গহীনে আঁচ - রিভিউ : ফৌজিয়া খান তামান্না - Gonine Ach : Fawjia Khan Tamanna

  • বই : গহীনে আঁচ - পাঠ প্রতিক্রিয়া! 
  • লেখক : ফৌজিয়া খান তামান্না
  • প্রকাশনী : চলন্তিকা
  • প্রকাশকাল : অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১
  • প্রচ্ছদ : নিসা মেহ্জাবীন
  • মুদ্রিত মূল্য : ৩৬০ টাকা

“ব্যবহার্য বস্তু নষ্ট হলে সারাই করা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা কাজের উপযুক্ত থাকে। তা না হলে ফেলে দেওয়ারই নিয়ম। শখের বা ভালোবাসার জিনিসই কেবল অকাজের হলেও ধুয়েমুছে যত্ন করে রাখা যায়।”
সম্প্রতি পড়ে শেষ করলাম চলন্তিকা পাণ্ডুলিপি পুরষ্কারজয়ী উপন্যাস ‘গহীনে আঁচ’। লেখক ফৌজিয়া খান তামান্নার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘গহীনে আঁচ’। এই উপন্যাসটি দিয়ে লেখক ফৌজিয়া খান তামান্না সাহিত্যের ভুবনে আত্মপ্রকাশ করেছেন। উপন্যাসটির বিস্তীর্ণ মলাটের পরতে পরতে অন্তর্নিহিত রয়েছে প্রেম, মানবতা, দ্বন্ধ-দ্রোহ, ঘাত-প্রতিঘাত, ঘৃণা ও নিভৃত প্রেমের আকুতি।

কাহিনী সংক্ষেপ
রিমনের ছোটবেলার প্রথম কয়েক বছর ঢাকা শহরে কাটলেও, পরে তার পিতার চাকরির কারণে মফস্বল শহরে এসে থিতু হয় তার পরিবার। রিমনের মা দুই ছোট ছেলে-মেয়েকে নিয়ে এই একা পরিবেশে থাকতে তেমন ভরসা পাচ্ছিলেন না। কিন্তু, তাদের এই দ্বিধা সহজেই কেটে যায় মুনার পরিবারের কারণে। রিমনের থেকে পাঁচ বছরের বড় মুনা ছোট রিমনের দেখাশোনা করতো।
রিমন প্রথম প্রেমে পড়ে যখন ওর বয়স আট। সে তার থেকে পাঁচ বছর বয়সী বড় মুনাকে ছোট থেকেই নিজের ভাবতো। একসময় রিমনের পুরো পরিবার আবার তাদের ঢাকার বাড়িতে ফিরে আসে। এরপর রিমনের পরিবারে ঘটে যায় নানান ঘটনা। মুনার জীবনেও নানা পরিবর্তন আসে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বদলে যায় জীবনের গতিপথ। জীবনের এ টানাপোড়েনে মুনা আক্রান্ত হোন থ্রোট ক্যান্সারে। আর এরই সূত্র ধরে দীর্ঘ আঠারো বছর পর আবার মুখোমুখি হয় মুনা ও রিমন। এরপর কী ঘটেছিল তাদের জীবনে তা জানতে হলে ‘গহীনে আঁচ’ উপন্যাসটি পড়তে হবে।

পাঠ প্রতিক্রিয়া
‘গহীনে আঁচ’ উপন্যাসটি রিমনের ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। উপন্যাসের শুরুটাই চমৎকার ছিল। প্রথম লাইন পড়ার পর থেকেই পুরো কাহিনী জানার আগ্রহ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। 

উপন্যাসটির মূল চরিত্রদ্বয় মুনা ও রিমন। রিমনের ভাষায় উপন্যাসটি বর্ণিত হওয়ার কারণে, রিমনের মন গহীনের নানা কথা পাঠক অনুধাবন করতে পারবেন। রিমনের জীবনের বেশিরভাগ স্থান জুড়ে ছিল মুনা। মুনার জীবনের নানা উত্থান-পতনের কাহিনী বইটিতে রয়েছে। এছাড়া বইটিতে রিমনের মা, বাবা, রিমা, নীলা, আদিল ছাড়াও প্রমুখ চরিত্রের উপস্থিতি রয়েছে। 

বইটিতে একজন নারীর স্বামীর সংসার ছেড়ে জীবন সংগ্রামের পথে নেমে পরার কাহিনী রয়েছে। নানা প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে তিনি জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে পেরেছেন। এছাড়া, থ্রোট ক্যান্সারে আক্রান্ত মুনার জীবনের নানা প্রতিকূলতার কাহিনী লেখক বইটিতে তুলে ধরেছেন। জীবনযুদ্ধে হেরে না যাওয়া এই দুই নারীর কাহিনী অবশ্যই পাঠকের মনে জায়গা করে নিবে। 

উপন্যাসটিতে এমন এক ভালোবাসা লেখক দেখিয়েছেন, যে ভালোবাসা আজীবন বেঁচে থাকে, নিঃশেষ হয়ে যায় না। বরং তা প্রকৃত মানব হতে শেখায়। 

