অদ্ভুতুড়ে বইঘর কেন পড়বেন? লেখক : শরীফুল হাসান | Audvuture Boighor By Shoriful Hasan

  • বই : অদ্ভুতুড়ে বইঘর - পাঠ প্রতিক্রিয়া!
  • লেখক : শরীফুল হাসান
  • জনরা : মিডেল গ্রেড ফ্যান্টাসি
  • প্রকাশনী : অন্যধারা
  • মুদ্রিত মূল্য : ৩০০টাকা

বই পড়বার সময় ঘটনাগুলোকে ভিজুয়ালাইজ করে না এমন লোক খুব কম। একেকটা লাইন পড়ি আর চোখের সামনে সে দৃশ্য ভেসে ওঠে। কেমন হতো যদি সত্যিই বইয়ের সেই জগতে আমরা বিচরণ করতে পারতাম!

শান্ত নিরিবিলি শহরে নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছিল নিশ্চিন্তপুরবাসী। তবে সুখে শান্তিতে চিন্তামুক্তভাবে দিন কাটালে তো আর গল্প আগাবে না। তাই বিপত্তি এলো পরপর তিনজন মানুষের নিখোঁজ হওয়া দিয়ে। মফস্বলের ওসির শুয়ে বসে ওজন বাড়ানোর দিন শেষ। কাজে লেগে পড়তে হবে।
কোথা থেকে মফস্বলে হাজির হলেন শতবর্ষী এক বুড়ো। রাতারাতি এক বইয়ের দোকান দিয়ে বসলেন। এহেন বই নেই যা তার দোকানে নেই। যদি কোন বই নাও পাওয়া যায় কিভাবে জানি তা সে জোগাড় করে ফেলেন। এ এক বিরাট রহস্য। বুড়ো আর তার দোকান যেন পুরোটাই রহস্যের চাদরে মোড়া।
মশা ওরফে মুশফিক-উজ-জামান-চৌধুরী ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া এক ছেলে। তার সঙ্গী হিসেবে আছে রঞ্জু মামা। নিশ্চিন্তপুরের রহস্যের কুলকিনারা করতে মামা-ভাগ্নে ছুটছে। কথায় আছে, ❝মামা-ভাগ্নে যেখানে বিপদ নাই সেখানে❞। আমাদের এই ছোট্ট মামা-ভাগ্নে চুপিচুপি গোয়েন্দাগিরি করে সুজন, হারান স্যার এবং বাশার স্যারের নিখোঁজ হবার কারণ অনুসন্ধানে লেগে পড়েছে। ইতোমধ্যে কিছু প্রাইমারী সাস্পেক্টও পেয়ে গেছে তারা। পারবে কি কুলকিনারা করতে? নিশ্চিন্তপুর কি আবার শান্ত নিরিবিলি শহরে পরিণত হবে?
নিশ্চিন্তপুরে খিজির আলী নামে আরেক রহস্যময় চরিত্রের আগমন ঘটেছে। আশ্চর্য বেশভুষা আর দিনরাত বাছবিচার ছাড়াই সর্বদা চোখে কালো চশমা পরে থাকা এই ব্যক্তিকে করেছে আরও বেশি রহস্যময়। নিশ্চিন্তপুরে আগমনের হেতু কী তার? অবাক বেশভুষার ভেতরে সকল কিছুর মূল হোতা কি এই ব্যক্তিই? মামা-ভাগ্নে কী বলে? 

পাঠ প্রতিক্রিয়া:
শিশু-কিশোর ভিত্তিক ফ্যান্টাসি ঘরনার বই ❝অদ্ভুতুড়ে বইঘর❞। বইয়ের প্লট অসাধারণ। শিশু-কিশোর সাহিত্য নিয়ে মানসম্মত লেখা খুব কম। এদিক থেকে ❝অদ্ভুতুড়ে বইঘর❞ একটি সার্থক বই। ১৪৩ পৃষ্ঠার এই বইতে শুরু থেকেই রহস্যের সূচনা হয়। ছোটো ছোটো বিভিন্ন অধ্যায়ে এগিয়ে যেতে থাকে তা। আর রহস্যের পর্দাও নামে বেশ দারুণভাবে। গল্পের খাতিরে কোথাও ভীতির সঞ্চার করেছেন আবার কোথাও খিলখিলিয়ে হাসির উদ্রেক হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া মশা থুরি মুশফিকের হিউমার গুলো বেশ মজার ছিল। মামা-ভাগ্নের জুটি ছিল খুবই উপভোগ্য। ফেলুদা-তোপসে কিংবা শার্লক-ওয়াটসন হয়ে যাবার দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল তারা। তোপসে হতে বেশি বাকি নেই এই ভেবে মুশফিকের গর্বে ছাতি ফুলে যাবার ব্যাপারটাও বেশ মজার ছিল।
শেষদিকে রহস্যের উন্মচোনের দৃশ্যপটও ছিল অসাধারণ। অতিরিক্ত কিছুই ছিল না বইতে।
লেখকের বর্ণনার ধরন বেশ ভালো লাগে আমার। এই বইতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মামা-ভাগ্নের জুটি আবার ফিরে আসুক এই আশা করছি।

