ রাজ্যের ধনীদের।

পোস্ট শুরু করার আগে (আসলে অলরেডী শুরু হয়ে গেছে) বলে নিই, আমি সাধারণত এত বড় রিভিউ লিখি না। তবে ফ্যান্টাসি ভালোবাসি বলে 'নতুন লেখকদের পিন্ডি চটকাবো' বলে এত বড় রিভিউ লিখতে হচ্ছে। তবে আপনার হাতে এত সময় না থাকলে, স্রেফ এড়িয়ে যান এবং একদম শেষে ফরম্যাটিং করা একটা প্যারাটা আছে, ওটা পড়ে নিন।

আমাদের আলোচ্য বইয়ের শুরুতেই ৩০ জন অভিযাত্রী নিয়ে দুই ক্যান্তর পাড়ি জমায় ফিকটাস ওয়ার্ল্ডে। হঠাৎ সেখানে একটা সমস্যা দেখা দেয়, যেটা আগে কখনো হয়নি আর সে সমস্যা সমাধানে অপারগ হয়ে পালিয়ে যায় ঐ দুই ক্যান্তর। এখান থেকেই গল্প শুরু। কি হয়েছিলো সেখানে? এটা জানার জন্য ডাবরি প্রধান দ্বিরেফ যেমন উদ্বিগ্ন তেমনি নিজ রাজ্যের উঁচুস্তরের মানুষের বিপদ নিয়ে চিন্তিত ‘সোনার নালি’র প্রধান আলফি পিলগ্রিম। তবে এনারা উদ্বিগ্ন হলেও মনে মনে খুশি হয় ‘ভাঙন’ রাজ্যের প্রধান জাভিয়ার। তার কাছে এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে মনে হয়। মনে মনে সে ভাবে, শুধুই ডাবরিই ক্যান্তর দিয়ে টাকা উপার্জন করে সমৃদ্ধশালী রাজ্যে পরিণত হবে, ওদিকে আর্থিক ভাবে হাঁটুভাঙা রাজ্য ‘ভাঙন’ আরো ভেঙ্গে পড়বে, এই দিন পাল্টাবার সময় এসে গেছে, প্রতিটা চাল চালতে হবে মাথা খাঁটিয়ে।

রাজনীতিতে একটা চালই নেতাকে শীর্ষে নিয়ে যাতে পারে আবার ঐ একটা চালই পারে তাকে ধুলিসাৎ করে দিতে। এই ব্যাপারটা যে দ্বিরেফ বোঝে না, তা নয়। কিন্তু সে বিপদের ঘ্রাণ পাচ্ছে, এতদিন ধরে যাদেরকে শুভাকাঙ্খী ভেবে এসেছে তাদের আচরণেও কেমন যেন একটা ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছে সে। ওদিকে পালিয়ে যাওয়া ক্যান্তরদের খুঁজে বের করতে রাস্তায় নেমেছে দ্বিরেফের ডানহাত সহকারী প্রধান ক্যান্তর, আলকানতারা। ঐ ক্যান্তরদের খুঁজে বের করার মাঝেই নির্ভর করছে, দ্বিরেফের রাজ্য শাসনের ক্ষমতা আর ডাবরির ভবিষ্যত। সুতরাং দাঁতে দাঁত চেপে ‘খের বাড়ি’র উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো আলকানতারা, রাজ্যের অপরাধীদের আড্ডাখানা ‘খের বাড়ি’তে কি সত্যি সে ক্যান্তর দুজন আত্মগোপন করেছে? আর যদি করেই থাকে তাহলে সে কি পারবে ওদের খুঁজে বার করতে? জাভিয়ার কি পারবে ভাঙনের সেই পুরনো জৌলুস ফিরিয়ে আনতে? এর জন্য কত রক্তে রঞ্জিত করতে হবে তার হাত? আলফি পিলগ্রিম কোন পক্ষ সমর্থন করবেন? ক্ষমতার পাল্লা কোন একদিকে ভারী করে দিলেই যে বিপদ আসতে পারে, সেটা কি সামাল দিতে পারবেন তিনি? ওদিকে রাজ্যের পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে সানভি নামে এক রহস্যময় নারী, যে খুঁজে বেড়াচ্ছে ফিলিক্স নামে এক বৃদ্ধ ক্যান্তরকে? এই উদ্দেশ্য এই রহস্যময়ী নারীর?

