রইলো তোমায় নিমন্ত্রণ বই : লিখেছেন নাফিসা সূচি | Roilo Tomay Nimontron

  • বই : রইলো তোমায় নিমন্ত্রণ - কেন পড়বেন বইটি?
  • লেখিকা : নাফিসা সূচি
  • প্রচ্ছদ : আশরাফুল ইসলাম 
  • প্রকাশক : নবকথন প্রকাশনী
  • মলাট মূল্য : ৬২০ টাকা
  • Review Credit 💕 Tamanna Sultana

"এই মেঘলা দিনে একলা, ঘরে থাকেনাতো মন 
কাছে যাবো, কবে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।"

চলে এলাম আপনাদের কাছে আজ ভিন্ন রকম একটি গল্পের নিমন্ত্রণ নিয়ে। লেখক নাফিসা সূচী'র প্রথম একক উপন্যাস "রইল তোমায় নিমন্ত্রণ"। উপন্যাসটি সামাজিক, পারিবারিক,রোমান্টিক ঘরানায় লেখা। লেখক এখানে পারিবারিক মেলবন্ধন ভালোবাসা ও পিতৃস্নেহের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। মানুষের জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত অনিশ্চিত, কার ভাগ্য কার সাথে কখন কিভাবে জুড়ে যায় আমরা কেউ বলতে পারবো না। এমনই কিছু সম্পর্ক নিয়ে পুরো উপন্যাসটি সুনিপুণভাবে সাজানো হয়েছে।

ঘুরে আসি নিমন্ত্রিত বাড়ি থেকে:
রইলো তোমায় নিমন্ত্রণ পুরো উপন্যাসটি জুড়ে ছিল স্বনামধন্য চৌধুরী বাড়ির কাহিনি। চৌধুরীবাড়ীর অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সারা ও মাহাবুব চৌধুরীর দুই জমজ ছেলে নীরব আর নিশীথ। দুই ভাই যেন দুই দেহ এক প্রাণ। এবং এই দুইজনের প্রাণ ভোমরা হচ্ছে তাদের পালক পুত্র কোমল। একটি দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোমলের আগমন ঘটে নিশীথের জীবনে এবং পরবর্তীতে এই কোমল হয়ে ওঠে পুরো চৌধুরী বাড়ি একমাত্র সুখের উৎস। বিভিন্ন ঘটনা ও কাহিনির মধ্যে দিয়ে উপন্যাস আগমন ঘটে নিতশী আর গুনগুনের। তারা দুইজনই তাদের ভালোবাসার জালে নীরব আর নিশীথকে আটকে ফেলে। কিন্তু নিতশী আর গুনগুন কি পারবে কোমলের দায়িত্ব নিতে? অন্য কারোও সন্তানকে নিজের সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে। নাকি গুনগুনও পরীর মতো ব্যর্থ হয়ে নিশীথকে চিরজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবে। কি এমন হয়েছি নিতশী আর নীরবের মাঝে যার দরুন নিতশী আত্মহত্যার মতো জঘন্য পাপ করতে চলেছিলো? কোমল কি কখনো নিজের মায়ের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে পারবে? এইসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে উপন্যাসটির পাতায় পাতায়।

নিমন্ত্রিত চরিত্ররা:
রইলো তোমায় নিমন্ত্রণ যেহেতু এটি একটি সামাজিক এবং যৌথ পরিবার কেন্দ্রিক উপন্যাস, সেহেতু এখানে বহু চরিত্রের সমাগম ঘটেছে। লেখক গল্পের প্রতিটা চরিত্র খুব সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। অনেকগুলো চরিত্রের ভিড়েও কোন চরিত্র স্বল্প সময়ের জন্যও নিজের সক্রিয়তা হারায়নি। নীরব,নিশীথ,নিতশী,গুনগুন,গুন্জন, অঙনা,ভ্রমর,কোমল, দাদী,রনক ও রাব্বি চৌধুরী, পরী, সারা ও মাহাবুব চৌধুরী, সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে চমৎকারভাবে উপন্যাসটি রচনায় অবদান রেখেছে।

নীরব ও নিশীথ: উপন্যাসের দুটি প্রধান চরিত্র হচ্ছে নিরব ও নিশীথ। জন্মগতভাবে দুজন জমজ ও দেখতেও প্রায় একই রকম।কিন্তু স্বভাবে দুজন দুই ভিন্ন চরিত্র। নিরব যতটা বাস্তববাদী এবং শক্ত মন-মানসিকতার নিশীথ ততটাই শান্ত ও আবেগ প্রবন। এই দুটি চরিত্রই আমাকে সমানভাবে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করেছে। পুরো উপন্যাস জুড়ে তাদের অবদান ছিলো মনোমুগ্ধকর। 

নিতশী ও গুনগুন: এরা উপন্যাসের নায়িকা হলেও সম্পর্কে চাচাতো দুই বোন। গুনগুন দেখতে যেমন মিষ্টি, স্বভাবের দিক দিয়ে ঠিক ততটাই চমৎকার। নিতশী মা হারা এক মেয়ে।ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল, ঠোটকাটা ও প্রচন্ড রগচটা। যেকোন সিদ্ধান্ত বিনা পরিনাম ভেবেই নিয়ে নেয়,হোক তাতে তার নিজেরই ক্ষতি। গুনগুন ঠিক তার উল্টো, নিজের ভালোবাসার জন্য যেকিনা সবরকম ত্যাগ করতে সদা প্রস্তুুত। উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত এই দুই চরিত্র পাঠক ধরে রাখতে সক্ষম।

