একজন মুসলিমের কেমন হওয়া উচিত?

মুসলিম হবে বন্দেগির আদর্শ নমুনা

জাগ্রত হৃদয়ের অধিকারী হবে

একজন মুসলিম পরিপূর্ণ মুমিন হওয়াই ইসলামের দাবি। আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাস হবে সুদৃঢ় এবং সম্পর্ক হবে গভীর। সে বিপদাপদে আল্লাহকে স্মরণ করবে এবং তার উপর ভরসা করবে। তার সাহায্যের আশা করবে। যাবতীয় উপায়-উপকরণ গ্রহণ এবং সবধরনের চেষ্টা ও শ্রম ব্যয় করার পরেও তার হৃদয় ও অন্তঃকরণ সবসময় আল্লাহর শক্তি ও সাহায্য অনুভব করবে।


একজন প্রকৃত মুসলিমের হৃদয় হবে সজাগ এবং দৃষ্টি হবে গভীর। সে আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে বৈচিত্র নিয়ে ফিকির করবে। সে জীব ও জগতের পরিচালনায় উপরওয়ালার একটি সূক্ষ্ম হাত রয়েছে বলে বিশ্বাস করবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অসীম কুদরতের নিদর্শন অনুভব করবে। এভাবেই তার ঈমান বাড়বে। এভাবেই সে আল্লাহর স্মরণে ডুবে যাবে এবং আল্লাহর প্রতি আরও নির্ভরশীল হয়ে ওঠবে।

ইরশাদ হয়েছে,
الذين يذكرون الله فيلما وقعودا وعلى جنوبهم ويتفكرون في خلق السماوات والأرض ربنا ما خلقت هذا باطلا سبحانك فقنا عذاب النّار ربنا إنك من

تدخل النار فقد أخريته وما للظالمين من أنصاره

অর্থ- ‘নিশ্চয় আসমান ও জমিন সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে, (তারা বলে) পরওয়ারদেগার, এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদেরকে তুমি দোযখের শাস্তি থেকে বাঁচাও।' সূরা আলে ইমরান: ১৯০-৯১

আল্লাহর হুকুমের অনুগত হবে একজন মুমিন তার সকল কাজেই আল্লাহর আনুগত্য করবে। ভক্তি ও স্থিরতা হবে তার ভূষণ। সে কখনো আল্লাহর সীমা অতিক্রম করবে না। প্রবৃত্তির বিরোধী হলেও সে আল্লাহর আদেশ মেনে চলবে। স্বভাববিরুদ্ধ হলেও সে হেদায়েতের পথে আগে বাড়বে। ছোট-বড় সব ক্ষেত্রেই সে আল্লাহর আদেশ ও তার রাসূলের সুন্নাতকে অনুসরণ করবে। সে ক্ষেত্রে তার কোনো দ্বিধা নেই, শর্ত নেই এবং নেই কোনো আপসও।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন
‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি, তার অন্তর আমি যা নিয়ে এসেছি (ইসলাম) তার পূর্ণ আনুগত্য না করে।”

আল্লাহ তায়ালা বলেন
فلا وربك لا يؤمنون حتى يحكموك فيما شجر بينهم ثم لا يجدوا في أنفسهم خرجا منا قضيت ويسلموا تسليما

অর্থ- ‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম! সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।' সূরা নিসা: ৬৫

ঈমান মানেই হলো, আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি আত্মসমর্পণ এবং তাদের নিঃশর্ত আনুগত্য। তাছাড়া কেউ মুমিন হতে পারে না। হতে পারে না একজন মুসলিমও। এভাবেই একজন প্রকৃত মুসলিমের জীবন থেকে দূর হয়ে যাবে আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্যতা এবং সত্যের পথ থেকে বিচ্যুতি। এভাবেই সুন্দর হয়ে ওঠবে ব্যক্তির জীবন ও তার পারিপার্শ্ব।

দায়িত্বের প্রতি সচেতন হবে
আল্লাহ ও তার রাসূলের হকে শৈথিল্যে যদি তার পরিবার জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সে জন্যে একজন মুমিনের জবাবদিহিতা রয়েছে। কেননা, সে পরিবারের দায়িত্বশীল।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন

كلكم راع وكلكم مسؤول عن رعيته

“তোমাদের প্রত্যেকেই অভিভাবক এবং প্রত্যেককেই তার অধীনস্তদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে।' -বুখারী ও মুসলিম

পরিবারের কারো অন্যায় ও অপরাধ দেখলেই একজন মুসলিমের এই দায়িত্বানুভূতি জেগে উঠবে। সে নিশ্চুপ বসে না থেকে বরং প্রতিকারের প্রতি মনোযোগী হবে। কারণ, এ দায়িত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে কেউ চুপ থাকতে পারে না। হ্যাঁ, দুর্বল মুমিন ও শিথিল ধার্মিকরাই কেবল এসব ক্ষেত্রে নিরব থাকতে পারে।

তাকদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে

একজন মুসলিম সর্বদা আল্লাহর ফায়সালা ও তাকদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিম্নোক্ত হাদীসটিই হবে তার জীবনের রূপরেখা।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন
—মুমিন বান্দার বিষয়টি আসলেই আশ্চর্যের। তার সকল ব্যাপারেই তার জন্য রয়েছে কল্যাণ ও বরকত। সুসময়ে সে তার রবের শুকরিয়া আদায় করে। এ শুকরিয়া তার জন্য আরও কল্যাণ বয়ে আনে। আর দুঃসময়ে সে ধৈর্যধারণ করে তার রবের সিদ্ধান্তের ওপর। এ সবরও তার জন্য কল্যাণ নিয়ে আসে।' -বুখারী

একজন মুসলিমের হৃদয়ে প্রোথিত থাকে তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস। তা ছাড়া এটি ঈমানেরও একটি রুকন বা স্তম্ভ। তার দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ সবই পূর্ব নির্ধারিত এবং তা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো পথই ছিল না, এ-কথা একজন মুমিন বিশ্বাস করে। তাই সে আল্লাহর ফায়সালা ও তাকদীরে সন্তুষ্ট থাকে এবং তার পক্ষ হতে অনেক সওয়াব ও প্রতিদান অর্জন করে। সবিশেষ আল্লাহর কাছে সে একজন অনুগত বান্দা হিসেবে গণ্য হতে থাকে।

এভাবেই তার সকল বিষয় কল্যাণকর হয়ে যায়। সে তার সুখের সময় জিহ্বাকে রাব্বুল আলামীনের যিকিরে নিবেদিত রাখে। দুঃখের সময়ে সে আল্লাহর ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকে এবং ধৈর্য ধারণ করে। ফলে দু'টোই তার জন্য বয়ে আনে অফুরন্ত কল্যাণ।

অনুতপ্ত হৃদয়ের অধিকারী হবে

কখনো যদি কোনো মুমিনের হৃদয় অসচেতনতায় স্খলিত হয়, অথবা সে যদি অদূরদর্শী কোনো হীন কাজে জড়িয়ে পড়ে, তখনই সে আল্লাহকে স্মরণ করবে, ইসতিগফার করবে এবং আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হবে। সে হবে তখন বিনয়ী, লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।

আল্লাহ তায়ালা বলেন
فإن الذين اتقوا إذا مسهم طائف من الشيطان تذكروا فإذا هم مبصرون

অর্থ- 'যাদের মনে ভয় রয়েছে, তাদের উপর শয়তানের আগমন ঘটার সাথে সাথেই তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনাশক্তি জাগ্রত হয়ে ওঠে।' -সূরা আরাফ: ২০১

যে হৃদয় আল্লাহর মুহাব্বত ও তাকওয়ায় পরিপূর্ণ, তাতে কখনো ঔদাস্য আসতে পারে না। আল্লাহর হুকুম ও তাঁর হেদায়াত থেকে বিমুখ অন্তরেই কেবল তা ক্ষমতা বিস্তার করে। প্রকৃত মুসলিমের অন্তঃকরণ তওবা ও ইসতিগফার এবং ক্ষমা ও নৈকট্যের জন্য সর্বদা উন্মুখ থাকে। তার হৃদয় আনুগত্য ও হেদায়াত এবং আশা ও সন্তুষ্টির স্নিগ্ধতা অনুভব করে।