এইসব প্রশ্ন নিয়ে এগিয়ে গেছে ‘রাজকীয় উৎসর্গ’। তবে এর বাইরেও আরো হাজারটা জিনিস আছে। সেগুলো নাহয় পাঠক বই থেকেই পড়ে নেবেন। আমি বরং চলে যাই বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়ায়।

পাঠ প্রতিক্রিয়া : ফ্যান্টাসী বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়া দিতে গেলে আমি পাঠ-প্রতিক্রিয়াকে দুভাগে ভাগ করে নিই। এক ভাগে বলি, বইটা ফ্যান্টাসি হিসেবে কতটুকু ভালো লেগেছে আর আরেকভাবে বলি সাধারণ ভাবে চিন্তা করলে উপন্যাসটি কেমন হয়েছে। তো কথা না বাড়িয়ে বলি ফ্যান্টাসি হিসেবে ‘রাজকীয় উৎসর্গ’ কেমন লেগেছে আমার কাছে।

ফ্যান্টাসি উপন্যাস হিসেবে একটা বই কতটুকু স্বার্থক সেটাকে একজন পাঠকের আসন থেকে বিচার করতে বসলে, মূলত কয়েকটা বিষয় অবশ্যম্ভাবী হিসেবে চলে আসে। এগুলো হলো, ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং বা ওয়ার্ল্ড সেটিং, ম্যাজিক সিস্টেম, ফ্যান্টাস্টিক ক্রিয়েচার বা প্রাণী ইত্যাদি। আর সেই সাথে সকল উপন্যাসের মতো চরিত্রায়ন, প্লট, লিখনশৈলী এগুলো তো আছেই। ‘রাজকীয় উৎসর্গ’তে এ বিষয়গুলো কতটা ভালোভাবে উঠে এসেছে চলুন দেখি।

*ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং/ওয়ার্ল্ড সেটিং : যারা ফ্যান্টাসি উপন্যাস পড়েন তারা ভালো করেই জানেন, ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং ফ্যান্টাসিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং বলতে মূলত বোঝায় ফ্যান্টাসি উপন্যাসের মধ্যকার জগতটাকে লেখক কিভাবে সৃষ্টি করছেন সেটাকে। এখানে লেখক তার সুবিধামতো প্রকৃতিকে সাজাতে পারেন, নিয়ম সাজাতে পারেন, সৃষ্ট চরিত্রগুলোর বৈশিষ্ট্য সাজাতে পারেন। আমাদের পরিচিত এই পৃথিবীর মাঝেও তার গল্পের মঞ্চ হতে পারে (প্রাইমারী ওয়ার্ল্ড) আবার একদম সম্পূর্ণ আলাদা, অপরিচিত একটা পৃথিবীও তার গল্পের প্রেক্ষাপট হতে পারে (সেকেন্ডারী ওয়ার্ল্ড)। আবার লেখক চাইলে দুটো ওয়ার্ল্ড মিলিয়েও লিখতে পারেন। মোদ্দাকথা লেখকের মাথার ভেতর থাকা দুনিয়াটা এখানে তুলে ধরতে পারেন লেখক এবং ফ্যান্টাসি জনরার সবচাইতে মজার ব্যাপার হচ্ছে এখানে লেখক যা সাজাবেন তা কিন্তু আমাদের এই পৃথিবীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে এমন কোন কথা নেই। যেমন : আমরা যেমন দেখি এই পৃথিবীতে কেবল মানুষরাই মনের ভাব পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করার জন্য কথা বলতে পারে। কিন্তু ফ্যান্টাসি গল্পে গাছেদেরও, প্রাণিদেরও এই ক্ষমতা থাকতে পারে। তবে লেখকের মন মতো তার সবকিছু লেখার অধিকার থাকলেও পরস্পর বিরোধসম্পূর্ণ কোন বিষয় চাইলেই লেখক আনতে পারেন না। যেমন : কোন একটা জগতে কোন গ্রাভিটি নেই কিন্তু প্রাণীরা সেই জগতে খুব সহজেই হেঁটে বেড়াচ্ছে এটা কিন্তু পরস্পর বিরোধসম্পূর্ণ একটা বিষয়। এটা যদি কোন লেখক তার ফ্যান্টাসি গল্পে লিখতে চান তাহলে তাকে অবশ্যই একটা যুক্তিযুক্ত সিস্টেম তৈরী করতে হবে।

