সময়ের পদরেখায় ফিলিস্তিনের ইতিহাস : ড. রাগিব সারজানি | Somoyer Podrekhay Philistiner Itihash

  • সময়ের পদরেখায় ফিলিস্তিনের ইতিহাস
  • লেখক : ড. রাগিব সারজানি
  • প্রকাশনী : মাকতাবাতুল হাসান
  • বিষয় : ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্য
  • অনুবাদক : নাজিবুল্লাহ সিদ্দিকি
  • পৃষ্ঠা : 352, কভার : হার্ড কভার
  • ভাষা : বাংলা

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসের অতীব গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ নিয়ে আমার মাথায় সময়রেখা রচনার চিন্তার উদয় হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস এক সুবিশাল ও মহান ইতিহাস। ধন-রত্ন এবং সম্পদ-ভান্ডারে সমৃদ্ধ এক ইতিহাস, যার বিস্ময় যুগ যুগ ধরেও কাটে না।

ইসলামি ইতিহাস এবং ইসলামি ইতিহাসের হাজারো মহান ঘটনাপ্রবাহের মধ্য থেকে আমি কেবল একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস তুলে ধরব, যা নিয়ে গবেষণা করা বর্তমান মুসলমানদের ওপর অপরিহার্য। তা হলো, ফিলিস্তিনের ইতিহাস। ফিলিস্তিনের ইতিহাস এমন একটি বিষয়, যে সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য বলে আমি মনে করি। ফিলিস্তিনের ইতিহাসের প্রতিটি অনুষঙ্গের মধ্যে রয়েছে বহু শিক্ষা ও উপদেশ, যা থেকে আমরা আমাদের বর্তমান অবস্থায় এবং নিকটতম ও দূরবর্তী ভবিষ্যতে উপকৃত হতে পারব।

শুরুতেই কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, ইতিহাস আমাদের কেন পাঠ করতে হবে? আমি উত্তরে বলব, এটা সরাসরি আল্লাহ তাআলার নির্দেশ। তিনি বলেন,

ولو شئنا لرفعناه بها ولكنه أخلد إلى الأرض واتبع هواه فمثله كمثل الكلب إن تخيل عليه يلهث أو تتركه يلهث ذلك مثل القوم الذين كذبوا

بآياتنا فاقصص القصص لعلهم يتفكرون আমি ইচ্ছা করলে সেই আয়াতসমূহের বদৌলতে তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করতাম। কিন্তু সে তো দুনিয়ার দিকেই ঝুঁকে পড়ল এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত ওই কুকুরের মতো হয়ে গেল, যার ওপর তুমি হামলা করলেও সে জিহ্বা বের করে হাঁপাতে থাকবে, আর তাকে (তার অবস্থায়) ছেড়ে দিলেও জিহ্বা বের করে হাঁপাবে। যেসব লোক আমার আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করে এই হলো তাদের দৃষ্টান্ত। সুতরাং তুমি তাদেরকে এসব ঘটনা শোনাতে থাকো, যেন তারা কিছুটা চিন্তাভাবনা করে।

[সুরা আরাফ : ১৭৬]

আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সরাসরি নির্দেশ এসেছে, আমরা যেন ঘটনাবলি বর্ণনা করি এবং ইতিহাসকে উম্মাহর সামনে তুলে ধরি। এ ছাড়া ইতিহাসের তো পুনরাবৃত্তি ঘটে। এক বছর, দুবছর কিংবা ১০ বছর পূর্বে অথবা হাজারো বছর পূর্বে যেসব ঘটনা ঘটেছে, বর্তমানে তার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। কারণ, পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলার কিছু অমোঘ রীতি রয়েছে, যা অপরিবর্তনশীল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন,

واستكبارا في الأرض ومكر الشيئ ولا يحيق المكر السيئ إلا بأهله فهل ينظرون إلا شئة الأولين فلن تجد لسنة الله تبديلا ولن تجد لسنة الله

