বই : হৃদয়জুড়ে ফিলিস্তিন (অরিজিনাল)
লেখক : আবদুল্লাহ আশরাফ
বিষয় : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বিবিধ বই, ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্য
অনুবাদ: আহমাদ সাব্বির
প্রকাশনী : নাশাত
মুদ্রিত মূল্য : ১৫০/-
ইহুদি-খ্রিষ্টান-মুসলমান এই তিন জাতির নিকটেই ফিলিস্তিন এক পবিত্র ভূমি। বাইতুল মুকাদ্দাস সকলের নিকট সম্মানিত। তাই আজ অবধি ফিলিস্তিনকে নিয়ে চলছে নানান ষড়যন্ত্র। পূর্বের সোনালি ইতিহাস থেকে বর্তমানের চিত্রপট উঠে এসেছে বইজুড়ে। নবিদের মোবারকময় ঘটনাবলি বইয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে বহুগুণ। আবদুল্লাহ আশরাফ গদ্যের নিপুণ গাঁথুনি গেঁথেছেন ''হৃদয়জুুড়ে ফিলিস্তিন"।
শুরুর কথা
আমার একটা কথা খুব মনে পড়ে। বাবা বলতেন আমার এ ছেলেকে দীনের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছি। আমি তখন ছোট। মনে করতাম সত্যিই আমি দীনের জন্য ওয়াক্ফকৃত। দীনের কাজই আমাকে করতে হবে। সে থেকে বুকের ভেতর জিহাদের তামান্না সব সময় কাজ করত।
বাবার হাতে আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। তার হাত ধরে বাংলা শিখি। আদর্শলিপি এখনো চোখের তারায় ভাসে। বাংলা শেখার পর সর্বপ্রথম ছোটদের নবি নামের একটি বই হাতে তুলে দেন। প্রতিদিন পড়তাম। এমন বই আমি আর দেখি না। কিছুটা বড় হলে আমাকে শাহাদাতের তামান্না ও ফজিলত সম্পর্কিত একটি বই উপহার দেন। সুন্দর করে লিখে দেন ‘স্নেহের আবদুল্লাহকে।
শাহাদাতের তামান্না বুকে নিয়ে এতটুকু বড় হয়েছি। এ তামান্না জিয়ে থাকুক শাহাদাত পর্যন্ত। এই কামনাই করি। তাই যখন কোনো জনপদের নির্যাতন দেখি। শুনি বুকফাটা আর্তনাদ, তখন এক দু'কলম লিখতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় তাদের পাশে দাঁড়াতে। অন্তত তাদের দুঃখগুলো বোঝা ও অনুভব করার চেষ্টা করি। লাল কষ্টের গল্প লিখি। গল্প পড়ি।
আবদুল্লাহ আশরাফ মারিয়া, কিশোরগঞ্জ
2/4/2019
এই মহামারিতে প্রায় এক লক্ষ সত্তর হাজার মানুষ মারা গেল। সকালে যে মানুষটা দিব্যি সুস্থতার সঙ্গে ঘোরাফেরা করছিল, বিকালেই সে অসুস্থ। কী ভয়াবহ পরিবেশ! চারদিকে মৃত্যুর আনাগোনা। মানুষের জীবন ভেঙে পড়ছে হতাশার নিদারুণ আঘাতে। গজব গজব বলে লোকজন দিনভর ছোটাছুটি করে; কিন্তু লাভ কী? মুক্তি যে মিলছে না কারো!
হঠাৎই যেন তারা মুক্তির পথ খুঁজে পেল। তাদের বোধদয় হয়- এ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় পূর্ণরূপে স্রষ্টাতে সমর্পণ। মুক্তির অন্বেষায় আল্লাহ-ভোলা মানুষগুলো তাই ক্রমেই বিশ্বাসী হয়ে উঠলো। জীবনের ভুলগুলো স্মরণ করে স্রষ্টাকে আবার ডাকতে লাগল। ‘হে রহমান, হে রাহিম, রহম করো। করুণা করো। আমরা যে তোমারই বান্দা। হে গাফফার! ক্ষমা করো। মার্জনা করো। তুমি যে ক্ষমাশীল।'
থামে না সে গজব। তবু ফিরে যায় না মৃত্যুর ফেরেশতা। ক্রমাগত করাঘাত করে যায় জনপদের দুয়ারে দুয়ারে।
তা হলে কী স্রষ্টা আমাদের দিকে তাকাবেন না? দয়ার চাদরে ঢেকে দেবেন না আমাদের কলুষিত আত্মা? এভাবেই কী আমরা তলিয়ে যেতে থাকবো ধ্বংসের অতল গহ্বরে?
