সীরাতে নোমান : আল্লামা শিবলী নোমানী - কেন পড়বেন? | Sirate Noman : Allama Shibly Nomani

   সীরাতে নোমান বই পাঠ পর্যালোচনা

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)'এর চিন্তাদর্শন বিষয়ে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হলো উপমহাদেশের মহান আলেম, সীরাত বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবেত্তা আল্লামা শিবলী নোমানীর লেখা ❝সীরাতে নোমান❞। আল্লামা শিবলী নোমানী একইসাথে হানাফী মাযহাব ও ফিকহে হানাফী সম্বন্ধে সুপন্ডিত হওয়াতে তাঁর আলোচনা হয়েছে সামগ্রিক।

আল্লামা শিবলী নোমানী কর্তৃক লিখিত “সীরাতে নোমান” অত্যন্ত চমৎকার এবং ক্ল্যাসিক একটি গ্রন্থ। গ্রন্থটি মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত : ১. ইমাম আবু হানিফার জীবনঘনিষ্ঠ আলোচনা, ২. ইমাম আবু হানিফার চিন্তাধারা ও দর্শন, ৩. ইমাম আবু হানিফার বিখ্যাত ছাত্রগণ।

🍁বই : সীরাতে নোমান
🍁লেখক : আল্লামা শিবলী নোমানী
🍁প্রচ্ছদ : হিশাম আল নোমান
🍁প্রকাশনী : মক্তব প্রকাশন
🍁মূল্য : ৩৬০
🍁পৃষ্ঠাসংখ্যা : ২৮৭


পাঠপ্রতিক্রিয়া

একটি মানুষ বা গোত্র বা জাতি ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করবে না, যতক্ষণ না তারা সমসাময়িক পরিবেশের সাথে চলমান সমস্যার সমাধান সেখানে লক্ষ্য করবে। ইসলামই একমাত্র দ্বীন যা ১৪'শ বছর যাবৎ গোটা দুনিয়ার কাছে প্রাসঙ্গিক এবং এটি পৃথিবীর শেষলগ্ন অবধি প্রাসঙ্গিক রয়েই যাবে। এখন মানস মননে প্রশ্ন জাগ্রত পারে, ইসলাম কি প্রতি যুগে নতুন রূপে আবর্তিত হয়? এর উত্তর হলো "না"। ইসলাম মানবজাতিকে যে মূলনীতিগুলো দিয়েছে সেগুলোকে যুগোপযোগী করে তোলেন সে সময়ের যুগশ্রেষ্ঠ মুজতাহিদগণ।

মুসলিম উম্মাহর মুজতাহিদের সংখ্যা অসংখ্য; অসংখ্য মুজতাহিদগণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ ছিলেন ইমামে আযম আবু হানিফা (রহ.)। তিনি ছিলেন একাধারে মুজতাহিদ, মুতাফাক্কির, ফকিহ, হাদিস বিশারদ, মুতাকাল্লিম। তিনি ইলমুল কালাম, উসুল ও মেথডোলজি, ধর্মতত্ত্বকে নতুন করে উত্থাপিত করে শাস্ত্ররূপে বিশ্বদরবারে পেশ করেন। তাঁর ইজতিহাদ এতোটাই প্রাসঙ্গিক ও শক্তিশালী ছিল যেটা হাজার বছরের চিন্তাধারার সাথে সফলভাবে মোকাবিলা করেছে এবং পারস্য ও রোমান জ্ঞানধারার বিপরীতে ইসলামের বিশ্বজনীনতা তুলে ধরতে পূর্ণাঙ্গভাবে সক্ষম হয়েছে। শুধু এতেই তাঁর পরিচয় প্রকাশ পাবে না যদি তাঁর ফিকহ (আইন) সম্পর্কে না বলা হয়; তাঁর ফিকহের উপর ভিত্তি করে ইসলামী সভ্যতার শাসন কার্য সুদীর্ঘকাল ব্যাপী পরিচালিত হয়েছে।


এবার বইটিতে স্থান প্রাপ্ত বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক...এই গ্রন্থটি তিনটি ভাগে বিভক্ত -