❝অদ্ভুতুড়ে বইঘর❞ বইটি ❛কালি ও কলম পুরষ্কার ২০১৬❜ অর্জন করে, ❛শিশু-কিশোর সাহিত্য❜ ক্যাটাগরিতে। টেলিভিশনের পর্দায়ও এর সফল চিত্রায়ন হয়েছে গতবছর। 


কাহিনী সংক্ষেপ
সীমান্তের শান্ত নিরিবিলি মফস্বল শহর নিশ্চিন্তপুর। নামটাকে সার্থক করে এতদিন সেখানে নিশ্চিন্তেই ছিল লোকজন। ছিমছাম , সুন্দর এই শহরে অপরাধ বলতে মাঝেমধ্যে দুই একটা ছিঁচকে চোরের দেখা পাওয়া যাওয়া পর্যন্তই সীমিত থাকে। তাই থানার ওসি আজমত সাহেবেরও বসে বসে দিন কাটছে আর ভুড়ি বাড়ছে। এই নিরিবিলি শহরেই হঠাৎ করে কোথা থেকে এসে হাজির হলো এক বুড়ো, বয়সের তার কোন গাছপাথর নেই। শহরের একপ্রান্তে রাতারাতি একটা বইয়ের দোকান খুলে বসলো সে। দোকানের তাকে তাকে সাজানো রঙ বেরঙের অনেক বই। কেউ জানে কবে কিভাবে এত বই নিয়ে বুড়ো শহরে আসলো আর কখনই বা বইয়ের দোকান খুলে বসল। বুড়োর বইয়ের দোকান বসানোর পর থেকেই একের পর নিখোঁজ হতে থাকলো শহরের লোকজন। প্রথমে ক্লাস সিক্স পড়ুয়া সুজন, তারপর অঙ্ক শিক্ষক হারান স্যার এবং বিজ্ঞান শিক্ষক বাশার স্যার উধাও হয়ে গেলেন রতারাতি। রহস্য সমাধানে নামল রঞ্জু-মশা , মামা-ভাগ্নের গোয়েন্দা যুগল। তাদের সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ পড়বে না কারো নাম!

পাঠ প্রতিক্রিয়া
মৌলিক ফ্যান্টাসি ব্যাপারটা সব সময়ই অনেক আগ্রহ জাগানিয়া আমার জন্য। আর তার উপরে মিডেল গ্রেড বা ইয়াং এডাল্ট ফ্যান্টাসি হলে তো কথাই নেই! ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বর্তমানে দেশে শিশু কিশোরদের জন্য যথেষ্ট ভালো ও মানসম্মত লেখা হচ্ছে না। সেখানে এরকম ফ্যান্টাসি ও সাসপেন্স এলিমেন্টের একটি দারুণ শিশু কিশোর উপন্যাস পড়ে অনেক তৃপ্তি পেয়েছি। মিডল গ্রেড ফ্যান্টাসি হিসেবে প্লটটা এক কথায় দুর্দান্ত। এক্সিকিউশনও একদম পারফেক্ট মনে হয়েছে। গল্পের শুরুটা এমনভাবে করেছেন লেখক যে প্রথম কয়েক পৃষ্ঠাতেই পাঠককে গল্প বলার ভঙ্গী ও কাহিনী দিয়ে বইয়ের সাথে গ্লুড করে ফেলেছেন। একদম প্রথম থেকেই মুল রহস্য শুরু হয়ে যায় এবং তারপর তরতর করে কাহিনী এগিয়ে গিয়েছে। ছোট ছোট ৩৫টি অধ্যায়ে বইটিকে ভাগ করেছেন লেখক এবং প্রতিটি অধ্যায়ে ইতি টেনেছেন দারুণ মুনশিয়ানার সাথে ।  

এই নিয়ে সুলেখক শরীফুল হাসানের দুটি বই পড়লাম। প্রথমটি ছিল লেখকের মার্ডার মিস্ট্রি ঘরানার বই রাত্রি শেষের গান। সেই বইটিতে বর্ণনাভঙ্গি বেশ ভালো লাগলেও অদ্ভুতুড়ে বইঘরে তা অসাধারণ লাগলো। গল্প বলার ভঙ্গি মুগ্ধতা ছড়িয়েছে শুরু থেকে শেষ অবধি। আসলে এরকম লেখা পড়েও ভীষণ আরাম পাওয়া যায়। সাদামাটা গল্পকেও দারুণভাবে উপস্থাপন করতে জানেন লেখক। ১৫০ পৃষ্ঠার বইটি এক টানে পড়ে উঠা গেছে। গল্পের সাথে দারুণভাবে হিউমার মিশিয়েছেন লেখক। বিশেষ করে সংলাপগুলো , মশার (মুশফিক উজ জামান চৌধুরী) নানান উদ্ভট চিন্তা ভাবনার বর্ণনা ও রঞ্জুর কাণ্ডকারখানা পড়ে কয়েকবারই হেসে দিয়েছি।

