আমাকে দেখলেই অশুদ্ধ উচ্চারণে সালাম দিত, বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য টানাটানি করত। সেটা না পেরে রাস্তায় দাঁড়িয়েই কথাবার্তা শুরু করত। এভাবে আজ একটু কাল একটু শুনতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম: সাধারণ গোছের লোক হলেও সে আমার জন্য ক্ষুদ্র পরিসরে একজন অসাধারণ কালের সাক্ষী। তার অভিজ্ঞতার ঝুলি এমন অন্ধকার জগতের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, যে জগতের পর্দা উঠানো আমার নিজের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। তাই আমি নিজেও কিছু সময় বের করলাম তার সাথে গল্প করার মধ্য দিয়ে কিছু জানতে, কিছু বুঝতে।
দাম্পত্য-জীবন-সংক্রান্ত একটি বইয়ের সূচনাকথা লিখতে গিয়ে তার নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটি অভিজ্ঞতা খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিলো। বর্ণনাকে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত ও একেবারেই প্রাসঙ্গিক পরিসরের মধ্যে রেখে যতটুকু বলা যায় তার চেয়ে এক চুলও বাইরে যাব না। কারণ, খারাপের প্রতি নাফসের সহজাত ঝোঁক থাকে এবং তার প্রতি সে সহজেই আকৃষ্ট হয়। তাই স্থান-কাল-পাত্রের উল্লেখ যথাসম্ভব ঊহ্য রাখব। এ কারণে কোথাও বর্ণনাকে খুব দ্রুতগতির মনে হতে পারে। এটা ইচ্ছাকৃত।
পার্শ্ববর্তী একটি দেশে থাকার সময় তিনি এক বার এক রাতের জন্য একটি হোটেলে একজন শয্যাসঙ্গিনীসহ রুম বুকিং দেন। চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে তিনি সন্ধ্যায় সেখানে যাবেন এবং পরদিন দুপুর পর্যন্ত তাকে নিয়ে থাকবেন।
যেদিন সেখানে তার রাত্রীযাপনের কথা সেদিন দুপুরে অচেনা নাম্বার থেকে একটি ফোন এল—‘কেমন আছ?’
প্রশ্নের ধরন এমন যেন কতকালের ঘনিষ্ঠ পরিচয়। বলল, ‘দুপুরে খেয়েছ?’
এরপর ফোনে যত রকম মনভোলানো কথা বলা যায় তার কোনোটাই বাদ গেল না। কথার ধরণে স্পষ্ট যে বাংলা তেমন ভালো জানে না; তবুও এর মধ্য দিয়ে সে নারী তার রুচিবোধ, পছন্দ-অপছন্দ, আগ্রহের বিষয় ইত্যাদির যতখানি সম্ভব খোঁজ নিয়ে নিল। নির্দিষ্ট দিনে তিনি যখন সন্ধ্যায় গিয়ে সেখানে উপস্থিত হন তখন তার নির্ধারিত চেক-ইন টাইমের চেয়ে ঘণ্টাখানেক দেরি হয়ে গেছে।
রিসিপশন থেকে জানতে পারলেন, তার সঙ্গিনী তার জন্য রুমে অপেক্ষা করছে। তিনি রুমে গিয়ে নক করলেন। সত্যিই নীল চোখের অসাধারণ রূপবতী এক নারী ভেতর থেকে দরজা খুলে তাকে কোমল অভিবাদন জানাল; বয়স বাইশ তেইশের মতো হবে। পরক্ষণেই তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখল এসে। বলল: ‘তোমাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে, নিশ্চয়ই বাইরে অনেক কাজ ছিল; তাই বোধ হয় দেরি হয়ে গেছে।’
সে তাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসাল, এক গ্লাস পানি এনে দিল। তারপর নিজ হাতে তার জুতো-মোজা খুলে দিল। শার্টের বোতাম খুলে দিল এবং বোতাম খোলার সময় বুকে একটা চুমুও এঁকে দিল।
