লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ
প্রকাশকঃ অন্যপ্রকাশ
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি, ২০০৫
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৯৫
প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ বরাবরই তার উপন্যাসে আমাদের জীবনের স্বাভাবিক মুহূর্তগুলির কথা বলে এসেছেন। যেসব চরিত্রের কথা তার লেখায় আমরা পাই তাদের প্রায় সবাই আমাদের আশপাশে থাকা পরিচিত মানুষ যাদের মধ্যে আহামরি কোনো বৈশিষ্ট চোখে পড়ে না, আহামরি নয় বলেই নিজেদের কাছে চেনা বোধ হয় মানুষগুলিকে। টুকরো টুকরো পরিচিত দৃশ্যগুলো একসাথে জুড়ে দিয়ে শেষমেশ যে চিত্রটি মূর্ত হয়ে উঠে তা কখনো আনন্দ, কখনো আমোদ, কখনো হাসি আবার কখনো শুধুই হাহাকারের উদ্রেক করে।
'অরণ্য' বইটি পড়ে শেষ করার পর স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জেগেছে বইটির নাম 'অরণ্য' কেন? প্রচ্ছদে শুকনো ডাল, ব্যাকগ্রাউন্ডের রং কিছুটা মরুভূমিসদৃশ অথচ বইয়ের নাম অরণ্য, কেন?
এটি নিয়ে কথা বলার আগে বইটির প্লট সম্পর্কে একটু ধারনা দেই। গল্প শুরু হয় সোবহানকে দিয়ে। সোবহান বি.এ পাস করা বেকার যুবক। প্রায় চার বছর ধরে বেকার সে। চাকরির চেষ্টা করতে পুরো ঢাকা শহর চষে বেড়ায় তবুও চাকরি নামের সোনার হরিণ অধরা। একটি বাড়িতে সাবলেট থাকে মধ্যবয়সী জলিল সাহেবের সাথে।
সোবহানকে ঘিরে বিভিন্ন চরিত্রের আবির্ভাব এখানে। উপন্যাসে বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত যুবকের জীবনটা কেমন সেটি যেমন দেখানো হয়েছে, তার পাশাপাশি হরেকরকম পরিস্থিতির শিকার আরো কিছু মানুষের দুঃখ এবং জীবন যন্ত্রনার স্বরুপ প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং বেকারত্বের জ্বালা বইটির একমাত্র বিষয়বস্তু নয়।
নাজুক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি একেকজন মানুষকে একেকরকম বিড়ম্বনায় ফেলে। উদাহরন হিসেবে সোবহানের রুমমেট জলিল সাহেবের কথা বলা যায়। জলিল সাহেব যদিও বেকার নন কিন্তু অভাবি। এই অভাব তাকে সংসারী হতে দেয়নি। মিডলাইফ ক্রাইসিস তাকে সেক্সুয়ালি ফ্রাস্টেটেড করে তোলে। মেয়েদের সম্পর্কে অহেতুক নোংরা মন্তব্য তার স্পষ্ট প্রমাণ। একজন ভাসমান মানুষ সে, যার জীবন মেসবাড়ি আর সাবলেটেই সীমাবদ্ধ।
আবার ধরা যাক, সোবহানের বন্ধু বুলু, মামার সংসারের বোঝা বুলুও বেকার । প্রেমিকা রেশমার জোগাড় করা সাত হাজার টাকা দিয়ে সে যখন একটি চাকরি পাকা করতে সক্ষম হয় তখনই তার ধরা পড়ে জন্ডিস।
সোবহান যার বাড়িতে সাবলেট থাকে সেই মনসুর সাহেবের শ্যালিকা যূথি। বাবা-মা নেই, দুলাভাইয়ের উপর সম্পূর্ন নির্ভরশীল যূথি প্রতি রাতে কাঁদে। লেখক এখানে যূথির কাঁদার ব্যাপারটা স্পষ্ট না করলেও খুব সম্ভবত যূথি তার দুলাভাই, অসুস্থ বোন কদমের স্বামী মনসুরের পীড়নের শিকার।
'অরণ্য' বইটিতে এধরনের দুঃখী চরিত্র আরো রয়েছে। প্রায় প্রতিটি চরিত্রের পরিণতি তেমন সুখকর নয়। এসব জীবনের পরিণতিগুলি অনেকটা কানা গলির মতো, এর পরে যেন আর রাস্তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
'অরণ্য' নামের ব্যাখ্যায় আসি। 'অরণ্য' বলতে চোখের সামনে ফুটে উঠে সবুজের সমারোহ, স্নিগ্ধ প্রাণের হাতছানি, যা মনের মধ্যে আশ্চর্য সুখের সঞ্চার করে । কিন্তু 'অরণ্য' উপন্যাসে চরিত্রগুলির জীবনে যেন সুখস্বরুপ অরণ্যের জন্য হাহাকার বিরাজমান। এই হাহাকারের কথা কখনো কেউ মুখ ফুটে বলে আবার কেউ বলে না।
কেউ হয়তো যাতনার ভার সহ্য করতে না পেরে কোনো মমতাময়ী নারীর কাছে গিয়ে বলে উঠে, "যূথি, আমার আজ বড় কষ্ট।"
তাদের জীবনে যেন প্রবল খরার অস্তিত্ব, একটু অরণ্যের আশায় অস্থির, তৃষিত সবাই।
তবুও এতো দুঃখের মাঝে আপনজনের মায়া-মমতা, ভালোবাসার অস্তিত্ব চোখে পড়ে। মরুভূমিতে এক ফোঁটা পানির মতো। যার স্থায়িত্ব নেহাতই কম তবুও কিছু সময়ের জন্য দাগ রেখে যায়।
লেখক হুমায়ূন আহমেদ কোন ধরনের অতিরঞ্জন বা আবেগের ঘনঘটা ছাড়াই খুব সরল করে মানুষের অরণ্যের প্রতি বিদ্যমান আকাঙ্ক্ষাটুকু তুলে ধরেছেন আলোচ্য বইটিতে। Download
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....