তো রাজকীয় উৎসর্গের ওয়ার্ল্ডবিল্ডিং নিয়ে বললে বলতে হবে, লেখক এখানে বলা যায় দুটো ওয়ার্ল্ড তৈরী করেছেন। একটা হলো, সাধারণ রাজ্যগুলো অর্থাৎ ডাবরি, মুদ্রাক, সোনার নালি, কোয়ার্থ, ভাঙন, দেবিদ্বার ইত্যাদি (বইয়ের শুরুতে দারুণ একটা ম্যাপও আছে)। এই রাজ্যগুলো ঠিক ভৌগোলিক বর্ণনাগুলো আরেকটু ডিটেইল হলে ভালো হতো বলে মনে হয়েছে। যেমন : পুরো বইটা পড়েও আমি বুঝতে পারিনি বইতে মূলত কোন রাজ্যের আয়তন কত। আর এই কারণে কোন রাজ্য থেকে কোন রাজ্য কত দূর সেটা বুঝতে পারিনি। আর ডিটেইলিং করতে গিয়ে এই ওয়ার্ল্ডের মানুষের ইতিহাস নিয়ে একটু লিখেছেন লেখক, যেখানে বলা হয়েছে, মানুষকে আগে শাসন করতো ডেমিটন নামে এক প্রজাতি, যাদেরকে আমার জিন গোত্রের কিছু একটা মনে হয়েছে। তবে এই ডেমিটন হঠাৎ কি করে মানুষের ওপর শাসন করার ক্ষমতা হারালো তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। আর সব গুলো রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে পাঠক হিসেবে, অন্তত দুপাতা হলেও জানতে চাইছিলাম আমি। এখানে লেখক আমাকে একটু হতাশ করেছেন। 

তবে রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে একেবারেই যে কিছু আসেনি, এমন নয়। যেমন : লেখক ভাঙন রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন। সে ইতিহাসে জানা যায় ভাঙন একসময় সমৃদ্ধ রাজ্য ছিলো, কিন্তু সে রাজ্যের অধঃপতন হিসেবে যে কারণটা দেখানো হয়েছে সেটা আমার কাছে খুব একটা কনভিন্সিং মনে হয়নি। তবুও রাজ্যগুলোর মাঝে ডাবরি, সোনার নালি আর ভাঙনই প্রাধান্য পেয়েছে এবং এগুলোর ডিটেইলিং চলনসই হয়েছে। তবে বই পড়ে আমার মনে হচ্ছে, মুদ্রাক বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা রাজ্য, তবে মুদ্রাক নিয়ে কেন বিশদ বিবরণ দেয়া হয়নি এইটা আমি বুঝতে পারিনি।