تحويلا

কারণ, এরা পৃথিবীতে উদ্ধত ছিল এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। আর ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্রকারীদেরই পরিবেষ্টন করে। তবে কি এরা এদের পূর্ববর্তীদের বিধানের প্রতীক্ষা করছে? বস্তুত তুমি আল্লাহর বিধানের কখনো কোনো পরিবর্তন পাবে না এবং আল্লাহর বিধানের কোনো ব্যতিক্রমও দেখবে না। [সুরা ফাতির : ৪৩]

মুসলমানরা একই ভুলের শিকার হয় বারবার। এর কারণ হলো, তারা ইতিহাস অধ্যয়ন করে না। যেমন ধরুন, আমরা যারা চিকিৎসক আছি, কোনো রোগীর চিকিৎসা করতে তার পুরো বৃত্তান্ত আমাদের জানতে হয়। বিগত বছর তার কী হয়েছিল, দশ বছর পূর্বে কী ঘটেছিল, তখন সে কোথায় ছিল, এখন কোথায় আছে, তার বর্তমান এবং অতীতের সমস্যাগুলো কী কী ইত্যাদি বিষয় আমাদের জানতে হয় তাকে সঠিক চিকিৎসা প্রদান করার স্বার্থেই।

বর্তমান ফিলিস্তিনে বহুবিধ সমস্যা ও সংকট চলছে। মিডিয়া চ্যানেলগুলো তার ঘটনাপ্রবাহ প্রতিমুহূর্তে প্রচার করছে। প্রিয় পাঠক ভাই ও বোনেরা, ফিলিস্তিনে চলমান সংকটের সমাধান পবিত্র কুরআন এবং নববি সুন্নাহর মধ্যেই রয়েছে। ফিলিস্তিনের ইতিহাস অধ্যয়ন এবং অধুনা ও পূর্ববর্তী উম্মাহর ইতিহাস পাঠ করলেই আমরা এ সংকট থেকে মুক্তি পেতে পারি। এ ইতিহাসের পরতে পরতে আমাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা। বর্তমান ফিলিস্তিন এবং অন্যান্য পীড়িত মুসলমানদের সংকট থেকে উত্তরণের পন্থা সম্পর্কে আমি কিছু আলোকপাত করব।

কিছু মানুষ মনে করে যে, ফিলিস্তিন সমস্যা কেবল একটি আঞ্চলিক সমস্যা। ফলে তাদের মনে হবে যে, আমার কথাগুলোর দ্বারা ফিলিস্তিনি জনগণই কেবল উদ্দেশ্য । এটা সত্য যে, ফিলিস্তিনিরাই আমার প্রথম উদ্দেশ্য, যেহেতু তাদের ওপর দিয়ে তাণ্ডব বয়ে যাচ্ছে। সুতরাং তাদেরকেই প্রথমে উক্ত সমস্যা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। তবে বন্ধুগণ, এটা সর্বজনীন সংকট। সকল মুসলমানের সমস্যা।

মনে পড়ে একবার আমি আলেকজান্দ্রিয়া শহরে বক্তৃতা করছিলাম। বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল ফিলিস্তিন সংকট এবং মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তখন একবোন একটি চিরকুট পাঠিয়ে অত্যন্ত কড়া ভাষায় বলেন যে, আমরা ফিলিস্তিন নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করতে যাব কেন? আমাদের মিশরে তো কত সমস্যা রয়েছে; সেগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করি। সে প্রসঙ্গে কথা বলি!

