আকাশে অনেক মুখ - কেন পড়বেন? > লেখক বাদল সৈয়দ | Akashe Onek Mukh

  • বই:- আকাশে অনেক মুখ
  • লেখক:- বাদল সৈয়দ
  • জনরা:- মুক্তিযুদ্ধের গল্প সংকলন 
  • প্রকাশনী:- সুবর্ণ
  • ব্যক্তিগত রেটিং:-[৯/১০]
  • Review Credit : Himadri Sharma

ঈদের ছুটিতে বাড়িতে অবস্থান করছি। ঈদের দিন সকালে কড়া লিকারে গলা ভেজানো শেষেই বাদল স্যারের নতুন বই ‘আকাশে অনেক মুখ’ নিয়ে বসি। লক্ষ্য ছিল বিশেষ এই দিনে টেলিভিশনে কিংবা মোবাইলে মুখ বুজে না থেকে পুরো বইটি পড়ে শেষ করব। লক্ষ্য পূরণ শেষে নিজেকে চুপিসারে অভিনন্দন জানাতে এতটুকুও বিলম্ব হয়নি আমার! যাকগে এইবারে আসি বইয়ের প্রসঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধের গল্প দিয়ে মোড়ানো বাদল স্যারের নতুন বই- আকাশে অনেক মুখ। প্রথমেই দৃষ্টি কাড়ে বইয়ের আকর্ষণীয় প্রচ্ছদটি! চমৎকার হয়েছে প্রচ্ছদখানা। বইয়ের ভেতরের প্রোডাকশনও বেশ ভালো হয়েছে। বইটি হাতে নিলে এর পৃষ্ঠাজুড়ে যেন সুখের পরশ অনুভূত হয়! বইয়ে সর্বমোট ১৩টি গল্পের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি গল্পে মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। প্রতিটি গল্পই শরীরে শিহরণ জাগিয়ে তোলার মতোন! অস্পষ্ট ছবিতে মুক্তিযুদ্ধকে অবলোকন করার চেষ্টায় মত্ত ছিলাম খানিকক্ষণ। গল্পগুলো পড়ে একদিকে যেমন আপ্লূত হয়েছি, কষ্ট পেয়েছি, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে, ঠিক তেমনি গল্পগুলো একজন বাঙালি হিসেবে আমাকে গর্বিত করেছে বারংবার। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এদেশের আপামর জনগোষ্ঠীর ত্যাগ-তিতিক্ষা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছি পুরোটা সময়জুড়ে। সহজ ও সাবলীল আঙ্গিকে লেখক ‘বাদল সৈয়দ’ গল্পগুলোকে উপস্থাপন করেছেন ১৬৭ পৃষ্ঠার এক মলাটের অতলে।

আকাশে অনেক মুখ বইয়ের প্রায় সবকটি গল্প আমার কাছে উপভোগ্য ছিল। তবুও আলাদাভাবে দু'তিনটে গল্প আমাকে খুব কাছে টেনেছে। সেগুলো নিয়ে আপনাদের সঙ্গে হালকা আলোকপাত করতে চাই। শুরু করছি তবে।