এই তো গেল, সাধারণ রাজ্যগুলোর ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং। এবার আসি ফিকটাস ওয়ার্ল্ড নিয়ে ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং এর ব্যাপারটায়। ফিকটাস ওয়ার্ল্ডের আইডিয়াটা আমার কাছে মাইন্ডব্লোয়িং একটা আইডিয়া মনে হয়েছে। ভাবছি আর তৈরী হয়ে যাচ্ছে, সেখানে গিয়ে মানুষ ঘুরতে পারছে, নিজেদের মত করে কোয়ালিটি টাইম পাস করতে পারছে; এই পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে দারুণ ভালো লেগেছে। কিন্তু আফসোস লেগেছে যে এই চমৎকার ফিকটাস ওয়ার্ল্ড নিয়ে লেখক বইতে একদমই কম লিখেছেন। ফিকটাস ওয়ার্ল্ডের গোড়াপত্তন কিভাবে হলো তা জানা যায়নি, কিন্তু আমার মতে এটা বেশ জরুরী একটা বিষয় ছিলো। আমরা জানতে পারি ফিকটাস ওয়ার্ল্ডে যেতে পারে ক্যান্তররা। আর এই ক্যান্তররা সব রাজ্যেই পায় দারুণ সম্মান। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে এই ক্যান্তর পেশাটা লোভনীয় একটা পেশা। তো লোভনীয় হলে সবাইই তো ক্যান্তর হতে চাইবে, রাইট? কিন্তু সবাই তো ক্যান্তর হতে পারবে না। ক্যান্তর হতে হলে যোগ্যতা লাগবে। কিন্তু কি যোগ্যতা লাগবে তা জানা যায়নি, ক্যান্তর হবার প্রসেস কি সেটাও জানা যায়নি এমনকি একজন ক্যান্তর কিভাবে অভিযাত্রীদের ফিকটাস ওয়ার্ল্ডে নিয়ে যান সেটাও বলা হয়নি। যেমন : হতে পারে, ফিকটাস ওয়ার্ল্ডে যাবার সময় ক্যান্তর যাদের হাত ধরেন বা যারা ক্যান্তরের হাতে ধরা ব্যক্তির হাত ধরেন এবং যারা কোন না কোন ভাবে ক্যান্তরের শরীর স্পর্শ করে রাখেন তারাই ক্যান্তরের সৃষ্টি করা ফিকটাস ওয়ার্ল্ডে যান। 

এরকম আরো বেশ কিছু জিনিস অত্যন্ত জরুরী ছিলো, যা লিখলে বইটার ওয়ার্ল্ড সম্পর্কে পাঠকের ধারণা আরো পরিষ্কার হতো বলে আমি মনে করি। পরিশেষে ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং নিয়ে আমি বলবো, লেখক আইডিয়াটা দারুণ করেছেন কিন্তু এক্সিকিউশন/ডিটেইলিং আরো বেশী পরিধি ডিজার্ভ করে। যে কারণে ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং আমার কাছে বেশ খানিকটা দূর্বল মনে হয়েছে।

ম্যাজিক সিস্টেম : ম্যাজিক সিস্টেম বলতে লেখকের সৃষ্টি করা ওয়ার্ল্ডে ম্যাজিক কিভাবে কাজ করবে, কারা কারা ম্যাজিক করার ক্ষমতা রাখে, কাদের ওপর সেগুলো কাজ করবে/কাদের ওপর কাজ করবে না এইসব সুনির্দিষ্ট নীতিমালাকে বোঝায়। এখানে লেখক ঐ ওয়ার্ল্ডের নিজস্ব কোন সায়েন্সও তৈরী করতে পারেন যেটা আমাদের জগতের সাথে হয়তো মিলবে না। কিন্তু সেক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে হবে, বোঝাতে হবে সিস্টেমটা কিভাবে কাজ করে। রাজকীয় উৎসর্গে আমরা ফিকটাস ওয়ার্ল্ড, ক্ষৌনী তৈরী আর সানভির ক্ষমতা (কি ক্ষমতা সেটা স্পয়লার হবার ভয়ে এড়িয়ে গেলাম) ছাড়া আর কোথাও ম্যাজিকের দেখা পাইনি। সুনির্দিষ্ট কোন ম্যাজিকাল সিস্টেমের বর্ণনাও উপন্যাসে উঠে আসেনি। সে হিসেবে এই উপন্যাসের ম্যাজিক সিস্টেমকে একদমই ‘সফট ম্যাজিক’ হিসেবে ধরে নিচ্ছি। তবে এই সিরিজের পরবর্তী উপন্যাসে ম্যাজিক সিস্টেমের বিপুল অ্যাপ্লিকেশন আশা করছি এবং আমি মনে করি ম্যাজিক সিস্টেম দাঁড় করানোর একটা ফোরশ্যাডো ইতোমধ্যে রাজকীয় উৎসর্গে করা হয়েছে।

