আন্দালুসের গল্প ১ : লেখক আম্মারুল হক | Andaluser Golpo 1 By Ammarul Haque

  • আন্দালুসের গল্প : ০১
  • লেখক : আম্মারুল হক
  • প্রকাশনী : সঞ্চালন প্রকাশনী
  • বিষয় : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্য
  • পৃষ্ঠা : 192, কভার : হার্ড কভার
  • ভাষা : বাংলা

মানুষ কোনোকিছু হারিয়ে সেটার মূল্য বোঝে। সোনালি অতীতের আনন্দঘন স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে দিন কাটায়, আফসোস করে। আহা! কী হারিয়ে ফেললাম। আন্দালুস! আমাদের আন্দালুস তেমনই হারানো ঐতিহ্য আমাদের। মুসলিম আন্দালুসের পরতে পরতে আমাদের স্মৃতি জড়িয়ে। কিন্তু আন্দালুসের হারানো গল্প দিয়েই আমাদের আন্দালুস পরিচিতি। সুখময় স্মৃতির কথা জানিনে। টলেডোর তুষারশুভ্র বাড়ির হাদিসের গুঞ্জরন, কর্ডোবার বইমেলা কিংবা জারাগোজার শাদাবাড়ির কোলাহলময় গল্পগুলো শুনতে ইচ্ছে হয় না? হয় তো? চলুন গল্প শুনি তবে…

ফিরে পাওয়া জীবন

এক আন্দালুসিয়ান লোকের এক সুন্দরী দাসী ছিল। তাকে সে খুব ভালোবাসত এবং সেও তাকে ভালোবাসত। কিন্তু অভাবে পড়ে সে তাকে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। একজন ভালোমনের ব্যবসায়ী এই দাসীকে কিনে নিয়ে যায়। দাসীটির প্রথম মুনিব তাকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু সে চিন্তাই করতে পারেনি যে, ওই দাসীর সাথে তার আত্মা জুড়ে গেছে এবং সে তাকে ছাড়া বাঁচতেই পারবে না। প্রেমাস্পদের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার বিরহের তীব্রতায় তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবার উপক্রম হলো।

শেষমেশ সহ্য করতে না পেরে সে ব্যবসায়ীর কাছে আবারও দাসীকে ফিরিয়ে নিতে গেল। এদিকে ব্যবসায়ীও দাসীর রূপে পাগল হয়ে তার প্রেমে পড়ে যায়, তাকে ভালোবেসে ফেলে। প্রথম মালিক ব্যবসায়ীর কাছে এসে দাসীকে ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করে, কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি সে তার সমুদয় সম্পত্তিও ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দিতে রাজি হয়। তারপরেও ব্যবসায়ী তার অনুরোধ রাখলেন না। নিজ এলাকার লোকজন নিয়ে তাদের মাধ্যমে সে ব্যবসায়ীর কাছে সুপারিশও করল। কিন্তু তারপরও ব্যবসায়ীর হৃদয় গলল না।

একপর্যায়ে সম্পূর্ণ অস্থির হয়ে সে তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে েেল। অতঃপর সিদ্ধান্ত নিল, সে শহরের হাকিমের শরণাপন্ন হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। শহরের হাকিম দলবল নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, এমন সময় ওই ব্যক্তি দূর থেকে চিৎকার করে হাকিমকে ডাকতে লাগলেন। হাকিম তার চিৎকার শুনে | 

তাকে তলব করে দরবারে আসার আদেশ দিলেন। দরবারে এসে হাকিম সিংহাসনে বসলেন এবং তাকে তার বক্তব্য উপস্থাপন করতে বললেন। ওই লোক পুরো ঘটনা বলে হাকিমের কাছে অনুনয়-বিনয় করতে লাগল। তার পুরো বক্তব্য শুনে হাকিম এবার দাসীর ক্রেতা সেই ব্যবসায়ীকে দরবারে উপস্থিত করার আদেশ করলেন। ব্যবসায়ী এলে হাকিম তাকে বললেন,
‘এই লোক বড় অদ্ভুত প্রেমিক! আমি তার হয়ে আপনার কাছে সুপারিশ করছি, আপনি তাকে দাসী ফিরিয়ে দিন।'

কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করে বললেন,
‘আমি তাকে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। এবং আমি ভয় পাচ্ছি, যদি আমি দাসীকে এই লোকের কাছে ফিরিয়ে দিই, তবে আমি আগামীকাল আপনার কাছে সাহায্য চাইব এবং আমার অবস্থা এই ব্যক্তির থেকে আরও খারাপ হয়ে যাবে।'

হাকিম তার হৃদয় গলানোর জন্য নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে কিছু দিনার-দিরহাম তাকে দিতে চাইলেন৷ কিন্তু তবুও তিনি দাসীর প্রতি নিজের ভালোবাসার কারণে হাকিমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নিজের অপারগতা প্রকাশ করলেন। এভাবে অনেকক্ষণ বাদানুবাদ চলার পরেও কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারায় হাকিম প্রথম ব্যক্তিকে বললেন,