‘আকাশে অনেক মুখ’ শিরোনামের গল্পটি দিয়ে বইয়ের যাত্রা শুরু। গল্পে লেখকের নিকট-আত্নীয়ের দু'বছরের ফুটফুটে বাচ্চাটা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি রয়েছে। ডাক্তাররা প্রায় সব আশাই ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাচ্চার বাবা-মা এখনই হার মানতে নারাজ। কে-ই বা না চাইবে তাঁদের বাচ্চা বেঁচে থাকুক এই ধরাধামে! লেখকও সেসময় হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন৷ সেসময় হাসপাতালে লেখকের সঙ্গে মধ্য বয়স্ক এক ভদ্রলোকের দেখা হয়। ভদ্রলোকটি লেখককে জানান, বাচ্চাটিকে ঢাকা নিয়ে গেলে সুস্থ হয়ে যাবে। বিষয়টি লেখককে খুবই বিরক্ত করে তোলে। শেষমেশ বাবা-মার ইচ্ছেয় বাচ্চাকে নিয়ে ঢাকা যাওয়া হল। মিরাকল সেখানেই ঘটল! বাচ্চাকে ফেরানো সম্ভব হল। তার কিছুদিন পর বাচ্চাটি পুরোপুরি সুস্থ হয়েই বাসায় ফিরল। হঠাৎ একদিন লেখকের সেই ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ল, যিনি বলেছিলেন, বাচ্চাটিকে ঢাকা নিয়ে গেলে বাঁচানো সম্ভব হবে। লেখক হাসপাতাল থেকে ওই ভদ্রলোকের ঠিকানা সংগ্রহ করে পৌঁছে গেলেন তাঁর বাসায়। কথা বলতে বলতে তিনি জানতে পারেন, এই ভদ্রলোক নাকি মৃত্যুর গন্ধ পান! বাচ্চাটির গা থেকে তিনি নাকি এই গন্ধ পাননি, তাই ঢাকা নিয়ে যেতে বলেছেন। একাত্তর সালে ভদ্রলোকের মা'কে যখন মিলিটারিরা দলবেঁধে ধর্ষণ করে, তখন মমতাময়ী মায়ের শরীর একদম নিস্তেজ হয়ে পড়ে। অসহায় ছেলে তখন পাশে বসা। চোখের সামনে মা'কে কষ্ট পেতে পেতে অনেক দূরের এক জগতে চলে যেতে দেখছে সে৷ ঠিক সেই মুহূর্তে সেই বাড়িতে অদ্ভুত এক সুগন্ধ ভেসে বেড়াতে থাকে। গন্ধটি যতখানি প্রগাঢ় হচ্ছে, মা ছেলেকে ছেড়ে তত দূরে হারিয়ে যাচ্ছেন। এক মায়ের নীরব আত্মদানই কি ছেলের মৃত্যুর গন্ধ পাওয়ার মূল কারণ??

সুবিমল বাবু। পেশায় একজন শিক্ষক। অক্সফোর্ডের ইতিহাসে অন্যতম সেরা এক পদার্থবিদ। সুযোগ্য মেধাবী ছাত্র আলমগীরকে তিনি পিতৃস্নেহে দেখতেন৷ স্কলারশিপে আলমগীরের ডাক আসে অক্সফোর্ড থেকে। কিন্তু এরই মাঝে পাকিস্তান সরকার বাঙালি ছাত্রদের সব ধরনের বৃত্তি প্রদান বন্ধ করে দেয়। এমনকি ভাতা প্রদানও স্থগিত করে দেয়। সমস্যাটা সমাধানে এগিয়ে আসেন শিক্ষক সুবিমল বাবু। যেভাবেই হোক ছাত্রকে অক্সফোর্ডে পাঠানোর বন্দোবস্ত করবেনই তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সহকারীরা সবাই নিরাপদ স্থানে চলে গেলেও আলমগীর স্যারকে রেখে কিছুতেই যেতে চায় না। কিন্তু স্যার আবার ক্যাম্পাস ছেড়ে যাবেন না। ‘মালাউনের বাচ্চা ঠিকই বিপদ দেখা মাত্র মাতৃভূমি ছেড়ে মা দূর্গার আঁচলের নিচে ঢুকার জন্য ইন্ডিয়া পালিয়েছে!’- এত বড় অপবাদ তিনি সইতে পারবেন না। এরই মাঝে আগরতলা থেকে আনিসুজ্জামান সাহেব এক চিঠির বদৌলতে সুবিমল বাবুকে ক্যাম্পাস ত্যাগের অনুরোধ জানান। কিন্তু সুবিমল বাবু তখনও নিজের নেয়া সিদ্ধান্তে অটল! অন্যদিকে ছাত্র আলমগীরকে ফুল স্কলারশিপ দিয়ে কেমব্রিজে পাঠানোর জন্য সেখানকার প্রফেসর ডেনিস সেবর নিকট একটি চিঠি লিখেন সুবিমল বাবু। অবশেষে তিনি সফল হলেন৷ কেমব্রিজ নিজস্ব ফান্ড থেকে আলমগীরকে পুরো স্কলারশিপ দিবে। এমন খবরে প্রচন্ড খুশি শিক্ষক সুবিমল বাবু। 
এক পর্যায়ে ছাত্র আলমগীরকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বাধ্য হন তিনি৷ দিবেন দিবেন করে ছাত্র আলমগীরকে কেমব্রিজের চিঠিটা আর দেখাতে পারলেন না তিনি। শেষমেশ ধরাই পড়লেন। একদিকে শিক্ষক সুবিমল বাবুর বড় আফসোস ছাত্রের সুখবরটি তাঁর পকেটে বহন করতে করতেই ধরা পড়ে গেলেন, অন্যদিকে একজন নামকরা পদার্থবিদকে ধরিয়ে দেবার জন্য পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কাঙ্ক্ষিত ছাড়পত্র (খুব নামকরা বিলেতি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি খরচে পড়ার ছাড়পত্র!) পেয়ে যায় তাঁরই সবচে কাছের এক শিক্ষার্থী!! আপনারা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে ঠাহর করতে পেরেছেন, কে সেই শিক্ষার্থী! সময়টা কত ভয়ংকর ছিল, তাই না? সালটা যে ১৯৭১!