সেদিন তার উত্তরে বলেছিলাম, 'ফিলিস্তিন সমস্যা কি মিশর এবং মিশরের বাইরের সকল মুসলমানের সমস্যা নয়?' তখন এ নিয়ে দীর্ঘ সময় একরকম বাগবিতণ্ডা চলে। অধিকাংশ মুসলমান ফিলিস্তিন সমস্যাকে মুসলমানদের সমস্যা মনে করে না; বরং এটিকে ফিলিস্তিনিদের ব্যক্তিগত সমস্যা মনে করে থাকে। এটিই আমাদের সমস্যা, আমাদের তা কাটিয়ে উঠতে হবে, ফিলিস্তিন নিয়ে গবেষণা করতে হবে। ফিলিস্তিন প্রতিটি ধর্মপ্রাণ ও সচেতন মুসলমানের জল্পনাকল্পনা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলার বাণী, সুন্নতে নববিতে নবীজির বক্তব্য এবং ইসলামি ইতিহাসের ধাপে ধাপে মুসলিম উম্মাহর সন্তান পুণ্যবান ব্যক্তিগণ, মুজাহিদ ও আলেমগণের কর্মপ্রক্রিয়া এটাই প্রমাণ করে।

ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে আমরা কেন পর্যালোচনা করব?

ফিলিস্তিন সমস্যা প্রথমত আমাদের আকিদা-বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার অর্থ হলো, আকিদা ছাড়া যেমন মুসলমান বাঁচতে পারে না, তেমনই ফিলিস্তিন ছাড়াও মুসলমান বাঁচতে পারে না। আর এজন্যই ইহুদিরা দাবি করে যে, ফিলিস্তিন তাদের ভূমি! তারা ফিলিস্তিনভূমিতেই জেঁকে বসে আছে, অন্য কোনো ভূমি তারা পছন্দ করে না। কারণ, তাদের মতে ফিলিস্তিনের সঙ্গে তাদের বিশ্বাসও জড়িয়ে আছে। তাদের দাবি, ‘এ ব্যাপারে আমাদের তাওরাত গ্রন্থে সুস্পষ্ট আলোচনা এসেছে'। অথচ তাওরাত বিকৃত গ্রন্থ । তাতে বহু সমস্যা রয়েছে। তদুপরি তারা তাদের দাবিতে অটল রয়েছে। আমরাও বলি যে, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের সঙ্গে আমাদেরও আকিদা-বিশ্বাস জড়িয়ে আছে। সুতরাং এখানে দুই আকিদার দ্বন্দ্ব; একটি হলো বিশুদ্ধ ইসলামি আকিদা, যার মাধ্যমে সকল ধর্মের সমাপ্তি হয়েছে; অন্যটি হলো বিকৃত আকিদা। মুসলিম-অমুসলিম সকলেই জানে যে, মুসা আ.-এর পর তাওরাত ও ঈসা আ.-এর পর ইনজিল বিকৃতির শিকার হয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে। পক্ষান্তরে আমরা প্রমাণাদি এবং সুস্পষ্ট দলিলের ভিত্তিতে বলি যে, ফিলিস্তিন সমস্যা আমাদের আকিদা-বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা দলিলবিহীন অহেতুক দাবি করি না। বরং আমাদের নিকট সুস্পষ্ট দলিল প্রমাণ রয়েছে যে, এ ব্যাপারে আমাদের আকিদাই হলো বিশুদ্ধ আকিদা।

আমাদের আকিদা অনুসারে যেকোনো ভূমি ইসলামি সরকার দ্বারা শাসিত হলে (স্বল্প সময়ের জন্য হলেও), সেটা ইসলামি ভূমিতে পরিণত হবে। আর ফিলিস্তিন ১৬ হিজরি তথা ইসলামি শাসনব্যবস্থার শুরুলগ্ন থেকে অর্থাৎ চৌদ্দশ বছর ধরে ইসলামি সরকার দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে এবং কেয়ামত অবধি আমাদের শরিয়ত এবং আকিদায় ইসলামি ভূমি হিসাবেই থাকবে। যদিও এর মাঝে ইংরেজ, ফরাসি, ইহুদি কিংবা পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্র দ্বারা এ ভূখণ্ড শাসিত হয়। আর যদি মুসলমানদের হাত থেকে কোনো দিন ফিলিস্তিন ছিনিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে মুসলমানদের ওপর তা পুনরুদ্ধার করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। এটিই আমাদের আকিদা, এটিই আমাদের শরিয়ত । আল্লাহ তাআলার বিধান পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ নেই ।