ফ্যান্টাস্টিক ক্রিয়েচার/প্রানী/এলিমেন্ট : ফ্যান্টাসি উপন্যাসে স্পেশাল কিছু প্রাণী প্রায়ই দেখা যায় যেগুলোর অস্তিত্ব থাকে লেখকের কল্পনায়, আমাদের এই বাস্তব জগতে নয়। যেমন : হ্যারি পটার সিরিজে আমরা দেখি ইউনিকর্ন, হাউজ এলফ, ট্রল। লর্ড অফ দ্যা রিংস এ আমরা দেখি ডোয়ার্ফ জাতি, এলফ জাতি ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজকীয় উৎসর্গে এরকম কোন ম্যাজিক্যাল ফ্যান্টাস্টিক প্রাণী নেই তবে এখানে ক্ষৌনী নামে একটা অদ্ভূত বস্তু/এলিমেন্টের কথা এসেছে, যেটার অস্তিত্ব আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে এবং এই বস্তুর বিশেষত্ব বলি আর এই সিরিজের তার ভূমিকাই বলি, সেটা যে বিশাল কিছু তা লেখক অল্প কথায়ই বুঝিয়ে দিয়েছেন। এই ক্ষৌনীর ব্যাপারটাতে নতুনত্ব ছিলো আর আমি বিশ্বাস করি এটা সব পাঠকেরই ভালো লাগবে।

এবার আসি সকল জনরার উপন্যাসের ক্ষেত্রে সর্বজনীন যে বিষয়গুলোতে নজর দেয়া হয় সেদিকে।

‘রাজকীয় উৎসর্গ’র শেষটুকু পড়লেই বোঝা যায় এটা একটা সিরিজ হতে যাচ্ছে। যেহেতু একটি সিরিজ হতে যাচ্ছে সে হিসেবে এর প্লট নিয়ে আসলে বেশি কিছু বলার নেই। তবে এটুকু বলাই যায় যে, সিরিজের প্রথম বইটি যেরকম হওয়া উচিৎ, পাঠকের মাঝে যতটুকু আগ্রহ সৃষ্টি করা উচিৎ, তার প্রায় সবটুকুই রাজকীয় উৎসর্গ করতে পেরেছে। তবে ডিটেইলিং এর দিকে আরেকটু মনোযোগ দিলে সিরিজের পরবর্তী বইগুলোর দিকে পাঠক আরো আগ্রহী হতো আমার ধারণা। আর রাজকীয় উৎসর্গ বলে যে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে এই জিনিসটি নিয়ে আমি ঠিক ক্লিয়ার নই। মানে এই উৎসর্গটি কেন করতে হবে? শুধুই রীতি বলে? নাকি কোন স্পেশাল ব্যাপার আছে? আর এই রীতির ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরী কি? কবে থেকে শুরু হলো, কেন শুরু হলো?

চরিত্রায়নের ব্যাপারে বলবো, লেখক কোন চরিত্রেরই খুব একটা ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরী দেননি। যেটুকু দিয়েছেন তাতে চলে, কিন্তু আরেকটু ডিটেইল হলে ভালো হতো। যেমন : নৈঋত নামের চরিত্রটি আমার মাঝে সবচাইতে আগ্রহ সৃষ্টি করছে। তার রহস্যময় কথা-বার্তা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, বিজ্ঞ-জ্ঞানীর মত আচরণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু মাত্র ১৪ বছর বয়সী এই মেয়ের এরকম ভারিক্কী চিন্তাভাবনার পেছনের কারণ আমি জানতে পারিনি। হতে পারে সে একজন প্রডিজি, তবে তা নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি। তা সত্ত্বেও সিরিজের পরবর্তী বইতে আমি নৈঋতকে নিয়ে জানতে পারবো আশা রেখে এই বিষয় এখানেই ক্ষান্ত দিলাম। তবে চরিত্রায়নের ব্যাপারে যদি কারো ওপর অবিচার হয় সেটা হলো, মুদ্রাকের প্রধান ইখলাছ। এই লোকটা নিঃসন্দেহে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা রাখেন কিন্তু তাকে নিয়ে স্রেফ একটা ফোরশ্যাডো করা হয়েছে, ডিটেইল কিছুই জানানো হয়নি। এছাড়া চরিত্রায়নে লেখক বাদবাকি যা করেছেন তা আমার কাছে মোটামুটি ভালোই লেগেছে। বেশ কিছু চরিত্র (যেমন : সানভি, মুসা, আলফি পিলগ্রিম) নিয়ে লেখক যে ফোরশ্যাডো তৈরী করেছেন তা বেশ সাসপেন্স তৈরী করেছে এটা আমাকে যেমন পরবর্তী বই পড়তে বাধ্য করবে তেমনি বাকি পাঠকদেরও করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আর লেখকের লিখনশৈলী নিয়ে বললে আমি বলবো, আল কাফি নয়নের লিখনশৈলী অনেক ভালো। অনেক ভালো মানে অনেক ভালো। যে কোন বয়সের পাঠক কিংবা কিংবা যে কোন জনরার পাঠক খুব সহজেই বইটি পড়তে পারবেন, বিরক্তি আসবে না আশা করি। তবে ডিটেইলিং এর দিকে মনোযোগ দেয়া উচিৎ। এই ডিটেইলিং যেখানে দরকার সেখানে না হয়ে বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় জায়গায় হয়েছে যা বইয়ের মেদ বাড়িয়েছে বলার মত নয়, তবে ওগুলো না হলেও চলতো আমার ধারণা।