মেয়েটি ফোনালাপে জেনে নিয়েছিল চৌধুরী কেমন পোশাক পছন্দ করে—ভারতীয় নারীদের মতো শাড়িতে, না কি ইউরোপিয়ানদের মতো জিন্স টি-শার্টে। সে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে নিজেকে তার পছন্দের সাজে সাজাতে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে চৌধুরী দেখল হাতে একটি তোয়ালে আর একটি টি-শার্ট নিয়ে মেয়েটি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। টি-টেবিলে হালকা নাস্তা, ফল আর কফি। বলল, সে কেবল তাকে আপ্যায়নের জন্য এই নাস্তা নিজ হাতে বানিয়েছে। তোয়ালে দিয়ে মাথা ভালো করে মুছে দিয়ে গেঞ্জিটি গায়ে পরিয়ে দিল।
এরপর নাস্তা খাইয়ে দিল নিজ হাতে আদরের সাথে যত্ন করে। ফলটা কাটল। একটি একটি করে টুকরো তাকে খাইয়ে দিল। চৌধুরী খেয়াল করে দেখল: প্রত্যেকটি টুকরো কেটে সে তাকে আগে এক কামড় খাইয়েছে, তারপর বাকি অংশটুকু নিজে খেয়েছে। সে নিজে কোনো টুকরোয় আগে কামড় দেয়নি। চা পান করে তারপর বিছানায় গেল। তার মাথাটা পরম যত্নে বুকে নিয়ে আগলে রাখল, তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল আলতো করে। আর তার সাথে চৌধুরীর আগ্রহের নানা বিষয় নিয়ে গল্প করতে শুরু করল। সযত্নে খেয়াল রাখল কোন বিষয়ে কথা বলতে সে উৎসাহবোধ করে, আনন্দ পায়। কোনো বিষয়ে তার সাথে দ্বিমত পোষণ করল না; তর্ক করল না; বরং সম্ভব হলে তার কথাকে সমর্থন করে কিছু যুক্ত করল। সে নিজে বেশি কথা বলেনি, বরং সে ছিল একজন আগ্রহী ও আদর্শ শ্রোতা: যার সাথে মন খুলে কথা বলা যায়, কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়।
তার বলা যেসব কথা চৌধুরী আমাকে শুনিয়েছিল তার মধ্যে আমার একটি কথা বিশেষভাবে মনে আছে। সে বলেছিল: ‘গাছ যেমন মানুষের ত্যাগ করা বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নেয় আর বিশুদ্ধ অক্সিজেন নির্গত করে মানুষকে সজীবতা দেয়, সৃষ্টি জগতে নারী হলো পুরুষের জন্য তেমনই। বাইরের কঠোর-কঠিন জগতে কাজ করতে করতে পুরুষ ক্লান্ত হয়ে যখন নারীর কাছে আসবে, তখন সে তার সকল ক্লান্তি-শ্রান্তি শুষে নিয়ে তাকে আবার সম্পূর্ণ সজীব ও সতেজ করে দেবে। তুমি আমার কাছে এক রাতের জন্যই হয়তো এসেছ; আর কখনো আসবে কি না জানি না; আমি চাই আজকের রাতের পূর্বে তোমার শরীর-মনে জমা সকল ক্লান্তি, মনের সকল শ্রান্তি আমি দূর করে তোমাকে সম্পূর্ণ সতেজ ও সজীব করে দেবো—এতেই আমার সার্থকতা।”
কথাগুলো আমার নিজের ভাষাতে লিখছি, তবেই মোটেই রং চড়িয়ে নয়। চৌধুরীর মনোহরণের জন্য সেই নারীর কৃত ক্রিয়াকলাপের বর্ণনা থেকে যতটুকু মনে আছে এবং তুলে ধরার যোগ্য আমি কেবল ততটুকুই লিখলাম। তবে এটা কেবল টিপ অব অ্যান আইসবার্গ।
আমি চৌধুরীর এই ঘটনার বর্ণনা শোনার পর কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওরা তো নিছক দেহপসারিণী, ওদের সম্পর্কে বরং উল্টো অনেক জনশ্রুতি রয়েছে; কিন্তু সে আপনার সাথে এমন মনোহরী আচরণ কেন করল?