ইসলামি ফিকহে বলা হয়েছে যে, কোনো ইসলামি রাষ্ট্রের একজন নারীও যদি বন্দি হয়, তখন সেই রাষ্ট্রের অধিবাসীদের ওপর তাকে মুক্ত করা ফরজ হয়ে যায়। সেই রাষ্ট্র যদি সক্ষম না হয়, তখন পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহের ওপর তাকে মুক্ত করা আবশ্যক হয়। তারাও যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে পর্যায়ক্রমে তাদের নিকটতম রাষ্ট্রসমূহ, এমনকি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ওপরও প্রয়োজনে সেই নারীকে মুক্ত করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এটা কেবল একজন নারী যদি বন্দি হয়, সেই ব্যাপারে ইসলামের বিধান। ফিকহশাস্ত্রের গ্রন্থসমূহে এটি রয়েছে এবং উম্মাহর সকল আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত।

ইসলামি "সময়ের পদরেখায়" ইতিহাসে এ ব্যাপারে কোনো ভিন্নমত পাওয়া যায় না। তাহলে একটি ইসলামিরাষ্ট্রের সকল জনগণই যদি আক্রান্ত হয়, তাদের বাস্তুভিটা ধ্বংস করা হয়, তাদের সহায়সম্পদ জব্দ করা হয়, এক-দুই বছর নয় বরং দীর্ঘ সময় ধরে; তাহলে তাদের ব্যাপারে ইসলামি শরিয়তের কী বিধান হতে পারে?! সকল মুসলমানকে এ ব্যাপারটি নিয়ে ভাবতে হবে।

এটি দ্বীনের একটি অংশ। মুসলমানরা যদি ফিলিস্তিনের ভূমি কিংবা যেকোনো অধিকৃত ভূমি যেমন ইরাক, চেচনিয়া, কাশ্মীর প্রভৃতির ক্ষেত্রে এমন অবহেলা প্রদর্শন করে, তাহলে এই অংশটি বিনষ্ট হয়ে যাবে। উপরন্তু ফিলিস্তিন সমস্যাটি একটি বিশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। ফিলিস্তিন কেবল একটি ইসলামি অধিকৃত ভূমি নয় যে, এ কারণে মুসলমানদের ওপর তা মুক্ত করা আবশ্যক; বরং এই ভূমি পুনরুদ্ধার করা এরচেয়েও বড় কারণে অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। তা হলো, আল্লাহ তাআলা এই ভূমিতে এমন বহু উপাদান রেখেছেন, যা তাকে পুণ্যভূমিতে পরিণত করেছে। আর তা ছোট-বড়, নারী পুরুষ, নিকটবর্তী দূরবর্তী আরব-অনারব কেউই অস্বীকার করে না। সবশ্রেণির মুসলমানই বিশ্বাস করে যে, ফিলিস্তিনভূমি একটি পুণ্যভূমি।

আমরা বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করব যে, ফিলিস্তিন একটি পুণ্যভূমি। এটি মুসলমানদের প্রথম কেবলা। এ ভূখণ্ডে মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ 'মসজিদে আকসা' অবস্থিত। এটি সে তিন মসজিদের একটি যার দিকে একমাত্র সওয়াবের উদ্দেশ্যে সফর করা বৈধ: মসজিদে হারাম, মসজিদে নববি এবং মসজিদে আকসা। কুরআনের একাধিক আয়াতের মাধ্যমে এ ভূমির পুণ্যতা প্রমাণিত। আমরা ফিলিস্তিনের ইতিহাস পর্যালোচনার মাঝে বহু আয়াত পড়ব, যা প্রমাণ করে যে, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে এটি এক বরকতময় ভূমি। সাহাবিগণের বসবাসের ভূমি। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ও অসংখ্য ভয়ংকর যুদ্ধস্নাত ভূমি।