তো এই ছিলো রাজকীয় উৎসর্গ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা। ভালো/খারাপ বলার চেয়ে গঠনমূলক আলোচনা বেশি করতে পেরেছি বলে আমার বিশ্বাস এবং আমি মনে করি, এই গঠনমূলক আলোচনা পাঠককে বই নিয়ে যেমন আগ্রহী করে তোলে তেমনি লেখককেও পরবর্তী বই নিয়ে ভাবতে সাহায্য করে।

পরিশেষে, বইয়ের কোয়ালিটি নিয়ে আমি কখনোই খুব একটা মাথা ঘামাইনি। এবারও ঘামাচ্ছি না। তা সত্ত্বেও বলছি, বইটির প্রচ্ছদ করেছেন সুলতান আযম সজল এবং এই বইতে এই প্রচ্ছদ ভীষণ ভাবে মানিয়ে গেছে এবং দেখতে চমৎকার লাগছে। আর বইয়ের পেজ কোয়ালিটি, বাইন্ডিং এভারেজের একটু ওপরে বলবো। তবে এগুলো ছাপিয়ে যে বিষয়টা আমি বলতে চাই, তা হলো, ভূমি দারুণ একটা সাহস দেখিয়েছে। দেশীয় আনকোরা নতুন লেখকের মৌলিক ফ্যান্টাসি ছাপানোর ক্ষেত্রে শব্দটাকে আসলে সাহস না বলে দুঃসাহস বলাটাই শ্রেয়। এই একটি কারণই ভূমিকে আর দশটা প্রকাশনী থেকে আলাদা করেছে। হ্যাটস অফ টু ভূমি। আশা করি ভূমি ভবিষ্যতেও সাহিত্যের বিকাশে এভাবেই রিস্ক নেবে এবং এই রিস্ককে পাঠক বই কিনে পূর্ণ সম্মান দেবে।

লেখক আল কাফি নয়নকে একইসাথে সাধুবাদ এবং কনগ্রাচুলেশন্স জানাচ্ছি। সাধুবাদ আপনার এই প্রচেষ্টার জন্য এবং কনগ্রাচুলেশন্স কারণ আপনি সঠিক পথেই হাঁটছেন বলে। আশা করি অচিরেই আপনি আপনার কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন।

আপনি যদি ফ্যান্টাসি ভালোবাসেন এবং বাংলা সাহিত্যে নতুন জনরা নিয়ে এক্সপেরিমেন্টাল ওয়ার্ক দেখতে চান তাহলে অবশ্যই এ বইটি পড়বেন। প্লট, লিখনশৈলী, ফ্লো সব মিলিয়ে বইটি এভারেজের চেয়ে ওপরে। তবে একদম ইন্টারন্যাশনাল লেভেলের ফ্যান্টাসির আশা করলে আপনাকে হতাশ হতে হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