চৌধুরী আমাকে বলল, তার এমন ধরনের অভিজ্ঞতা একবার নয়, একাধিকবার হয়েছে। এবং সে নিজেও এ বিষয়ে জানতে চেষ্টা করেছে। সে যা জানতে পেরেছে তার সারমর্ম হলো: দেহব্যবসার এই পেশার পেছনে বর্তমান দুনিয়ার অনেক বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ আছে। তারা পতিতাদেরকে নানা রকম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। তাদের এই ব্যবসায় তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হলো সুস্থ পরিবার-ব্যবস্থা ও সুখী দাম্পত্য-জীবন। কোনো মানুষ যদি সুখী দাম্পত্য-জীবন যাপন করে তা হলে তাকে তাদের খদ্দের বানানো যায় না সহজে। পক্ষান্তরে মানুষের দাম্পত্যজীবনে অশান্তি সৃষ্টি, কিংবা মানুষের চরিত্র নষ্ট করতে পারলে সহজেই তাদেরকে তাদের খদ্দের বানানো যায়। আর এ লক্ষ্যে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্য তাদের বিভিন্ন রকম প্রোগ্রাম রয়েছে।
আর পতিতাদেরকে এমন অনুগত ও মনোহরী স্ত্রীসুলভ আচরণের শিক্ষা দেওয়া হয় নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে; যেন স্ত্রীদের বিপরীতে একজন পুরুষ এদের কাছে এসেই অধিক প্রশান্তি লাভ করে। গবেষণা থেকে তাদের কাছে এটা প্রমাণিত হয়েছে, পুরুষকে কেবল শারীরিক সুখ দিয়ে সত্যিকার অর্থে আকৃষ্ট করা যায় না; এটা ক্ষণিকের। তাদেরকে নিয়মিত খদ্দের বানাতে হলে তাদের হৃদয়-মনে শান্তির পরশ দিয়ে তাদেরকে পাগল করে দিতে হবে। যেন তাদের মন ঘরে নয়, এখানেই পড়ে থাকে—যেন বার বার ফিরে আসে।
২.
শেষ জামানায় ঈমান অক্ষুণ্ণ রাখা হাতে জ্বলন্ত অঙ্গার নিয়ে থাকার মতো কেন হবে, তার আরও একটি কারণ যেন আমার কাছে উন্মোচিত হলো চৌধুরীর কথা শুনে।
দেহব্যবসার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। বর্তমান ও অতীতের অনেক জাতির মধ্যেই এই ঘৃণ্য কর্মের চর্চা ছিল এবং আছে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর এই কর্পোরেট কোম্পানিগুলো এতে যে-পেশাদারিত্ব যুক্ত করেছে তা অতীতের কোনো যুগে ছিল বলে আমার জানা নেই।
অর্থের বিনিময়ে ক্ষণিকের সঙ্গী হিসেবে আসা একজন কাস্টমারের সাথে কৃত আচরণকে দাম্পত্য-জীবনের স্থায়ী সঙ্গীর সাথে মেলানোর কোনো অবকাশ নেই। কারণ, দাম্পত্য সম্পর্ক ক্ষণিকের জন্য কারও শয্যাসঙ্গী হওয়া নয়—সেখানে সব সময় মুখে কৃত্রিম হাসি লাগিয়ে রাখা যায় না, ‘কাস্টমার ইজ অলওয়েজ রাইট’ বলা যায় না। এখানে স্বামী-স্ত্রীরা দীর্ঘ দিন একত্রে বসবাস করেন। বাস্তব জীবনের নানা রকম সুবিধা-অসুবিধা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, পরিবার-পারিবারিকতা, অর্থ-আর্থিকতা, সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, সমাজ-সামাজিকতা, নিত্যদিনের অভ্যাস-আচরণের বিচিত্র মিল-অমিলসহ নানারকম টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে সংসার-জীবন যাপন করেন তারা। প্রায় ভিন্ন প্রকৃতির দুজন মানুষকে এভাবে দীর্ঘ দিন মানিয়ে চলাটাই বরং এখানে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তাই দাম্পত্য-জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি সন্ধ্যা মধুময় না-ও হতে পারে।
তবে হ্যাঁ, বিপরীত প্রান্তে এটাও ধ্রুব সত্য, তিক্ততা যদি মধুরতার উপর জয়লাভ করে, ভালোলাগার উপর যদি বিরক্তি প্রাধান্য বিস্তার করে, মিলের চেয়ে অমিল যদি বেশি হয়, মতৈক্যের চেয়ে দ্বিমত যদি মাত্রা ছাড়ায়, আকর্ষণের চেয়ে অনীহা যদি প্রবল হয় তবে দাম্পত্য-সুখ বিদায় জানাবে; হয়তো ভাঙনও অনিবার্য হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে কেবল সন্তানের নোঙরই যদি দুজনকে এক ঘাটে বেঁধে রাখে, তাতে জীবন হয়ত কেটে যাবে, কিন্তু তাতে রং থাকবে না।