আল্লাহ তাআলা ফিলিস্তিনবাসীর মধ্যে কেয়ামত পর্যন্ত বরকতের ফয়সালা

করে রেখেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের একটি দল সর্বদাই দ্বীনের ওপর অবিচল থাকবে। শত্রুদের ওপর বিজয়ী থাকবে। তাদের বিরোধীরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ তাআলার নির্দেশ (তথা কেয়ামত) আসা পর্যন্ত তারা এর ওপর অটল থাকবে। সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসুল, তারা কোথায় থাকবে? তিনি বলেন, বায়তুল মুকাদ্দাস এবং তার আশপাশে। (১)

ইসরাইলই প্রথম রাষ্ট্র, যে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভের পূর্ব থেকেই বিভিন্ন ইসলামিরাষ্ট্র যেমন : উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, আজারবাইজান-সহ আরও অনেক রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা চালায়। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরপর ইসরাইলই প্রথম এ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে মিত্রচুক্তিতে আবদ্ধ হয়, যেন তারা ইসলামিবিশ্বের অভ্যন্তরে গিয়ে আঘাত করতে পারে। এর পাশাপাশি ইহুদিদের ফিলিস্তিন অধিকৃতির কথাও যুক্ত করতে চাই। কারণ, এটি আমেরিকার ইরাক কিংবা আফগানিস্তান এবং রাশিয়ার চেচনিয়া দখল থেকেও অধিক মারাত্মক। তবে আমি অন্যান্য দখলদারত্বকে ছোট করে দেখছি না। বরং ফিলিস্তিন অধিকৃতির রাজনীতি ইসলামিবিশ্বে অন্যান্য অধিকৃতি থেকে ভিন্নরকম।

কারণ, ইহুদিদের অধিকৃতি ছিল বসতি ও স্থায়ী নিবাসের উদ্দেশ্যে। জনগণকে গ্রাস করে নেওয়া, কোনো বাহিনী দিয়ে জবরদখল করা নয়। তারা অন্যান্য দেশের মতো বাহিনী নিয়ে অপর দেশের সম্পদ লুট করে পুনরায় ফিরে যাওয়ার নয়। বরং তারা তাদের সন্তানাদি, পরিবার-পরিজন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পেশা-সহ ফিলিস্তিনের কোনো শহরে চলে আসে এবং বসতি স্থাপন করে। শুধু তাই নয়, বরং নগরীর মূল বাসিন্দাদের তারা বের করে দেয়। আর এজন্যই ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাবর্তনকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। কারণ, ফিলিস্তিনভূমিতে ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাবর্তন হলে জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। ইহুদিদের তুলনায় ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। আর সেটা ইহুদি-রাজনীতি বিরুদ্ধ।

পৃথিবীতে যখনই এ নীতির বাস্তবায়ন হয়েছে, তখনই এমন বড় বড় বিপর্যয় ঘটেছে, যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আমেরিকা কীভাবে এত শান্তি শৃঙ্খলার সঙ্গে বসবাস করতে পারছে, অথচ ইতিপূর্বে তারা এ ভূমিতে রেড ইন্ডিয়ানদের ক্রীতদাস ছিল। রেড ইন্ডিয়ানরা বসতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে শত শত বছর যাবৎ এ দেশে বসবাস করলেও মার্কিনরা দেশটি দখল করার পর সেখানকার মূল অধিবাসীদের হত্যা করে ফেলে। আর সময়ের পরিক্রমায়
১. আল-মুসনাদ লিল ইমাম আহমাদ, ২২৩২০

তাদের স্থানে ইউরোপ থেকে আসা লোকেরা জায়গা করে নেয়। আর এভাবেই সে অঞ্চল পরিণত হয় আমেরিকায়। একইভাবে আন্দালুস রূপান্তর হয় স্পেন এবং পর্তুগালে। তারপরই ইস্যুটির পরিসমাপ্তি ঘটে। ফিলিস্তিনের ব্যাপারেও আমাদের সেই আশঙ্কা হচ্ছে। তাই আমরা এখন ফিলিস্তিনের সমস্যাটি পর্যালোচনা করতে চাচ্ছি, যেন আমরা সকলেই এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি।

