- বই : "কামসূত্র" - দেবতোষ দাশ
- প্রকাশক : মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স
- পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৪৭০
- মুদ্রিত মূল্য : ৫০০ টাকা
নামে বইটির নাম "কামসূত্র" হলেও বইটি যৌনশাস্ত্র সম্পর্কিত কোন গাইড বুক নয়, এখানে "কাম" দ্বারা "কর্ম"কে রিলেট করা হয়েছে। বরং এটি একটি ঐতিহাসিক থ্রিলার বা পলিটিক্যাল থ্রিলার যার বিষয়বস্তু হলো তিব্বতের বৌদ্ধদের পরাধীনতা, চীনা আগ্রাসন ও বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস।
তিব্বত; হিমালয়ের উত্তরাঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬ হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতায় অবস্থিত। কৌশলগত অবস্থান ও ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব এবং বিশাল খনিজ সম্পদে ভরপুর হবার কারণে চীন এই অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রচুর হিমবাহ, বিশাল বিশাল হ্রদ এবং দুরন্ত জলপ্রপাত তিব্বতীয় মালভূমিকে মিঠা পানির ভান্ডারে পরিণত করেছে। পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও কৃষিপ্রধান দেশগুলো সরাসরি তিব্বতের পানির উপর নির্ভর করে। বিশ্বের প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তিব্বতের পানির উপর নির্ভরশীল। সোজাভাষায় বলতে গেলে এশিয়ার পানি প্রবাহের অধিকাংশই তিব্বতের নিয়ন্ত্রণাধীন। যার ফলে তিব্বতকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখার কারণে উক্ত দেশগুলোর উপর চীনের প্রভাব বিস্তারকে সহজ করে দিয়েছে।
১৯৫০ সালে চীন সরকার তিব্বত আক্রমণ করে এবং এক বছরের মধ্যে লাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ১৯৫৯ সাল থেকে দালাই লামার নেতৃত্বে তিব্বতের প্রবাসী সরকার ভারতের আশ্রয়ে রয়েছে। বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে তিব্বত এখন চীনের অংশ হলেও অধিকাংশ তিব্বতীরা তা মানতে নারাজ। অন্যদিকে, চীন কিছুতেই তিব্বতের উপর নিয়ন্ত্রণ ঢিলেঢালা করতে রাজি নয়।
সমান্তরালভাবে ধর্মীয় দিক থেকে কাহিনীর অনেকখানি জুড়ে আছেন অতীশ দীপঙ্কর। নবম থেকে দশম শতকের মাঝামাঝি সময়কালে তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্ম যখন হুমকির মুখে, তখন তিব্বতে এসে বৌদ্ধধর্ম পুনরায় প্রতিষ্টা করার জন্য তিব্বতের রাজা আমন্ত্রণ জানান অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে। আমন্ত্রণ পেয়ে ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে চীনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন দীপঙ্কর। টানা ২ বছরের দীর্ঘ যাত্রার পর অবশেষে নেপাল হয়ে তিব্বতে পা দেন তিনি। তার প্রভাবে তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের জৌলুশ ফিরিয়ে নিয়ে আসে, সূত্র ও তন্ত্রকে একীভূত করে তিনি "তান্ত্রিক বুদ্ধিজম" এর সূচনা করেন। যদিও বাংলা ছাড়ার মুহূর্তে অতীশ প্রতিজ্ঞা করে যান যে তিনি আবার ফিরে আসবেন, কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি; তিব্বতেই তার মৃত্যু হয়।
"গল্পের ভিতরে গল্প" স্টাইলের বই পড়তে বেশ ভালো লাগে আমার। এই বইতেও তেমনি একটা পড়ার সুযোগ হয়েছে। কালিম্পং-এর এক প্রাচীন গুম্ফায় পাওয়া গেলো একটি বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাস, নাম - "কামসূত্র"। অতঃপর সেটি চলে আসে গবেষক কবীর খানের কাছে যিনি অলরেডি ৪৯ বায়ু গ্রন্থে "মানব সভ্যতায় ঈশ্বরের আবির্ভাব" তত্ত্ব উপস্থাপন করে সুপরিচিতি লাভ করেছেন। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে কবীর খান তার বর্তমানে গবেষণার বিষয়ের সাথে এই উপন্যাসের অদ্ভুত মিল খুঁজে পান। বাৎস্যায়নের কামসূত্র বিশ্লেষণ করে একেবারে নতুন অর্থ নিষ্কাশন তার গবেষণার নতুন বিষয়। তার সাথে এই উপন্যাসটির সম্পর্ক কী?