কোমল ও গুঞ্জন: উপন্যাসের সবচেয়ে ছোট চরিত্র হচ্ছে কোমল ও গুঞ্জন। কোমল বয়সে ছোট হলেও পুরো উপন্যাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ছিল এই চরিত্রটি। নিজের ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি ও চমৎকার সব সংলাপ দিয়ে পুরো উপন্যাসটি মাতিয়ে রেখেছিল কোমল। তার পাপ্পাদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে রীতিমতো। গুঞ্জন চরিত্রটিও ছিল খুবই মিষ্টি। কোমল আর গুঞ্জনের দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি পুরো উপন্যাস জুড়ে লক্ষ্য করা যায়। 

মহিলা: ইনি গল্পের সবচেয়ে প্রবীণ ও মজার চরিত্র। জি হা আমি দাদির কথাই বলছি। উনার নাম হলো মহিলা। গ্রাম্য ভাষায় কথা বলা সহজ সরল এক নারী,যার মনে স্বামী ও নিজ পরিবারের জন্য অগাধ ভালোবাসা। পুরো উপন্যাসে তার সংলাপগুলো আমার চমৎকার লেগেছে। শাষন, বারন, ও ভালোবাসা দিয়ে পুরো পরিবারকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছেন দাদি।
"অল্প বয়সের পেরেম হইলো ছোঁয়া ছুয়ি রোগ। একজনরে করতে দেখলে আরেক জনেরও চুলকায়।" বাণীতে আমাগো দাদী।

নামকরন ও প্রচ্ছদ: "রইল তোমায় নিমন্ত্রণ"নামটা কি সুন্দর না? উপন্যাসটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এই নামের মধ্যেকার আবহে যে আনন্দ রয়েছে, জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে আহ্বান সবটা মিলিয়ে উপন্যাসটির নামটা আমার একেবারে সঠিক লেগেছে । কিছু কিছু জায়গায় গিয়ে মনে হয়েছে এই নামটি দিয়েই যেন উপন্যাসটির প্রতি মায়া বাড়িয়ে দিল।
এই উপন্যাসের প্রচ্ছদেই যেন পুরো উপন্যাসটি ফুটে উঠেছে।এত্ত সুন্দর করে প্রচ্ছদশিল্পী প্রচ্ছদটা ফুটিয়ে তুলেছেন তাকে অবশ্যই ধন্যবাদ এবং ভালোবাসা জানাচ্ছি ।

প্রিয় উক্তি:
১. ইউ নো পাপ্পা বলে, হিস্যু ইজ অ্যা ভেরি সিরিয়াস ইস্যু। 
২. তোর কাছে সবচাইতে বড় অপরাধী আমি হলে, তোর সবচাইতে কাছের মানুষ হয়ে তোর পাশে থাকবো আজীবন। 
৩.মানুষের চাওয়া পাওয়া যত কম তার জীবনে সুখ-শান্তি ও ততবেশি। 
৪. মেয়েরা বিয়ে বসে করে না। কিন্তু তুমি করেছ আর আমি বসেছি। তাই এবার তোমার দায়িত্ব আমি নয়, বরং আমার দায়িত্ব তুমি নেবে। 
৫. অন্য একজনের করা ভুলের শাস্তি আরেকজনকে দিতে নেই । 
৬. যে কোন ব্যক্তিকে জানতে হলে আগে সময় নিতে হয়। কারো সম্পর্কে সবটা না জেনে হুটহাট কোনো খারাপ ধারণা রাখা উচিত নয়। 
৭. একজন আরেকজনকে বুঝতে পারাটাই দুটো মানুষের মনকে সারাজীবন এক বাধনে বাঁধার জন্য যথেষ্ট। 
৮. মায়ের অভাব হয়না পূরণ সব পাওয়াতেই, মা তো হয় মায়েরই আদলে। মমতা আছে যারই মাঝে, মা বলা তারেই সাজে।
৯. জীবন সত্যিই বড় অদ্ভুত কখন কিভাবে একটি জীবনের সাথে অন্য আরেকটি জীবনের তার জুড়ে সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। 
১০. জীবনের সবকিছু কেমন দ্রুত বদলে যায়। সে বদল এর সাথে নিজেকেও বদলে নিতে পারার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মানুষের মাঝে। কেউ পারে আবার কেউ বা হারে।

ভালো লাগা ও না লাগার দিক: পুরো উপন্যাসটিতে ভালো লাগার অসংখ্য দিক আছে আমার মতে, সুন্দর সাবলিল লেখনী, নির্ভুল শব্দচয়ন, চমৎকার সংলাপ, দারুণ চরিত্র গঠন ও সর্বোপরি অসম্ভব প্রিয় কাহিনি বিন্যাস।

শুধুমাত্র একটি বিষয়ে আমার সামান্য মনোক্ষুন্ন হয়েছে, তা হলো উপন্যাসটি খুব বেশি মেদযুক্ত। উপন্যাসের প্রথম দিকে কিছু অপ্রাসঙিক ঘটনা আছে যা খুবই বিস্তারিতভাবে লিখা হয়েছে। যার ফলে বইটাও একটু নাদুস-নুদুস হয়েছে। লেখক চাইলে এসকল বিষয় সংক্ষেপে স্কিপ করতে পারতো। তারপরও বলবো এই সামান্য বিষয় পুরো উপন্যাসটির সৌন্দর্য সামান্য ম্লান করতে পারেনি। বইটি একবার হলেও পড়ে আসার নিমন্ত্রণ রইলো সকল পাঠকের প্রতি। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