হতাশা ক্রমেই ঘনীভূত হতে থাকে। জীবন আঁধারে ঢেকে যেতে থাকে যেভাবে স্বচ্ছ নীল আকাশ অন্ধকার করে দেয় কালো মেঘের দঙ্গল। হঠাৎ তাদের বিবেক জেগে ওঠে। তারা ছুটে যায় স্রষ্টার প্রেরিত নবি হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের কাছে।
হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম কি জানতেন না সে খবর? তার কাছে কি পৌঁছায়নি সেই ভয়াবহ আজাবের সংবাদ? অবশ্যই জানতেন। তিনি যে নবি! তিনি যে রাসুল! তার সাথে তো সরাসরি সংযোগ স্রষ্টার! কিন্তু তিনি অপেক্ষা করছিলেন, মানুষ যেন নিজের ভুল বুঝতে পারে। ফিরে আসে মালিকের কাছে। রাব্বে কারিমের পথে। এক সময় তিনি দেখলেন পাপীতাপী বান্দারা ফিরে আসছে স্রষ্টার দিকে। মন থেকে তারা অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে নিজেদের কলুষিত জীবনের জন্য। তখন তিনি তাদের হয়ে ফরিয়াদ করলেন রাব্বে কারিমের কাছে- 'হে কারিম, হে রাহিম, মাফ করো। দয়া করো। তারা তোমারই বান্দা। তোমার পথের পথিক। আজাব উঠিয়ে নাও।'
নবি-রাসুলের ফরিয়াদ ফিরিয়ে দেন না রাব্বে কারিম। তিনি তাই ফেরালেন না প্রিয় রাসুল দাউদ আলাইহিস সালামের ফরিয়াদ। ক্ষমা করে দিলেন সেই জনপদবাসীকে। মুহূর্তেই আজাব উঠিয়ে নিলেন। সৃষ্টি করে দিলেন মনোরম পরিবেশ। আনন্দে হেসে উঠলো সারা জনপদ। পৃথিবী নতুনরূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো তাদের সম্মুখে।
সবকিছু শান্ত হয়ে এলে ডাকলেন দাউদ আলাইহিস সালাম সবাইকে। স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন তাদেরকে স্রষ্টার পক্ষ থেকে পাওয়া প্রত্যাদেশ। বললেন- রাব্বে কারিম যে তোমাদের আজাব থেকে মুক্তি দিলেন, সেজন্য শুকরিয়া আদায় করো তাঁর।
উৎফুল্লচিত্তে মেনে নিল জনপদবাসী নবির প্রস্তাব। রাজি হলো সবাই স্রষ্টার শুকরিয়া আদায়ের জন্য। নবির কাছেই তারা প্রস্তাব করল যেন তিনিই তাদের জানিয়ে দেন- কোন উপায়ে আদায় করা হবে স্রষ্টা এমন দয়ার উত্তম শুকরিয়া!
দাউদ আলাইহিস সালাম তাদের জানিয়ে দিলেন- আল্লাহর জন্য একটি ইবাদতগাহ নির্মাণ করো। এটা হবে তোমাদের থেকে তার প্রতি সর্বোত্তম শুকরিয়ার প্রকাশ।
হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের কথা শুনে চারদিকে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। সিজদার জন্য গৃহ নির্মাণ করা হবে? সত্যিই বনি ইসরাইল মসজিদ নির্মাণ করবে? উফ দারুণ! কী আনন্দ! কী খুশি! চারদিকে সাড়া পড়ে গেল। সবাই প্রস্তুতি নিলো মসজিদ নির্মাণ করতে। কিন্তু স্থান যে নির্ধারণ করা হয়নি? কোথায় হবে সে মসজিদ। কোন জায়গায় নির্মিত হবে স্রষ্টার ইবাদতগাহ?