উপন্যাসটি সাধু ভাষায় রচিত এবং পটভূমি একাদশ শতকের ভারত যার মূল চরিত্র বাঙ্গালী বণিক দীপন। উজ্জয়িনী নগরীর রহস্যময় একটি অতিথিনিবাস থেকে এই উপন্যাসের অধ্যায় শুরু। কিন্তু ক্রমান্বয়েই উপন্যাসটির ভাষাগত বিশ্লেষণ করে একাধারে বেশ কিছু অসংগতি ও রহস্য আঁচ করতে পারেন কবীর খান। উপন্যাসটিকে প্রাচীন হিসাবে উপস্থাপন করা হলেও তার ন্যারেটিভ ও উপস্থাপন একেবারেই আধুনিক। এই উপন্যাসটির লেখকই বা কে? কবীর খানকে কেনই বা এটি পাঠানো হলো? নিজের সাবজেক্ট-এর প্রতি টান, রোমাঞ্চ ও রহস্যের গন্ধ পেয়ে কবীর খান চলে যান শিলিগুড়ি হয়ে সোজা কালিম্পং, কিন্তু ওখানে পৌঁছেই তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন! নিজের অজান্তেই তিনি জড়িয়ে পড়েন এক বেপরোয়া তিব্বতীয় লামার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মধ্যে।
কোলকাতায় ইন্টারন্যাশনাল থিওলজিক্যাল মিউজিয়ামের তান্ত্রিক বুদ্ধিজম গ্যালারি থেকে রহস্যজনকভাবে চুরি হয়ে যায় এক প্রাচীন মহার্ঘ বৌদ্ধ মূর্তি। আবার কালিম্পং বেড়াতে গিয়ে অপহৃত হয় ৭ বছরের এক শিশু যার জন্ম বুদ্ধপূর্ণিমায় ও সে বাঙালি বৌদ্ধ পরিবারের অন্তর্গত। বৌদ্ধ মূর্তি চুরি, বৌদ্ধ শিশুর অপহরণ এবং কবীর খানের অন্তর্ধান- এই ৩ ঘটনার মাঝে কী কোনো যোগসূত্র আছে?
জয়েন্ট কমিশনার রজত রায়ের নির্দেশে তদন্তে নেমে পড়েছে লালবাজারের ন্টিক থেফট সেকশনের তরুণ অফিসার ইন চার্জ রিয়াজ আলম। কিন্তু তদন্ত প্রক্রিয়া যখন কিছুটা এগিয়ে কানাগলিতে আটকে যায় তখন জয়েন্ট কমিশনার রজত তার বন্ধু ধরনী কয়াল ওরফে ডিকে-এর সাহায্য চায়। রিয়াজ ও ডিকে কী পারবে এই রহস্যের সমাধান করতে?