ফিলিস্তিন ইস্যুকে বেছে নেওয়ার কারণ হলো, আমরা এর মাধ্যমে মূলত পূর্ণ ইসলামি ইতিহাসও অধ্যয়ন করে নিতে পারব। পূর্বেই বলে এসেছি যে, ফিলিস্তিন ইস্যু ১৬ হিজরি থেকেই শুরু হয়েছে, যখন মুসলমানরা এ ভূমিতে প্রবেশ করেছিল এবং ইসলামের ঝান্ডা উড্ডীন করেছিল। মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি যুগে তথা নববি যুগ, খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগ এবং অন্যান্য ইসলামি সাম্রাজ্যের যুগে এ ভূমিতে মুসলমানদের পদচারণা ছিল। উমাইয়া খেলাফত, আব্বাসি খেলাফত, জেনগি সাম্রাজ্য, উসমানি সাম্রাজ্য, সেলজুকি সাম্রাজ্য, আইয়ুবি সালতানাত এবং মামলুক সালতানাত—সকলেরই ইতিহাস রয়েছে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে। তাই আমরা যখন ফিলিস্তিনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করব, তখন যেন সমগ্র ইসলামি ইতিহাসই মন্থন করে বেড়াব।

এর চেয়েও বড় বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আমাদের কেবল ইসলামি ইতিহাসই নয়; বরং মানবেতিহাসের সকল স্তর অতিক্রম করার সুযোগ হবে। ফিলিস্তিনের ইতিহাসের মাধ্যমে আমরা পারস্যের ইতিহাস জানব, অনুরূপ রোমান, গ্রিক, অ্যাসিরীয়, ব্যাবিলনীয় এবং ফেরাউনদের ইতিহাসও অবগত হব। জানব আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস। ফিলিস্তিনের ইতিহাস পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে আমরা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানির ইতিহাস জানব। পৃথিবীর সকল দেশেরই কোনো একসময় এই মহান পুণ্যভূমির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল।

ফিলিস্তিনভূমি ‘বরকতময়', আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে এ ঘোষণা দিয়েছেন। আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা এই ভূমিতে মুসলমানদের জন্য এত উচ্চ মর্যাদা প্রদান করেছেন; এটিকে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসরা ও মেরাজের স্থান, মুসলমানদের কেবলা এবং তৃতীয় হারাম বানিয়েছেন। এই ভূমিতে অবস্থিত মসজিদে আকসায় এক রাকাত নামাজের বিনিময়ে সাতশ রাকাত নামাজের পুণ্য দিয়েছেন। এসব কেন করেছেন? কারণ, আল্লাহ তাআলা জানেন, সমগ্র পৃথিবীবাসীই এই ছোট্ট ভূখণ্ডের দিকে___

লোলুপদৃষ্টি ফেলবে। মাত্র ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তন তার। কিন্তু পুরো পৃথিবীবাসীর নিকটেই অত্যন্ত মূল্যবান। এজন্যই আল্লাহ তাআলা মুমিনদের হৃদয়ে এই ভূখণ্ডের প্রতি ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছেন, যেন তারা যেকোনো বিদেশী আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে পারে।

বিকৃতি থেকে বাঁচাতেও ফিলিস্তিনের ইতিহাস আমাদের অধ্যয়ন করতে হবে। কারণ, ফিলিস্তিনের ইতিহাস বিকৃতি সাধারণ কোনো বিষয় নয় ।

