বই:তোত্তোচান (জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি)
লেখক: তেৎসুকো কুরোয়ানাগি
অনুবাদ: চৈতী রহমান
প্রকাশক: দুন্দুভি
মুদ্রিত মূল্য: ২৫০/=
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৫৫
তোত্তোচান এক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকতে পারে না। সারাক্ষণ ছটফট করতে থাকে। এত এত কৌতূহল আর প্রশ্ন খেলা করে তার মনে। কখনো হতে চায় ট্রেনের টিকিট বিক্রেতা, কখনো গুপ্তচর আবার কখনো ব্যালে ডান্সার। ক্লাসের মাঝেও ছুটে যায় জানালার ধারে, বাজনাদারদের বাজনা শুনতে। ডেস্কের ডালা বারবার খুলে আর বন্ধ করে শিক্ষককে অস্থির করে তোলে। কোনোভাবেই তাকে শান্ত করা যায় না। শেষমেশ স্কুল থেকেই বহিষ্কার করা হয় তাকে।
তোত্তোচানের নামটা আসলে তেৎসুকো। বাচ্চাদের নামের শেষে চান যোগ করে ডাকা হয়। সে হিসেবে তেৎসুকোচান। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটি নিজের নাম বললে সেটা হয়ে যায় তোত্তোচান। তাকে যে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে মা একথা বলে তাকে কষ্ট দিতে চান না। বলা হয় নতুন একটা স্কুলে ভর্তি করানো হবে তাকে। নতুন স্কুলে যাবার পথে সারাটা পথ তার উত্তেজনায় কাটল। ওদিকে মা উদ্বিগ্ন। তার এই চঞ্চল বাচ্চাটাকে ভর্তি নেবে তো?
তোমায়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মশাই তোত্তোচানের সাথে একা কথা বলতে চাইলেন। এরপর চারঘন্টা ধরে এক নাগাড়ে কথা বলে গেল সে। তিনি একবারও বিরক্ত হননি। মনযোগ দিয়ে শুনে গেলেন সব। একসময় তার কথা ফুরিয়ে গেল। বলার মত আর কিছু খুঁজে পেল না সে। এটা ছিল তার ক্ষুদ্র জীবনের এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। তার বকবক শুনে সবাই এতদিন তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে এসেছে। আজই প্রথম সে মনের সব কথা খুলে বলতে পেরেছে। প্রধান শিক্ষক মশাইও খুশি হলেন প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এমন একটি বাচ্চা পেয়ে। এরপর সে হয়ে গেল তোমায়ে স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী।
স্কুলটা ঠিক অন্য দশটা স্কুলের মত ছিল না। বাচ্চাদের ক্লাসরুমগুলো ছিল পুরোনো রেলগাড়ির কামরা। যেন ক্লাসে নয় ভ্রমণে যায় বাচ্চারা। আর তাদের ক্লাসেও ধরা-বাঁধা কোনো নিয়ম ছিল না। ফলে দেখা যেত একই ক্লাসে কেউ ছবি আঁকছে, কেউ পড়ছে বা লিখছে আবার কেউ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যস্ত। নতুন স্কুলে যাওয়ার জন্য এখন আর তোত্তোচানকে জোর করতে হয় না। বরং সে ছটফট করতে থাকে কখন স্কুলে যাবে?
স্কুলের টিফিনের সময়টাও ছিল দারুণ। টিফিনের সময় তাদের আনতে হত সমুদ্রের কিছু আর পাহাড়ের কিছু। সে এক দেখার মত দৃশ্য। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার খেলাগুলো হত অদ্ভূত আর তার পুরষ্কারগুলো হত আরও কিম্ভূত। বনভোজন, সাঁতার, চাষাবাদ, মন্দিরভ্রমণ আর নিত্যনতুন আবিষ্কারে মেতে থাকত বাচ্চারা। কাউকে কোনো কিছু জোর করে শেখাতে হত না। আদব-কায়দা বা পড়াশোনা হয়ে যেত এই আনন্দের মাঝেই। যদিও এধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক অভিভাবকের আস্থা ছিল না। তবুও প্রধান শিক্ষক মশাইয়ের দু'চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল বাচ্চাদের নিয়ে।
তোমায়ে স্কুলে সাধারণ বাচ্চাদের পাশাপাশি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বাচ্চারাও পড়ত। তবে তাদের কখনও আলাদা চোখে দেখা হত না। আর তোত্তোচানের মায়া ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রধান শিক্ষক মশাই সবসময় বলতেন তোত্তোচান খুবই ভালো মেয়ে। আর তোত্তোচানও একথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত।
এদিকে শিশুরা যখন বেড়ে উঠছে মনের আনন্দে, ওদিকে তখন চলছে বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা। স্বপ্নের তোমায়ে স্কুল আর তোত্তাচানের গল্পটা কি তবে অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে?