সবাই আবার হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের শরণাপন্ন হলো। দাউদ আলাইহিস সালাম ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। ইশারা হলো। ইলহাম এলো স্রষ্টার পক্ষ থেকে। সে ইলহাম অনুযায়ী তিনি জায়গা নির্ধারণ করে দিলেন। পছন্দ হবার মতোই জায়গা। বনি ইসরাইলের সবাই একবাক্যে মেনে নিলো। যার যার জমি ছিল সেখানে, সবাই ওয়াকফ করে দিতে লাগল একে একে। সবার মুখে আনন্দ-দ্যুতি খেলা করতে লাগল। সব জমিই ওয়াকফ হয়ে গেল আল্লাহর ইবাদতগাহ নির্মাণের জন্য। তবে তখনও বাকি একখণ্ড জমি।
সবাই উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কখন আসবে সে? সে কি তার অংশ আদৌ ওয়াকফ করবে? সম্মত হবে কি সবার সাথে মসজিদ নির্মাণের কাজে? কারো কিছু জানা নেই। ভয়-শঙ্কা নিয়ে অপেক্ষমাণ সবাই- শেষমেশ মসজিদ নির্মাণ হবে তো!!
সবার যেন আর তর সইছিল না। এদিক-সেদিক লোক পাঠিয়ে তাকে হাজির করা হলো। জানানো হলো তাকে সব, সবিস্তারে। কিন্তু না, সে রাজি হলো না। মসজিদ নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত ভূমির তার অংশ সে ওয়াকফ করবে না। নিমেষেই অন্যান্যের মুখ কালো হয়ে এলো। হতাশার অন্ধকার ছেয়ে ফেলল তাদের মনের আকাশ। তবে কি থমকে যাবে তাদের স্বপ্ন! নির্মাণ হবে না আল্লাহর ইবাদতগাহ! তা কী করে হয়!
সবাই চেপে ধরল তাকে। অনুনয়-বিনয় করল। কিন্তু না, কারো আবদারেই কোনো কাজ হলো না। শেষমেশ আল্লাহ নবি তাকে বুঝালেন। শোনালেন মসজিদের জন্য ভূমিদানের ফজিলত। শেষমেশ সে রাজি হলো। নবির মুখে ফজিলতের কথা শুনে? না। সে জমির বিনিময়ে এক অদ্ভুত প্রস্তাব করে বসল, যা শূনে বিস্ময়ে সবাই থ।
সে ভূমির সামান্য অংশের বিনিময়ে তার জমির চারপাশে বুক-সমান উঁচু দেয়াল গাঁথা হবে। তারপর সেই চতুষ্কোণ জমির মধ্যিখানে ঢালা হবে স্বর্ণমুদ্রা। জায়গাটা যখন কানায় কানায় ভরে উঠবে স্বর্ণমুদ্রায় তখন সে তার জমির অংশ ছেড়ে দেবে আল্লাহর ইবাদতগাহ নির্মাণের জন্য।
তার এমন অদ্ভুত আবদারে ক্ষেপে গেল সেই জনপদের অধিবাসীরা। তারা সমস্বরে বলে উঠল- এমন বিনিময়ের কথা আমরা এই জীবনে শুনিনি। এমন দাবি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমার জমি ছিনিয়ে নেব তার থেকে।
দাউদ আলাইহিস সালাম সবাইকে নিবৃত্ত করলেন। না, তোমরা এমন করতে পারো না। ছিনিয়ে নেওয়া জায়গায় আল্লাহর ইবাদতগাহ নির্মিত হতে পারে না। তার প্রস্তাব মেনে নিয়েই সেখানে নির্মিত হবে মসজিদ। নবির আদেশ। ফেলে দেবার উপায় কী! সবাই মেনে নিল দাউদ আলাইহিস সালামের পরামর্শ। তোড়জোড় লেগে গেল জমির মালিকের কাঙ্ক্ষিত স্বর্ণমুদ্রা জোগাড়ের জন্য। সবাই দৃঢ় সংকল্পে স্থির হয় মসজিদ আমরা নির্মাণ করবই।