‘লাল সাইকেল' গল্পটি যখন পড়ে শেষ করেছি, বাম চোখের কোণে গরম জল অনুভব করলাম। গল্পের শেষাংশে অনিতা সেনের এই কথাগুলো মনে পরলেই কান্না পায় আমার।
“.....অফিসার আমার থুতনি ধরে আদর নিয়ে বললেন, এনজয় ইয়োর রাইড, মাই চাইল্ড। আমার মুহূর্তে সব ভয় কেটে গেলো, মনে হলো এ মানুষটির ওপর বিশ্বাস রাখা যায়, খুব রাখা যায়। আমার প্রবল বিশ্বাস নিয়ে তিনি গাড়িতে উঠতেই তা চলতে শুরু করলো, তারপর অফিসারের হাত জানালা দিয়ে বের হয়ে এলো, মনে হলো তিনি আমাদের বিদায় জানাচ্ছেন। তার গাল ভর্তি হাসি, হাসতে হাসতে তার হাতে কী যেন বের হয়ে এলো, আর আমি দেখলাম মুহূর্তের মধ্যে আমার বাবার মাথা পাকা তরমুজের মত ফেটে গেছে, বেড়িয়ে এসেছে লাল রক্ত, হলুদ থকথকে মগজ। আমি প্রবল বিস্ময় নিয়ে অফিসারের দিকে তাকিয়ে আছি, তার গাড়ি ছুটছে, তিনি হাত নাড়ছেন, বিদায়ের হাত নাড়া। তারপরই আমার ‘অষ্টম এডোয়ার্ড’ দড়াম করে লাল সাইকেলের ওপর পড়লেন।”
নিজের কান্নাকে সংবরণ করতে পারিনি আমি। বোধহয় জীবনে কখনো কখনো নিজেকে নিজের ওপর ছেড়ে দিতে হয়, আটকাতে হয় না। ক্ষণিকের জন্য নিজের পুরো ভাবনাকে ঢেলে দিই লাল সাইকেলের ওপর!

মুক্তিযুদ্ধের গল্প, তাই হয়তো সবগুলো গল্প আমায় ভীষণ স্পর্শ করেছে। একটি দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে, পুরো একটা জনগোষ্ঠী কিভাবে নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে দেয়, নিজেদেরকে উৎসর্গ করে দেয়, সেটা ৭১'এ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্পগুলো পড়লে জানা সম্ভব। 

পড়তে হলে তো সেই গল্পগুলো কাউকে না কাউকে লিখতে হবে। তেমনই একটা কাজ দাঁড় করিয়েছেন আমার ভীষণ প্রিয়, শ্রদ্ধার মানুষ, স্যার বাদল সৈয়দ। বিশ্বাস করেন স্যার, গল্পগুলো পড়াকালীন বহুবার আমার শরীরে কাটা দিয়ে উঠেছে!
আপনারাও বইটি সংগ্রহ করুন। গল্পগুলো পড়ুন। ছড়িয়ে দিন গল্পগুলোকে। একজন বাঙালি হিসেবে আমরা যদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলোই না পড়ি, না জানি, তাহলে নিঃসন্দেহে সেটা আমাদের জীবনের সবচে বড় ব্যর্থতার একটি! ‘আকাশে অনেক মুখ’ বইটি সুখপাঠ্য হয়ে ধরা দিক সকলের নিকটে।

বইতে হাসি, বইতে বাঁচি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