• প্রথম অংশে প্রকাশিত হয়েছে ইমাম আবু হানিফার পরিচয়, জীবন, জ্ঞানার্জন, কর্মক্ষেত্র, তাকে ঘিড়ে প্রচলিত রূপকথার গল্পের অবাস্তব কাহিনীগুলোর সুস্পষ্ট জবাব এবং সেই সাথে ইমাম সাহেবের উচ্চ আখলাক, তাঁর সহজাত মেধা ও গভীর প্রজ্ঞার নিদর্শন তুলে ধরার মধ্যে এই অধ্যায়ের অতি টানা হয়েছে ।


• দ্বিতীয় অংশটি সজ্জিত হয়েছে ইমাম আবু হানিফার জ্ঞান, উসূল, কর্মযজ্ঞ, মেথডলজি, চিন্তাধারা, দর্শন নিয়ে; সর্বোপরি ইমামে আযমকে নিয়ে চর্চা ও আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর মাসয়ালা বিশ্লেষণ এবং বেশ কিছু মাসয়ালা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। যেখানে স্পষ্টত যে, ইমামে আযম ওহী ও আক্বলের মধ্যে মেলবন্ধন লক্ষ্য করেছেন। একই সাথে আল্লামা শিবলী নোমানী ইসলামী আইন রোমান আইন থেকে গৃহীত, কিংবা ইলমুল ফিকহ আজকের পশ্চিমা আইনের অনুরূপ এমন ধ্যান ধারণাকে যৌক্তিকভাবে খন্ডন করেছেন।


অসাধারণ এই আলোচনাকে আল্লামা শিবলী নোমানীর মতো বিদগ্ধ ইতিহাসবেত্তা তাঁর মননশীল মেধা খাটিয়ে বেশ সাজানো-গোছানো ও পরিপাটি করে উপস্থাপন করেছেন, যার ফলে বলা যায়, দুর্বোধ্য এই বিষয়টি পাঠকের জন্য খুবই সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।


• বইটির তৃতীয় অংশে ইমামে আযমের গড়ে তোলা সুযোগ্য চিন্তাশীল, মুজতাহিদ, মুতাফাক্কির, মুহাদ্দিস ও ফকিহগণের জীবনী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। মননশীল এই লেখক হানাফি মাযহাবের ইমামদের জীবনীচরিত করেছেন, যেখানে হাদীসাঙ্গন, ফিকহাঙ্গন দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এই আলোচনার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর এই মুজতাহিদ, মুহাদ্দিস ও মুতাকাল্লিমের সীরাতের পরিসমাপ্তি ঘটে।

ভাবপ্রকাশ

❝সীরাতে নোমান❞ গ্রন্থটির নাম থেকেই এর আলোচনার বিষয়বস্তু আচঁ করা যাচ্ছে। এটি ইমামে আযমের জীবনী, যেখানে তাঁর জীবন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আবু হানিফার নাম শুনেনি এমন কাউক হয়তো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, তাই তাকে নিয়ে আজগুবি কথাবার্তাও বেশ সাধারণ হয়েছে, যেমন-চল্লিশ বছর এশার ওযু দিয়ে ফজর নামাজ আদায়, ধারাবাহিকভাবে ত্রিশ বছর রোজাপালন, ৭০০০ বার কুরআন খতম, সাধারণ কারণে দীর্ঘদিন মাছ ও বকরীর গোশত না খাওয়া, ইমাম সাহেবের কোনো কন্যাসন্তান না থাকা সত্ত্বেও কোনো এক অদ্ভুত কারণে মেয়ের নামানুসারে তাঁর নামকরণ হওয়া এসব অবাস্তব বিষয়গুলো সম্পূর্ণ বানোয়াট। যেগুলো আমাদের এ মহান ইমামকে রূপকথা গল্পের কোনো চরিত্র হিসেবে ভাবতে শিখায়। যা আমাদের ইমামে আযম সম্পর্কে পাঠককে অবহেলিতও করে বটে। ″সীরাতে নোমান″ এর পাঠক এসব ভালোভাবেই বুঝতে পারবে এবং ইসলামের বিশ্বজনীনতাও খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারবে।


সবশেষে বলতে চাই দারুন একটি বই পড়লাম। সকলকে অনুরোধ করবো একবার পড়ে দেখার জন্য। লেখকের লেখনি আমাদের জানার পরিধিকে বাড়াবে এবং সত্যিই মুগ্ধতা এনে দেবে হৃদয়ে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