গোটা উপন্যাসটি ৪টি খণ্ডে বিভক্ত, যথাক্রমেঃ
১। ধর্মঃ মিউজিয়াম থেকে মূর্তি চুরি, তিব্বতী লামার সাথে কবীর খানের জড়িয়ে পড়ার মোটিভ, গল্পের ভিতরে গল্প স্টাইলে ঐতিহাসিক উপন্যাস বর্ণনা
২। অর্থঃ মূল ঘটনাগুলোর একেবারে গোড়ার কথাগুলো তুলে ধরা এবং গল্পে একে একে প্রধান চরিত্রদের প্রবেশ ও তাদের একটা স্কেচ উপস্থাপন
৩। কামঃ প্রধান চরিত্রদের ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট, মূল ঘটনাগুলো এক জায়গায় এসে সমান্তরালে গতিময়তা লাভ করা এবং সাসপেন্সপূর্ণ এক ক্লাইম্যাক্স এর ইঙ্গিত
৪। মোক্ষঃ গল্পের ক্লাইম্যাক্স ও চূড়ান্ত পরিণতি
দুটি আলাদা টাইমলাইনের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং দ্বন্দ্বের ব্যাপারগুলো খুবই জটিল ও সেনসিটিভ ছিল কিন্তু লেখক সেগুলো বেশ ভালোভাবেই হ্যান্ডল করেছেন। যথার্থ ভাষায় বিশ্বাসযোগ্যভাবে কাহিনী উপস্থাপন করেছেন যেটা বেশ কঠিন ছিল। বিরাট বড় একটা সময়কাল ও ইতিহাসকে এভাবে গল্পে ধারণ করাটা যে ভীষণ সময়সাপেক্ষ ও পরিশ্রমের কাজ ছিল তা বলাইবাহুল্য। সমস্ত ইভেন্টগুলো একেবারে খাপে খাপে মিলে গেছে, কোথাও তাল কেটে যায়নি।
বইটি যাদের ভালোলাগতে পারেঃ
১। যারা ইতিহাস ও কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন নিয়ে পড়তে ভালোবাসেন
২। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে যারা আগ্রহী
৩। অত্যাচারিত মানুষের প্রতি যাদের সিমপ্যাথি ও এমপ্যাথি আছে
৪। যারা নিজভূমে পরবাসী হয়ে আছেন
একশনে ভরপুর মারকাটারি থ্রিলার বইয়ের মতো একেবারে শুরু থেকেই পাঠককে একদম রোলার কোস্টারের রাইডের এক্সপেরিয়েন্স দেবে তেমন বই নয় এটি। গল্পের প্রয়োজনেই লেখককে অনেকটা সময় নিতে হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষঙ্গ, তিব্বতের ইতিহাস, চীন কর্তৃক তিব্বত দখলের বর্ণনায়; কারণ এই তথ্যগুলো মূলত গল্পের মোটিভ ঠিকঠাকভাবে বুঝে নেওয়ার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সুতরাং বোঝাই যায় যে ইতিহাসের অনেক ডিটেলস এর মুখোমুখি আপনাকে হতে হবে। আসলে এই বইটির শক্তিশালী দিক হলো - জটিল ইতিহাসকে সহজ-সরল উপস্থাপন, গল্পের ডিটেইলিং ও দুটি আলাদা টাইমলাইন-এর মাঝে সামঞ্জস্য।
যেখানে খটকা লেগেছে?
উপন্যাসটির বেশ কিছু জায়গায় "কিন্তু" মনে হয়েছে। বিস্তারিত বলতে গেলে স্পয়লার হয়ে যাবে তাই সংক্ষেপে কয়েকটা বলিঃ
১। গল্পের তিব্বতী বিপ্লবী সংগঠন "চুসি গাংদ্রুক"-কে যতটা ভয়ঙ্কর ও বেপরোয়া হিসেবে বলা হয়েছে, কাজে তাদেরকে ততটাই নিষ্প্রাণ ও নিষ্প্রভ মনে হয়েছে।
২। জয়েন্ট কমিশনার রজত রায়ের বন্ধু ধরনী কয়াল ওরফে ডিকে যেভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পুলিশি তদন্তের মাঝে ঢুকে গেলেন বাস্তবে তার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয়না।
৩। যে সমস্ত সূত্র পাওয়া গেছিলো সেগুলো দিয়ে দারুণ একটা তদন্ত হতে পারতো, কিন্তু তদন্ত প্রক্রিয়াটি নিয়ে তেমন কিছুই দেখা যায়নি।
৪। গল্পের এন্ডিং যেন হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেলো! শুরু থেকে কাহিনী যেমন আকর্ষণীয়ভাবে এগিয়ে চলছিল, এন্ডিং ঠিক ততটাই সাদামাটা।
ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক - দুই দিক থেকেই দেখতে গেলে বেশ ইন্টারেস্টিং একটা গল্প ছিল। দুটি আলাদা টাইমের প্রচুর অজানা তথ্য আছে বইতে। এটাকে ঠিক "Light Read Book" ক্যাটেগরিতে ফেলা যাবে না। এইদিকটা মাথায় রেখে বইটি পড়তে বসাই ভালো হবে, তাহলে আশা করছি বেশ ভালো একটি সময় কাটবে বইটির সাথে।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....