ইহুদিদের রয়েছে শক্তিশালী প্রচারমাধ্যম। এর মাধ্যমে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের নিকট ফিলিস্তিনের ইতিহাসের চরম বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমাদের জানা থাকা আবশ্যক যে, সব ক্ষেত্রেই ইহুদিদের শক্তিশালী প্রচারমাধ্যম রয়েছে, উদাহরণত সংবাদ এজেন্সিগুলো। আমি যদি পাঠকদের জিজ্ঞাসা করি যে, বিশ্বের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ আন্তর্জাতিক সংবাদ এজেন্সি কোনটি? সকলেই বলবেন, রয়টার্স (Reuters)। এটি ইহুদি গণমাধ্যম। এ ছাড়াও এসোসিয়েটেড প্রেস (Associated Press ) এবং ফরাসি হাভেস (Havas) ইহুদি মিডিয়া। এমনইভাবে আমেরিকার প্রসিদ্ধ দৈনিক দ্যা টাইম্স (The Times ), নিউজউইক (Newsweek), ওয়াশিংটন পোস্ট (Washington Post), বিনোদন সাময়িকী স্টার ম্যাগাজিন (Star magazine)-এর সর্ব বৃহৎ উদ্যোক্তা হলো ইহুদি। বিখ্যাত বিনোদন সাময়িকী ভ্যারাইটি-ও (Variety) ইহুদি মালিকানাধীন। নির্বাচনের সময় আগামীর রাষ্ট্রনায়কদের ব্যাপারে অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং চলচ্চিত্রশিল্পীদের মতামত প্রকাশ করে থাকে এ সাময়িকীটি। মার্কিন জনগণের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সাময়িকীটি যদিও বিনোদনধর্মী, কিন্তু এটি আমেরিকার রাজনীতির ওপর সরাসরি প্রভাব সৃষ্টি করে।

ইংরেজি ম্যাগাজিন টাইমস ম্যাগাজিন-এর প্রায় সম্পূর্ণ স্বত্ত্বই ইহুদি রবার্ট মোদুর্খের। বিশ্বের বিখ্যাত টিভি চ্যানেল হলো CBS, ABC, CNN, NBC—এসব চ্যানেলের মধ্যেও ইহুদিদের বড় মালিকানা রয়েছে। কিছু টিভির সম্পূর্ণ মালিকানা ইহুদিদের (আর কিছুর আংশিক)। মার্কিন প্রকাশনা সংস্থার পঞ্চাশ শতাংশ ইহুদিদের মালিকানাধীন। ফিল্ম কোম্পানি যেমন : মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার (Metro Goldwyn Mayer), ফক্স (FOX), ওয়ার্নার ব্রস (Warner Bros); সবই ইহুদিদের। এসব কোম্পানি যে ফিল্মগুলো নির্মাণ করে সেগুলো পূর্ব-প্রাচ্যের মুসলিম-অমুসলিম-নির্বিশেষে

সবার বুদ্ধি ও চিন্তা-চেতনায় বেশ বড়সড় প্রভাব ফেলে। ইহুদি, মুসলমান, বরং মানব জাতির ইতিহাসের মধ্যে যেমন ইচ্ছা বিকৃতি সাধন করতে পারে। এমনকি শিশুতোষ প্রোগ্রাম ও ফিল্ম নির্মাতা ডিজনি (Disney)-ও এ কাজগুলো করে থাকে। আমি একবার এমন একটি মেলায় গেলাম, যেখানে বৈজ্ঞানিকভাবে পৃথিবীর পরিচিতি তুলে ধরে। সেখানে দেখলাম, তারা তুলে ধরছে কারা প্রথম বিজ্ঞানের প্রসার করেছে, কোত্থেকে বিজ্ঞানের ধারা শুরু হয়েছে ইত্যাদি! এরপর যখন ইসলামি যুগে বিজ্ঞানচর্চার আলোচনা আসে, তখন যেহেতু বিজ্ঞানচর্চায় মুসলমানদের অস্বীকার করার জো নেই, সকলেই জানে যে, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ হিজরি শতাব্দী মোতাবেক দশম খ্রিষ্ট শতাব্দী থেকে থেকে ষোড়শ খ্রিষ্ট শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানরাই বিজ্ঞানের ঝান্ডাবাহী ছিল, তাই ডিজনিও এই বাস্তবতা গোপন করতে সক্ষম হয়নি। ফলে তারা এটি স্বীকার করে নেয় যে, মুসলমানরাই বিজ্ঞানের ঝান্ডা উত্তোলন করেছে। কিন্তু তারা মুসলমানদের সঙ্গে 'ইহুদি' শব্দটিও জুড়ে দেয় এবং ইহুদিদের কিছু চিত্র প্রতিস্থাপন করে, যদ্বারা মনে হচ্ছিল যে, ইহুদিরাও এই ছয় শতাব্দীজুড়ে বিজ্ঞানের মশাল বহন করেছে।