সুখের কথা হলো- লোকটি সবাইকে পরীক্ষা করছিল। সে দেখতে চাচ্ছিল মসজিদ নির্মাণের জন্য তাদের মনোবল কতটা দৃঢ়! তারা সত্যিই মন থেকে চায় আল্লাহর ঘর নির্মাণ করতে, নাকি এটা তাদের সাময়িক আবেগ! কিন্তু সে যখন জনপদবাসীর সবার দৃঢ়তা ও অবিচলতা দেখতে পেল তখন সে তার উদ্দেশ্য আর গোপন রাখল না। বলে দিল তার পরীক্ষা গ্রহণের কথা। সে বলল, “তোমাদের সংকল্পের দৃঢ়তা দেখে আমি খুশি। আমার কিছুর প্রয়োজন নেই। আমি চেয়েছিলাম জমি ও স্বর্ণমুদ্রা উভয়টি মসজিদ নির্মাণের জন্য দান করব। আমাকে কিছুই দিতে হবে না। তোমরা নির্বিঘ্নে মসজিদ নির্মাণ করো।'
অকস্মাৎ তার মুখে এ কথা শুনে আনন্দের স্রোত বয়ে গেল সবার মাঝে। সবাই খুশিতে কাজে নেমে পড়ল। যার যা আছে তা নিয়ে লেগে গেল মসজিদ নির্মাণে। প্রাচীর স্থাপনের জন্য খুঁড়তে শুরু করল। কে দেখে সে আনন্দ! সে খুশি! আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো চারপাশ। ইটের পর ইট রেখে স্থাপন হচ্ছে দেয়াল। মানুষ-সমান
দেয়াল তোলা হলো। জিকিরে জিকিরে এগুতে লাগল মসজিদের নির্মাণকাজ।
এমন সময় ওহি এলো আল্লাহর পক্ষ থেকে দাউদ, আমি বনি ইসরাইলের শোকরিয়া গ্রহণ করলাম। আমি এ কাজ তোমার ছেলে সুলায়মান-এর মাধ্যমে সম্পন্ন করব। এ কাজ আপাতত স্থগিত রাখ।'
কী আনন্দ-উদ্দীপনা আর উচ্ছ্বলতায় এগিয়ে চলছিল মসজিদের নির্মাণ কাজ। আশা-আকাঙ্ক্ষা আর ভালোবাসায় নির্মিত হচ্ছিল দেয়ালের পর দেয়াল। হঠাৎ এলো স্রষ্টার নতুন আদেশ! আর কি এগোনো যায়! যায় না। মসজিদ নির্মাণের আদেশদাতাই যখন নির্মাণকাজ বন্ধ করার হুকুম করেন, কার সাধ্য আর একটা ইট গেঁথে দেয় দেয়ালের গায়। থমকে গেল সব কাজ। মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া তো উদ্দেশ্য নয়। মূল লক্ষ হলো মসজিদের মালিকের সন্তুষ্টি অর্জন। আর তার সন্তুষ্টি হলো তার হুকুম মানার মধ্যে, কোনো কাজের বাহ্যিক পূর্ণতা কিংবা অপূর্ণতার ভেতর নয়।
হজরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম ছিলেন একজন দক্ষ শাসক। সমগ্র পৃথিবীর শাসনভার রাব্বুল আলামিন তার হাতে অৰ্পণ করেছিলেন। কেবল মানুষ নয়; জিন পর্যন্ত তার হুকুম তামিলে বাধ্য ছিল। শুধু কি মানুষ আর জিন! বনের পশু, পানির মাছ, গর্তের পিপীলিকা- এককথায় আল্লাহর সব সৃষ্টি ছিল তার শাসনাধীন। তিনিই একমাত্র বাদশাহ, যার শাসন ক্ষমতা এতটা বিস্তৃত ছিল। তিনি তার পিতার অসিয়ত পূরণের উদ্যোগ নিলেন। পূর্বের চাইতে বিপুল উৎসাহে শুরু হলো মসজিদের নির্মাণ কাজ। এবার মানুষের সাথে জিনেরাও শামিল হলো মসজিদের নির্মাণ-কাজে।
মসজিদের নির্মাণ-কাজ চলছে। একটি কাঠের গম্বুজের ভেতর দাঁড়িয়ে কাজের তদারকি করছেন হজরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম। বড় বড় পাথর কেটে নির্মাণ করা হচ্ছে মসজিদ। পৃথিবীর আনাচ-কানাচ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন পাথর। জিনে-ইনসানে কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করে চলেছে। কারও মধ্যে কোনো বিরাম নেই। কোনো আলস্য নেই। ক্লান্তি নেই। আনন্দচিত্তে কর্মে মুখর হয়ে আছে সবাই।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....