বইটি যখন পড়া শুরু করলাম বারবার নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। বাচ্চারা কত কি কল্পনা করতে পারে সে সম্পর্কে বড়দের কোনো ধারণাই নেই। বাচ্চারাও বোঝে এবং নিজের মত করে ভাবতে পছন্দ করে। এই সহজ সত্যিটা বড় মানুষেরা বুঝতে চায় না। প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর একটা বাচ্চাকে জোর করে ভদ্র বানানোর চেষ্টা করা হয়। ফলে দেখা যায় কয়েক বছরের মধ্যে সে একরকম রোবট হয়ে যায়।
বাচ্চাদের কখনও জোর করে কিছু শেখানো যায় না। অনুকরণ করতে তারা বেশি ভালোবাসে। তোত্তোচান বারবার আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। যে জিনিস তাকে হাজার বলেও শেখানো যায় নি সেটা সে নিজেই একসময় শিখে যায় শুধুমাত্র একটু আদর আর বুঝিয়ে বলার কারণে। আগে সে হাজার রকম বায়না করলেও এখন বোঝে তাকে আসলে ঠিক কিভাবে ব্যবহার করতে হবে। সারাদিন প্রজাপতির মত উড়ে বেড়ায়। অহেতুক কৌতুহল দেখাতে গিয়ে বিপদে পড়ে আবার নিজেই নিজেকে শাসন করে। ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, আনন্দ, শোক সবকিছুই উপলব্ধি করতে পারে ছোট্ট মেয়েটা। কে বলবে যে এই সেই মেয়ে, যাকে অবাধ্য বাচ্চা বলে একসময় একটা স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল?
যেখানে সবাই ভাবে বাচ্চাদের পড়াশোনা হচ্ছে না সেখানে বাচ্চারা পেয়ে যায় জীবনের সেরা শিক্ষাটা। আর এই নির্মল আনন্দের মুহূর্তগুলো বয়ে বেড়ায় সারাজীবন। সংকীর্ণতা তাদের মনে ঠাঁই নিতে পারে না। বহুবছর পরও অতীতের মধুর স্মৃতি তাদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তোলে।
বইটিতে বর্ণিত স্কুলের অস্তিত্ব সত্যিই ছিল। এমনকি এর চরিত্ররাও বাস্তব। প্রকাশিত হবার পর রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছে। অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জাপানের পাঠ্যবইয়েও। বাচ্চারাও সাদরে গ্রহণ করেছে কালো অক্ষরের স্বপ্নগুলোকে।
তোত্তোচানের কর্মকান্ডে বড্ড স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলাম। আমি মনে করি বইটি একবার হলেও পড়ে দেখা উচিত। এ তো বই নয় যেন একমুঠো স্বপ্ন!
অনুবাদ ভালোই ছিল। তবে আরেকটু সুন্দর হতে পারত। পেপারব্যাক বই হিসেবে চমৎকার। প্রচ্ছদও সুন্দর। নিজের ছোটবেলায় একবার ডুব দিয়ে আসতে চাইলে আর দেরী না করে উঠে পড়ুন তোত্তোচানের স্বপ্নের রেলগাড়িতে।
#হ্যাপি_রিডিং।☺
তোত্তোচান
তেৎসুকো কুরোয়ানাগি, চৈতী রহমান (অনুবাদ)
বইমেলায় ঘোরার সময় দ্যু'র স্টল হঠাৎ করেই চোখে পড়েছিল। 'মণির পাহাড়' নিচ্ছিলাম, ডায়না আপু এই বইটা দেখিয়ে বলল, এটা খুব প্রিয় বই। চিন্তা ভাবনা না করেই নিয়ে নিয়েছিলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তগুলোর একটা ছিল।
তোত্তোচান লেখকের ছোট্টবেলার এক স্কুলের স্মৃতি। সেখানকার ক্লাসরুম ছিল পুরনো রেলগাড়ির কামরা। ক্লাসের কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না। ক্ষেত, মাঠে ঘুরে ঘুরে প্রকৃতি নিয়ে শিখত শিশুরা। হলঘরে তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্পিং হতো। শিশুদের বেড়ে ওঠায়, আনন্দে, খেলাধুলায় কোনোরকম হস্তক্ষেপ করা হতো না।
এরকম দামী বই মনে হয় আমি খুব কম পড়েছি। তোত্তোচানের প্রধান শিক্ষক আর মা যেমন, ঠিক তেমনটাই হওয়া খুব দরকার। বলে বোঝাতে পারব না ঠিক। মনে হচ্ছে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু পড়লাম। সবসময় মনে গেঁথে রাখব।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....