আল্লাহর সন্তুষ্টিকামী হবে

একজন মুসলিম তার প্রতিটি কাজই হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য। সে তার প্রতিটি পদক্ষেপেই তার প্রভুর সন্তুষ্টি সন্ধান করবে। মানুষের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির প্রতি সে ভ্রুক্ষেপই করবে না; বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে গিয়ে কখনো তাকে মানুষের ক্রোধানলেও পড়তে পারে। সে সবকিছুকে উপেক্ষা করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিন্মোক্ত হাদিসের প্রতি উৎসর্গিত হবে। 

ইরশাদ হচ্ছে
'মানুষের অসন্তুষ্টি উপেক্ষা করে যে আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্বেষায় থাকে, আল্লাহ তাকে মানুষের মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে হেফাযত করেন। অর্থাৎ, তার সকল প্রয়োজন পূরণে আল্লাহ নিজেই যথেষ্ট হয়ে যান। আর আল্লাহকে রাগিয়ে যে মানুষের সন্তুষ্টি তালাশ করে, তার দায়িত্ব আল্লাহ মানুষের উপরই ছেড়ে দেন।' -তিরমিযী

মুমিন তার সকল কাজেই আল্লাহর সন্তুষ্টি যাচাই করবে। মনে রাখা চাই, আল্লাহর সন্তুষ্টির পাল্লা ভারি হলেই কেবল তিনি তা সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করবেন। অন্যথা তিনি তা থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হবেন। উল্লিখিত হাদীসটিই হবে একজন মুসলিমের পরিমাপযন্ত্র। এর মাধ্যমেই তার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হবে সত্য ও সারল্যের পথ। ফলে সে তার আচরণে হাস্যকর নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেবে না এবং তার কাজেকর্মে প্রকাশ পাবে না দ্বিমুখিতার আচরণ। সে কিছু ব্যাপারে আল্লাহর আনুগত্য আর কিছু ব্যাপারে নাফরমানি এবং কিছু জিনিসকে বৈধ আর কিছু জিনিসকে অবৈধ করতে পারবে না। কারণ, ইসলামে দ্বৈত আচরণের কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু তার বক্তব্য সুস্পষ্ট, তার বিষয়বস্তু সত্যায়িত এবং তার অকাট্যতা প্রমাণিত।

কিছু লোক বিনয়ের সাথে নামাজ পড়ে আবার বাজারে সুদি লেনদেনও করে। উপরন্তু ঘরে-বাইরে ও অফিস-আদালতে তারা দীনের ধার ধারে না। সন্তান সন্ততি ও পরিবার-পরিজনকে দীনের পথে পরিচালিত করে না। কেননা, তারা এ দীনের হাকিকতটুকুই বুঝতে পারেনি। মূলত ইসলাম মুসলিমকে একটি সুমহান লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করে। আর তা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তাই সে তার প্রতিটি বিষয়কেই এ ‘সন্তুষ্টি'র পাল্লায় মাপতে থাকে। এভাবেই সে হয়ে ওঠে প্রকৃত মুসলিম। কিন্তু এ থেকে তারা দূরে সরে আছে। তারা এখন নামে মাত্রই মুসলিম। আর বর্তমানের মুসলিমদের এটাই সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

ফারায়েজ ও নাওয়াফেলের প্রতি গুরুত্বশীল হবে

একজন প্রকৃত মুসলিম ইসলামের ফারায়েজ ও আরকানের প্রতি হবে শ্রদ্ধাশীল। সেগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ সুন্দরভাবে আদায় করবে। সে ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আলসেমি করবে না। করবে না কোনো ধরনের কমতিও।

নামাজের প্রতি যত্নবান হবে

সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সময়মতো আদায় করবে। কারণ, নামাজ হলো দীনের একটি স্তম্ভ। যে ঠিকমতো নামাজ আদায় করল, সে যেন দীন কায়েম করল। আর যে নামাজ ছেড়ে দিল, সে যেন দীনকে ধ্বংস করল। নামাজ হলো ইসলামের সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ আমল

হযরত ইবনে মাসউদ রা. বলেন- 'আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলাম, সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন, সময়মতো নামাজ আদায় করা। আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলাম, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ।' -বুখারী ও মুসলিম

📝কলমে : - লেখক : ড. মুহাম্মাদ আলী আল হাশেমী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