দাম্পত্যজীবনে যে এমন মনোহরী আচরণের প্রয়োজন নেই তা নয়, বরং আরও বেশি প্রয়োজন। এখানেও প্রয়োজন মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে একের সাথে অন্যের পার্থক্য ও চাহিদাকে সম্মানের সাথে মূল্যায়ন করা। এখানেও থাকতে হবে নিজের গল্প বলার চেয়ে অন্যের গল্প শোনার অধিক আগ্রহ। একে অন্যের ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা; কষ্ট ভুলে গিয়ে মুখে হাসির দ্যুতি ছড়ানো। দুঃখ-বেদনার উপর ধৈর্যের শক্ত প্রলেপ দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করা। অপ্রাপ্তির খাতা বন্ধ রেখে প্রাপ্তির ফর্দ প্রস্তুত করা। পরস্পরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো, পরস্পরকে সুখী ও খুশি করতে নিজের চাওয়ার উপর অন্যের চাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া। সর্বোপরি প্রয়োজন উভয়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দকে উভয়ের স্রষ্টা মহান আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করা।
দেহপসারিণীদের বিপরীতে আজ পরিবারকে ধরে রাখা এক বড় রকম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে—বিশেষত অমুসলিম এবং নামকাওয়াস্তে মুসলিম দম্পতিদের জন্য। মূল ভিত্তিগুলো নড়বড়ে হলেও একটা সময়ে ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও নৈতিকতার একটা মাত্রা ছিল। কিন্তু বস্তুবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভাটার টানে সে ঠুনকো নৈতিকতার পলি তলায় জমার আগেই ভেসে গেছে। একমাত্র প্র্যাকটিসিং মুসলিমদের স্ত্রী ছাড়া কমবেশি সকলকেই আজ যেন প্রশিক্ষিত ও পেশাদার বারাঙ্গনাদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে সংসার টিকিয়ে রাখতে।
তবে তার অর্থ এই নয় যে, প্র্যাক্টিসিং মুসলিমদের জন্য সংসার-সুখ বজায় রাখার জন্য কোনো নির্দেশনা প্রয়োজন নেই। মানুষ যতই ধার্মিক হোক না কেন, যে সমাজে সে বাস করে তার প্রভাব থেকে সে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে কখনোই পারবে না। সচেতন মুসলিমদের দাম্পত্যজীবনেও আজ অশান্তি তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে আজ এই জাতির পুরুষরা যেমন পৌরুষ হারিয়েছে—সাহসিকতা, ন্যায়পরায়ণতা ও দায়িত্বশীলতার সংমিশ্রণে সৃষ্ট চারিত্রিক দৃঢ়তা খুইয়েছে; তেমনি নারীরাও হারিয়েছে তাদের নারীসুলভ বিনম্রতা, আনুগত্যপরায়ণতা ও মমত্ববোধের সংমিশ্রণে তৈরি চারিত্রিক সুষমা।
স্বামী তার স্ত্রীদের প্রতি কতটা ন্যায়পরায়ণ, কতটা দায়িত্বশীল, কতটা যত্নবান হতে পারেন তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে আমাদের মুসলিমদের ইতিহাসে। স্বয়ং আল্লাহর নবি মুহাম্মাদ ﷺ তার স্ত্রীকে উটে চড়তে সাহায্য করার জন্য হাঁটু গেড়ে বসেছেন যেন স্ত্রী তার হাঁটুকে সিঁড়ির মতো ব্যবহার করে উটে আরোহণ করতে পারেন।
অন্যদিকে স্বামীর প্রশান্তির জন্য একজন স্ত্রী কতটা চিন্তিত হতে পারেন তা দেখতে পাই অসংখ্য নারী সাহাবির জীবনে। তেমনই একজন ছিলেন উম্মু সুলাইম (রা.)। তিনি তখন ছিলেন আবু ত্বালহা (রা.)-এর স্ত্রী। তাদের ছিল একটিমাত্র ছেলে। স্বাভাবিক কারণেই ছেলেটি ছিল পিতামাতার নয়নমণি। এক দিন হঠাৎ ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়ে, বেশ অসুস্থ। আবু ত্বালহা সাধারণত ফজরের সময় চলে যেতেন সালাতে, এরপর আল্লাহর রাসূলের সাথে থাকতেন মধ্যাহ্ন পর্যন্ত। এরপর এসে খেয়ে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার চলে যেতেন এবং আসতেন ‘ইশার সালাতের পর।
ছেলের অসুস্থতার সময়ে একদিন সকালে আবু ত্বালহা মাসজিদে কিংবা আল্লাহর রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করতে চলে যান এবং একবারে রাতে ফিরে আসেন; আবার সাথে কজন মেহমানও নিয়ে আসেন। তার অনুপস্থিতির এই সময়েই তার আদরের একমাত্র ছেলেটি মারা যায়। স্বামী আবু ত্বালহা ঘরে ফেরার আগে স্ত্রী উম্মু সুলাইম নিজের মৃত ছেলেকে এমনভাবে আবৃত করে তার ঘরে রেখে দেন, যেন সে আরামে ঘুমুচ্ছে। অন্য সকলকে অনুরোধ জানান, তিনি নিজে না বলা পর্যন্ত কেউ যেন তার স্বামীকে তার ছেলের মৃত্যুসংবাদ না জানায়।
রাতে আবু ত্বালহা এসে জিজ্ঞেস করেন, ‘ছেলেটা কেমন আছে আজ?’