উপন্যাসটির নামকরণও কাহিনীর সাথে একদম মানানসই। বইটির প্রচ্ছদও খুব সুন্দর এবং কাহিনীর সাথে মানানসই। লেখকের লেখনশৈলী চমৎকার। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে কখন রাত থেকে সকাল হয়ে গেছে টের পাওয়া যায়নি। সবশেষে বলবো, ‘গহীনে আঁচ’ উপন্যাসটি অসাধারণ লেগেছে এবং আমার মনের গহীনে স্থান করে নিয়েছে। 

বই থেকে প্রিয় কিছু লাইন:
প্রকৃতির কিছু স্বাভাবিক নিয়ম আছে। যে- কোনো নিয়মের ব‍্যত‍্যয় হলে আচরণ বা বৈশিষ্ট্যেও অস্বাভাবিকতা আসবেই। 

মানুষই বোধ করি, প্রকৃতির সবচেয়ে আশ্চর্য আবিষ্কার। একমাত্র মানুষেরই কোনো ব্যাকরণ নেই। একই ঘটনায় একেক মানুষ একেক প্রতিক্রিয়া দেখায়। 

জীবনে ভালো থাকা আর ভালো না থাকা খুবই জটিল সমীকরণের সরল অংকের নাম। সারাদিন ঘাম ছুটিয়ে দেখা যাবে উত্তর এক বা শূন্য। 

‘গহীনে আঁচ’র মাধ্যমে ফৌজিয়া খান তামান্না আত্মপ্রকাশ করলেন আমাদের নিভৃত সাহিত্য সাধনার ভুবনে। কামনা করি আমাদের এই সত্য, সুন্দর ও শাশ্বত সৃষ্টির বেদনানন্দে নিজেকে উৎসর্গ করার মহিমা যেন অর্জন করেন তিনি।
প্রথম সব কিছুর মধ্যেই কেবল প্রকাশ থাকে না, থাকে বিকাশের অঙ্গীকার। সে প্রতিশ্রুতি ফৌজিয়া খান তামান্না রক্ষা করবেন - তা আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি। তাঁর মধ্যে সে প্রত্যয় আমি দেখতে পেয়েছি। উপন্যাসের অনুভব-অভিজ্ঞতায় তিনি সমৃদ্ধ। লেখিকা নিজের প্রথম সামাজিক উপন্যাস ‘গহীনে আঁচ’ লেখার ক্ষেত্রেও চিরাচরিত ধারাকে ভিন্নতা দেয়ার চেষ্টা করেছেন, তার লেখনীকে দিয়েছেন নিজস্বতা।

উপন্যাসের বিস্তীর্ণ মলাটের পরতে পরতে অন্তর্নিহিত রয়েছে প্রেম, মানবতা, দ্বন্দ্ব-দ্রোহ, ঘাত-প্রতিঘাত,ঘৃণা ও নিভৃত প্রেমের আকুতি। সংগ্রামী প্রজ্বলিত জীবনের দহনের শব্দ বুনে বুনে তৈরির চেষ্টা করেছেন মানব হৃদয়ের নৈসর্গিক উপাখ্যান।  
‘গহীনে আঁচ’র দীপ্তিতে দীপ্তময়ী ঋষিতা থ্রোট ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন মুনা। মুনার সংগ্রামী জীবনে শাশ্বত ভালোবাসার অসাধারণ প্রেম হয়ে আবির্ভূত হন রিমন। মুনা এবং রিমনের ভালোবাসা কেবল কাছে পাওয়া নয়, ত্যাগের এক আলোক উজ্জ্বল বিশুদ্ধ অগ্নিশিখা! যা আজীবন বেঁচে থাকে, নিঃশেষ হয়ে যায় না এবং প্রকৃত মানব হতে শেখায়!

তপঃক্লেশী মুনার জীবন প্রারম্ভে চুপিসারে মায়ামৃগ হয়ে আসে রিমন।মুনার স্বোপার্জিত আদর-স্নেহ, ভালবাসা স্পর্শ করে রিমনের কোমল মন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বদলে যায় প্রবাহমান জীবনের গতিপথ। জীবনের এ টানপোড়ানে মুনা আক্রান্ত হোন থ্রোট ক্যান্সারে, আর এ সূত্র ধরেই দীর্ঘ আঠারো বছর পরে আবার মুখোমুখি হন মুনা ও রিমন। কিন্তু সে মহার্ঘ্য স্পর্শের মায়ামুক্ত মুনা ফিরে যায় স্বেচ্ছানির্বাসনে ।

প্রথম উপন্যাস গুরুত্বপূর্ণ সব দিক থেকেই। এ বই প্রকাশ করে ফৌজিয়া খান তামান্না দায়বদ্ধ হলেন সাহিত্য ও নিজের প্রতি।
তাঁকে স্বাগত জানাই সাহিত্যের বিস্তৃত আকাশে, জানাই প্রীতি ও শুভেচ্ছা।

রাশেদ রানা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