বাজিকর / বাজি / বাজিমাত - নাবিল মুহতাসিম এর বাজিকর ট্রিলজী


বাজিকর ট্রিলজী

নাবিল মুহতাসিমের বাজিকর ট্রিলজীর প্রথম বই বাজি পড়েছিলাম অনেক আগে৷ গল্পের অনেক কিছু ভুলে গেলেও যেই অনুভূতিটুকু ভুলিনি সেটা হচ্ছে - মুগ্ধতা৷ আর ভুলিনি কিছু চরিত্র - আহাদ, ট্রাভিস আরভাইন, জনি আর সাশাকে৷

বাজি পড়ার অনেক দিন পর ট্রিলজীর বাকি বই দুটো হাতে আসল পড়ার জন্য৷ বাজিকর, বাজিমাতেও লেখকের সেই দুর্দান্ত স্টোরী টেলিং আর সাসপেন্স বিল্ডিং এবিলিটি বজায় ছিল৷ এক নি:শ্বাসে পড়ার মত বই৷ সার্থক পেইজ টার্নার৷ হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট, গান ফাইট, চেইজিং, হুইসেল ব্লোয়িং, একশন, ডগ ফাইট কী না ছিল গল্পে !! আমেরিকা, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া হয়ে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত প্লট! এফবিআই, সিআইএ, মোসাদ, এমআই সিক্স, র থেকে শুরু করে বাংলাদেশের কিংবদন্তীতুল্য দ্য এজেন্সী আর চৌকষ পুলিশ বাহিনী পর্যন্ত জড়িত এই সুবিশাল প্লটে! বলা যায় একটা কমপ্লিট থ্রিলিং প্যাকেজ !

কিন্তু বাজির সাথে বাজিকর আর বাজিমাতের লেখনশৈলীতে কিছু সূক্ষ পার্থক্য চোখে লেগেছে আমার৷ ডার্ক টাইপ হিউমার আনতে গিয়ে কিছুটা অতিরিক্ত করে ফেলেছেন লেখক৷ একশন সিকোয়েন্সে এই অতিরিক্ত বর্ননাটুকু গাই রিচির "স্ন্যাচ" কিম্বা "লক স্টক এন্ড টু স্মোকিং ব্যারেলস"এর ভাইব আনতে চাওয়ার ব্যার্থ চেষ্টা মনে হয়েছে৷ এক জায়গায় একটা জিনিস গায়েব হয়ে যাওয়ার রূপক হিসেবে লেখক হিউমার হিসেবে ইউজ করেছেন "পুরাই আলিমুল গায়েব" ! এইটা কোন কথা!! স্রষ্টার এই বিশাল গুণ বাচক শব্দটা নিয়ে হিউমার পছন্দ হয়নি৷ 

তারপর আরেকটা চেইজিং একশন সিকোয়েন্সে দিনে দুপুরে রাস্তার মধ্যে বাংলাদেশী মব গুলিতে আহত বিশালদেহী এক সুপার ট্রেইন্ড স্পাই কে স্রেফ পিটিয়ে মেরে ফেললো কারন সে একজন পাকিস্তানী !! দেশপ্রেমের কী অস্বাভাবিক অতিরঞ্জিত বহি:প্রকাশ !! 

দ্য এজেন্সীর হেড অফিসের চামড়াপট্টি, দূর্গন্ধ, জল, কাদা, নোংরা'র দারুন ছদ্মবেশের বর্ননা ছিল গল্পে৷ কিন্তু খটকা লেগেছে; বুঝলাম বিল্ডিং আর এলাকার এই ছদ্মবেশে কেউ বুঝবেনা এইখানে দ্য এজেন্সীর হেড অফিস; কিন্তু এত গুলো স্মার্ট, ড্যাশিং তরুণ তরুণী, কর্মকর্তা, চীফ এরা অফিসে যাতায়াত করে কিভাবে; কারো নজর না কেড়ে?