তিনি বলেন, ‘অসুখ হওয়ার পর থেকে আজকের মতো শান্ত সে আর কোনো দিন ছিল না; সে এখন বেশ আরামেই আছে।’
উম্মু সুলাইম মেহমানদের জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থা করেন। মেহমানরা খাবার খেয়ে চলে গেলে আবু ত্বালহা বিছানায় যান। উম্মু সুলাইম গায়ে সুগন্ধি লাগান এবং স্বামীর জন্য এমন সুন্দরভাবে নিজেকে সাজান যেভাবে কখনো ইতিপূর্বে সাজেননি। তারপর তিনি বিছানায় যান এবং স্বামীর সাথে এক মধুময় রাত্রি যাপন করেন।
এরপর যখন আবু ত্বালহার দেহমনে পূর্ণ প্রশান্তি বিরাজিত, তখন তিনি স্বামী আবু ত্বালহাকে বলেন, ‘আচ্ছা কেউ যদি কারও কাছে কোনো আমানত রেখে তা আবার ফেরত চায়, তা হলে তার কি কোনো অধিকার আছে তা ফেরত না দেওয়ার?’
‘অবশ্যই না।’
তাহলে শুনুন, ‘মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ আপনাকে একটি পুত্রসন্তান দিয়েছিলেন আমানত হিসেবে; এখন তিনি তাঁর আমানত ফেরত নিয়ে গেছেন। অতএব ধৈর্যধারণের মাধ্যমে তাঁর কাছ থেকে এর প্রতিদান কামনা করুন।’
নিশিভোরে আবু ত্বালহা গোসল করে পবিত্র হয়ে আল্লাহর রাসূলের কাছে যান এবং তাঁর সাথে সালাত আদায় করেন। তারপর তিনি তাঁকে গতরাতের সব ঘটনা বলেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ সব শুনে এই দম্পতির জন্য দু‘আ করে বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের গতরাতের মধ্যে বারাকাহ দান করুন।”
সেই রাতেই উম্মু সুলাইম (রা.) আবার গর্ভবতী হয়ে পড়েন।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এমন দৃষ্টান্ত নিশ্চয়ই খুব বেখাপ্পা মনে হতে পারে আমাদের অনেকের কাছে। কিন্তু সুখের নিশ্চয়তা এখানেই। আমরা যতই চেষ্টা করি, যতই পরিশ্রম করি, আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত সুখী দাম্পত্য-জীবনের নিশ্চয়তা পাব না যতক্ষণ আমাদের দাম্পত্যসম্পর্ককে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম না বানাব, যতক্ষণ না আমাদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ও সুখ দুঃখের মূল অনুষঙ্গ হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন কিংবা তার রোষানল থেকে বাঁচার তামান্না।
বিয়ে ছাড়াও পৃথিবীতে আজ লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ একসাথে থাকছে—নাম দিয়েছে লিভ টুগেদার, ট্রায়াল ম্যারেজ—আরও কত কী। শার‘ঈ নিয়মে সম্পাদিত আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কগুলো তখনই স্বার্থক হবে, যখন আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করা পবিত্র জীবন পরিচালিত হবে কেবল তাঁরই সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। আমাদের প্রতিটি কথা, আচরণ পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা এবং অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য নিয়ে। সবার জন্য এই কামনাই রইল।
~ ভালোবাসার চাঁদর বইয়ের সম্পাদকীয় থেকে ~
© আবু তাসমিয়া আহমদ রফিক,
প্রধান সম্পাদক, সিয়ান পাবলিকেশন
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....