প্রতিটি চরিত্রকেই অনেক ভালো লেগেছে। প্রথমেই বলতে হয় মামা ভাগ্নে গোয়েন্দা যুগল রঞ্জু ও মশার কথা। ক্লাস সিক্স পড়ুয়া মশা যার আসল নাম কিনা মুশফিক- উজ- জামান চৌধুরী ও তার সদ্য এস এস সি পরীক্ষা দেওয়া রঞ্জু মামার গোয়েন্দা অভিযান দুর্দান্ত ছিল। রঞ্জু মামা ও ভাগ্নে মশার রহস্য উম্মোচনের উদ্ভট যাত্রা হাস্যরসে পরিপূর্ণ ছিল। ভবঘুরে আশফাকের চরিত্রটিকেও ভালো লেগেছে। তার চরিত্রটি গল্পে একটা অন্যরকম ফ্লেভার যোগ করেছে। আশফাকের অতিথি খিজিল আলীকেও অসাধারণ লেগেছে। খুব কম সময়েই লেখক এই চরিত্রকে সুন্দরভাবে ডেভেলাপ করতে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়াও আকাশ খান , ওসি আজমত, এই চরিত্রগুলোর উপস্থিতি বইতে খুব বেশি না হলেও নিজেদের আলাদা একটা ছাপ রেখে যেতে পেরেছে সবাই। প্রায় প্রতিটা চরিত্রই সতন্ত্র ও ওয়েল ডেভেলাপড। কিন্তু রহস্যময়ী সেই বুড়ো বইয়ের দোকানিকে লেখক গল্পে একটু কমই এনেছেন। বইয়ে সাসপেন্স ধরে রাখতেই এমনটা করা হয়েছে তা বুঝতে পারলেও আমার মনে হয়েছে বুড়োর চরিত্রটাকে আরেকটু জায়গা দেওয়া যেত বইয়ে।

আগেই বলেছিলাম বইয়ের একদম প্রথম থেকেই রহস্য ও রহস্য উম্মোচনের যাত্রা শুরু হয়ে যায়। এই একই গতিতেই পুরো গল্প এগিয়েছে। ফিনিশিংটাও আমার কাছে বেশ ভালো ও সন্তোষজনক লেগেছে । এন্ডিং পড়ে মনে হচ্ছিল নিশ্চিন্তপুর ও রঞ্জু- মশাকে নিয়ে লেখক সামনে আরও বই লেখতে পারেন । 

দারুণ কাহিনী , মসৃণ স্টোরিটেলিং, হিউমারের পারফেক্ট প্রয়োগ এবং মজার মজার সব চরিত্রের আনাগোনা, সব মিলিয়ে একদম ফুল‌ এন্টারটেইনমেন্ট প্যাকেজ অদ্ভুতুড়ে বইঘর।

আমি অদ্ভুতুড়ে বইঘর বইটি বইটই অ্যাপে মাত্র ৫০ টাকা দিয়ে কিনে পড়েছি। এটা যে একটা অসাধারণ ডিল তা মানতেই হবে। এত কম দামে বইটি পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য লেখক ও বইটইকে বিশেষ ধন্যবাদ। কিন্তু আমার অনেক ইচ্ছে করছে বইটির হার্ডকপি কালেক্ট করতে কারণ নিকট ভবিষ্যতে যে বইটি আমি আবার পড়ব তাতে কোন সন্দেহ-ই নেই। আর পছন্দের বইগুলোর হার্ডকভার না থাকলে খারাপ লাগে আমার। তবে বইটি বর্তমানে আউট অফ প্রিন্ট থাকায় সেই ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে না।

শুরুতেই বলেছিলাম বিগত অনেক বছর ধরেই আমাদের দেশে শিশু কিশোরদের জন্য যথেষ্ট মান সম্মত বই লেখা হচ্ছেনা বলেই মনে করি। সেখানে এরকম একটা মিডেল গ্রেড ফ্যান্টাসি পড়ে অসাধারণ অনুভূতি হচ্ছে। শিশু কিশোর সাহিত্যে দারুণ একটা সংযোজন বইটি। লেখক যদি রঞ্জু-মশাকে নিয়ে সিরিজ লিখেন তাহলে নিঃসন্দেহে দেশের শিশু কিশোর সাহিত্যে একটি অসধারন সিরিজের জন্ম হবে। স্ট্যান্ডএলোন হিসেবেও বইটা মনে রাখার মতো।

লেখকের অন্যান্য বইয়ের তুলনায় এই বইটি নিয়ে কম আলোচনা হয় ব্যাপারটা দুঃখজনক। আমি বইটা সবাইকেই রেকমেন্ড করব। অদ্ভুতুড়ে বইঘর মূলত কিশোরদের জন্য লেখা হলেও সব বয়সী পাঠকদেরই ভালো লাগবে বলে বিশ্বাস করি।

*রিভিউটি বেশ আগের লেখা । বইটি নতুন মোড়কে অন্যধারা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

*এই সিরিজে ভবিষ্যতে আরও বই আসবে লেখক নিশ্চিত করেছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