‘তোমার জন্য তো অনেক কিছুই করলাম। যা দেখলে এর চেয়ে আর বেশি কিছু আমি করতে পারি না। তোমার জন্য যতটা সব সুপারিশ, চেষ্টা সবই করলাম। কিন্তু ব্যবসায়ী তো তোমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে বলে দাবি করছে, তার অবস্থা তোমার চেয়েও খারাপ হয়ে যাবে বলছে। এখন কী করা যায় বলো। ধৈর্য ধরো। আল্লাহ তাআলা হয়তো মোর জন্য কোনো ব্যবস্থা করে দেবেন।' আন্দালুসিয়ান লোকটি বলল,
‘আপনার হাতে কি আর কোনো উপায় নেই?”
জবাবে হাকিম তাকে বললেন,

এখানে সদিচ্ছা ও চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছু করার আছেই-বা কী?’
আন্দালুসিয়ান লোকটি নিরাশ হয়ে আত্মাহুতি দেয়ার জন্য ছাদ থেকে ঝাঁপ দিলো। হাকিম আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে উঠলেন। পাইক-পেয়াদা দ্রুত তাকে নিচ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসে হাকিমকে জানাল যে, তার বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি। আবার তাকে দরবারে উপস্থিত করা হলো। হাকিম জানতে চাইলেন, আত্মহত্যা করে তার কী লাভ?
সে বলল,

‘জাঁহাপনা! এরপর আর বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন বাকি নেই।' দ্বিতীয়বারের মতো সে আত্মহত্যা করতে চাইলে সবাই তাকে বাধা দেয়। হাকিম এবার বললেন,
‘তার এই আত্মহত্যার চেষ্টা থেকেই এই মকদ্দমার রায় বেরিয়ে আসে।' অতঃপর তিনি ে ার দিকে ফিরে বললেন,

‘ওহে! তুমি উল্লেখ করেছ যে, তুমি দাসীকে তার প্রথম মালিকের চেয়েও বেশি ভালোবাসো, এবং তুমি ভয় পাচ্ছ যে তুমিও তার মতোই হবে। ঠিক?”
তিনি বললেন, 'হ্যাঁ, জনাব।'
হাকিম বললেন,

“তোমার এই বন্ধু তার ভালোবাসা প্রদর্শন করেছে। এমনকি সে প্রেম-বিরহে আত্মাহুতি পর্যন্ত দিতে চেয়েছে। যদি না আল্লাহ তাকে রক্ষা করতেন, সে দুনিয়া থেকে চলে যেত। দেখি ওর মতো করে আপনিও আপনার প্রেমের নিদর্শন আমাদের সামনে উপস্থাপন করুন। আপনার বন্ধুর মতো এই বারান্দা থেকে নিচে ঝাঁপ দিয়ে দেখিয়ে দিন। যদি এতে আপনার মৃত্যু হয়ে যায় সোয় আপনার। আর যদি বেঁচে ফেরেন তবে দাসী আপনার কাছেই থাকবে। কিন্তু যদি আপনি ঝাঁপ দিতে না পারেন, তাহলে কিন্তু আমি আপনার কাছ থেকে দাসী ছিনিয়ে নিয়ে প্রথম মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেবো।'

কবি বলেন,
‘কামনার রং কেবল সে-ই জানে, যে তা ভোগ করে, প্রেমের আয়তন সে-ই বোঝে, যে পরিমাপ করে। ব্যবসায়ী প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে বলল, —আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করে দেখছি।'
ভালোবাসার প্রমাণ দেয়ার লক্ষ্যে প্রথমে তিনি দরজার কাছে গিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে  েখলেন। কিন্তু ঝাঁপ না দিয়ে ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসলেন। তা দেখে হাকিম তাকে বললেন,
‘আল্লাহর কসম, আমি যা বলেছি, তা-ই হবে। আমি আমার রায় প্রত্যাহার করব না।' ক্রেতা আবারও চেষ্টা করলেন। কিন্তু এবারেও আতঙ্কিত হয়ে পিছু হটলেন।
ব্যবসায়ী যখন কিছুতেই তার ভালোবাসার চিহ্ন উপস্থাপন করতে পারল না,
হাকিম তাকে বললেন,

‘অনেক হয়েছে। আমাদের সাথে আর তামাশা করবেন না। অবশেষে প্রথম মুনিবের সংকল্প দেখে ব্যবসায়ী বলল, ‘জাঁহাপনা! দাসী আমি সন্তুষ্টচিত্তে ফিরিয়ে দিচ্ছি।'
হাকিম বললেন,

‘আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরস্কারে পুরস্কৃত করুন।'
অতঃপর হাকিম ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দাসী কিনে নিয়ে তার প্রথম মালিককে দিয়ে দিলেন। তারা খুশিমনে বিদায় নিল। ১৯৪
[১৯] ত্বওকুল হামামাহ লি ইবনি হাযম (২৬৫)

অরিজিনাল বইটি সংগ্রহ করুন - রকমারি - ওয়াফিলাইফ - ইসলামিবইঘর - ইসলামিবই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