ইহুদিরা এই ছয় শতাব্দী কোথায় ছিল? হয়তো এ সময় কোনো একজন ইহুদি চিকিৎসক অথবা বিজ্ঞানি কিংবা ভূগোলবিদের কথা শুনতে পারেন। অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্যে পাবেন এমন হাজারো ব্যক্তি। এভাবেই ছয়শ বছর যাবৎ বিজ্ঞানের মশালবাহীদের মধ্যে মুসলমানদের পাশাপাশি ইহুদিদের প্রতিস্থাপন করে ইতিহাসের বিকৃতি সাধন করা হচ্ছে। আর শিশুরা তা দেখছে। মুসলিম-অমুসলিম প্রাপ্তবয়স্করাও তা দেখছেন। সুস্পষ্টভাবে ইতিহাস বিকৃত করছে, আর পুরো পৃথিবী কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়া তা প্রত্যক্ষ করছে। এ কারণেই আমাদের জন্য ফিলিস্তিনের ইতিহাস বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে অধ্যয়ন করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। ফিলিস্তিনের ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে যেসব ধুম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে, তা আমরা এই গ্রন্থে উল্লেখ করব। বিশেষত, আমরা ইহুদিদের এ দাবি 'ফিলিস্তিনভূমিতে আমরাই অগ্রাধিকার পাওয়ার উপযুক্ত'—সম্পর্কে জানব। তাওরাতের যে প্রমাণাদির ভিত্তিতে তারা এই বক্তব্য প্রদান করে, সে সম্পর্কেও আমরা অবহিত হব। তাওরাতের মূলপাঠ কিছু বিকৃত, কিছু সঠিক। তারা তাওরাতের যেসব বক্তব্য উল্লেখ করে থাকে, তার খণ্ডন বহু পূর্বেই সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু মানুষের সামনে তা তুলে ধরার মতো কোনো প্রচারমাধ্যম কি আছে?! তারা পৃথিবীর বুকে তাদের প্রচারমাধ্যমে যে 'হায়কাল'-এর কথা বলে বেড়ায়, তার কি আদৌ কোনো বাস্তবতা আছে? মুসলমানরা কি তাদের এসব বিকৃতির জবাব দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে?

সাম্প্রতিক সংকট নিয়েও তারা বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছে। ফলে কিছু মুসলমান ধারণা করে যে, ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূমি বিক্রি করে দিয়েছে। এটা কি সত্যি নাকি ইহুদিদের প্রোপাগান্ডা? ইহুদিদের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞ ও বর্ণবাদের কোনো বাস্তবতা আছে কি?! যারাই ফিলিস্তিন ইস্যুতে সরব হয়েছেন যেমন, ফরাসি মুসলিম দার্শনিক ও চিন্তাবিদ, জায়নবাদের কট্টরবিরোধী, লন্ডনের বিশিষ্ট ব্যক্তি রোজার গারোডি কিংবা যার বক্তব্যেই প্রকাশ পায় যে, তিনি ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলমানদের পক্ষপাতিত্ব করছেন; তারই চরিত্রহনন করা হয়। সুতরাং মুসলমানদের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট এবং অকাট্য প্রমাণ পেশ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ লক্ষ্যেই আমরা বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি উপস্থাপন করছি। ফিলিস্তিন ইতিহাসের পেছনে বড় বড় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য লুক্কায়িত রয়েছে।

—ড. রাগিব সারজানি কায়রো, মিশর




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