নায়কের সাথে এক ভাবীর সম্পূর্ণ বেমানান সেক্সুয়াল টেনশন, হিন্দী সিরিয়াল টাইপ ক্লিফহ্যাঙ্গার, ইংরেজী সিরিয়াল টাইপ মাম্মি ইস্যু, মাথামোটা আইসিস মৌলবাদী জঙ্গী, ইমরান হাশমীর মত একাই জঙ্গীদের গুষ্ঠী উদ্ধার, মৃত ভিলেনের পুনরাগমন ইত্যাদি ব্যাপারগুলো গল্পটাকে ক্লিশে করে দিয়েছে অনেকাংশে৷

এই নেগেটিভ পয়েন্টগুলো সিরিজটার সাহিত্য মান কমিয়ে দিয়েছে আমার মতে৷ সবচে বড় যে টুইস্ট টা ছিল তাও মনে হয়েছে "এন্ডিং এ একটা মেগা টুইস্ট দেয়া নিয়ম" এ কারনে আরোপিত৷ অনেক টিভি শো কিম্বা বই শেষে এসে ভুয়া মনে হয় যখন টুইস্ট টা লেইম লাগে৷ যেমন - এমন একজনকে ভিলেইন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করানো হোল যাকে পুরোটা সময় একজন আদর্শবাদী হিসেবে দেখানো হয়েছে৷ কিন্তু এক্ষেত্রে সার্থক রাইটাররা ওই চরিত্রের আচার আচরন অভিব্যাক্তিতে কিছু গ্রে এরিয়া রাখেন যাতে পরবর্তীতে তার স্বরূপ উন্মোচন হলে তা পাঠক বা দর্শকের কাছে অবাস্তব, আরোপিত বা আনরিলেটেবল মনে না হয়৷ আমার মতে লেখক এই ক্ষেত্রে এই ব্যাপার টা মিস করেছেন৷

লেখক লেখার শুরুতেই প্রমিস করেছিলেন উনি পাঠকদের সার্ভ করবেন শক্তিশালী কিছু চরিত্র, বর্ণময় একশন আর একটু সুররিয়েলিজম৷ বলতেই হয় উনি উনার প্রমিস রেখেছেন৷ খুব ভাল মতই৷ সিরিজের সবচে শক্তিশালী দিক - এর চরিত্রগুলো৷ এত যত্ন আর এত ডিটেইলিং নিয়ে উনি চরিত্রগুলো তৈরী করেছেন যে পাঠক তাদের সাথে রিলেট করতে বাধ্য৷ তাদের দু:খে দু:খী হওয়া, তাদের এড্রেনালিন রাশের সাথে সাথে পাঠকেরও হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি বেড়ে যাওয়া, তাদের হতাশায় মুষড়ে পড়া আর তাদের সাফল্যে উদ্বেলিত হওয়া - সারা সিরিজ জুড়ে পাঠকের আর করার কিছু ছিল না! 

দারুন মেটাফোর, পরিমিত ডিটেইলিং, উপযুক্ত সংলাপ আর অসাধারন সাসপেন্স - এই সিরিজের অলংকার৷ অযথা কারুকাজ দেখানোর জন্য প্লট জটিল করা হয়নি, টাইমলাইন নিয়ে তৈরী করা হয়নি অযথা লুপ৷

শেষ বইটা একটু স্লো হলেও (প্রথম দুটির তুলনায়) ওভারঅল পুরো সিরিজটা এন্টারটেইনিং আর স্যাটিসফায়িং একটা রিডিং এক্সপিরিয়েন্স৷

তিনটা বইয়েই প্রচুর প্রিন্টিং মিসটেক৷ আর বইয়ের মান অনুযায়ী প্রচ্ছদ হতাশাজনক৷

তবে নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, দুনিয়ার না পড়া বইয়ের মাঝ থেকেও যদি কখনো দ্বিতীয়বার পড়ার জন্য কিছু বই বেছে নেই তাদের মধ্যে থাকবে "বাজি"!

মাহমুদুস সোবহানের দ্যা মাস্টারপ্ল্যানের পর বাজিই ছিল আমার পড়া দেশীয় লেখকের লিখা অন্যতম সেরা আন্তর্জাতিক মানের এসপিওনাজ থ্রিলার৷ আমার মতে এই বই দুটো অবশ্যই ইংরেজীতে অনুবাদ করে ইন্টারন্যাশনালি পাব্লিশ করা উচিত, যাতে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির সাহিত্য অনুরাগীরা বুঝতে পারে থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিতেও ফার্স্ট ক্লাস এসপিওনাজ থ্রিলার লেখা হয়৷

বাজিকর / বাজি / বাজিমাত
নাবিল মুহতাসিম
বাতিঘর 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