- কীভাবে পড়বেন? কীভাবে বুঝবেন? কীভাবে মুখস্থ করবেন?
- লেখক : আব্দুল আজিজ বিন মুহাম্মাদ আস-সাদহান
- প্রকাশক : রুহামা পাবলিকেশন
- বিষয় : ইসলামি জ্ঞান চর্চা
পর-সমাচার :
এটি সর্বজনস্বীকৃত বিষয় যে, ইলম অন্বেষণ এবং তা অর্জনে চেষ্টা সর্বোত্তম নেক আমল এবং সর্বোচ্চ মর্যাদার বিষয়। আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহের পর ইলমের কল্যাণে মানুষ জানতে পারে, সে কীভাবে সঠিকভাবে তার রবের ইবাদত করবে। কীভাবে সে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং কীভাবে অসৎ কাজে বাধা দেবে। সে জানতে পারে কীভাবে কামনা ও সন্দেহের অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকবে ।
ইলম অন্বেষণের মাধ্যমেই মানুষ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আর এর মাধ্যমেই দুনিয়াতে বিভিন্ন কাজের তাওফিক এবং আখিরাতে উচ্চ মর্যাদা অর্জন করতে পারে। আর এভাবে সে অর্জন করতে পারে বিশাল অনুগ্রহ।
ইলম অন্বেষণে কিছু যুবকের চেষ্টা-সাধনা ও উদ্যম আশা জাগিয়ে তোলে। এটি পরস্পরকে সুসংবাদ দেওয়ার মতো বিষয়। তারা নিজেদের সময় ও সম্পদ ইলম অন্বেষণের পথে ব্যয় করছে এবং এ পথে নিজেদের শরীরকে ক্লান্ত করে তুলছে। এটি মহান একটি লক্ষ্য, প্রশংসনীয় একটি মনজিল এবং বিশাল এক মর্যাদা। বরং এটি আমাদেরকে প্রথম যুগের নেককার সালাফের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যারা ইলম অন্বেষণের উদ্দেশ্যে পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ—পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এমনকি তাঁদের হিম্মত এই পর্যন্ত পৌঁছেছে যে, তাঁরা একটি মাত্র হাদিস শেখার জন্য এক মাসের পথ অতিক্রম করেছেন। ইলমের জন্য তাঁরা যে পথ সফর করেছেন, তা বলার মতো নয়! আর ইলম অন্বেষণে চেষ্টা ও সফর অনেক বড় নেক কাজ। আলিমগণ এ ব্যাপারে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ ব্যাপারে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো, খতিব আল-বাগদাদি -এর লিখিত ‘আর-রিহলাতু ফি তালাবিল হাদিস' গ্রন্থটি। আর জীবনী ও ইলম অন্বেষণের আদবসংক্রান্ত গ্রন্থে এ ব্যাপারে যা লিখিত হয়েছে, তা অনেক বেশি; যা গণনা করা তো দূরের বিষয়, খতিয়ে দেখাও সম্ভব নয়।
যেহেতু ইলম অন্বেষণের জন্য সাধনা, সুবিন্যাস এবং কিছু নিয়মনীতির প্রয়োজন হয়, তাই ইলম অন্বেষণকারীকে এসব নিয়মনীতি শ্রবণের ব্যাপারে আগ্রহী হতে হবে। হয়তো আল্লাহ তাআলার সাহায্যের পর সে এগুলোর মাধ্যমে ইলম অর্জনে সাহায্যপ্রাপ্ত হবে ।
আমি আমার কিতাবের ভূমিকায় সকল তালিবে ইলমের জন্য প্রয়োজন এমন কিছু বিষয় উল্লেখ করব; চাই এগুলো তাদের মুখস্থ করা, বোঝা অথবা পাঠ করার ব্যাপারে হোক না কেন। এরপর আমি আমার সামান্য পুঁজি অনুযায়ী পড়া, বোঝা এবং মুখস্থ করার বিষয়ে সহজে বিস্তারিত কিছু আলোকপাত করব। বাস্তবতা হলো আমি অন্যের কাছ থেকে শুনে থাকি, আমার কাছ থেকে অন্য কেউ শুনে না ।
ইলম অন্বেষণকারীর জন্য আবশ্যকীয় কিছু বিষয় : এর মাঝে কিছু আছে, যা ইলম অন্বেষণের যেকোনো পদ্ধতির জন্য প্রযোজ্য
প্রথম বিষয় : দুআ করা
সব সময় আল্লাহর কাছে দুআ করতে হবে। আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে এর মাধ্যমে বন্ধ জিনিস খুলে যাবে। এটি দূরের জিনিসকে নিকটবর্তী করে দেবে। ছড়িয়ে থাকা জিনিসকে জড়ো করে দেবে এবং কঠিন বিষয়কে সহজ করে দেবে।
দুআ ও দুআর মর্যাদার ব্যাপারে আলোচনা এমন একটি বিষয়, যার প্রতি আলিমগণ অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তারা স্বতন্ত্র বহু পুস্তিকা রচনা করেছেন । বাস্তবতা হলো মানুষের মাঝে ইলম অন্বেষণকারী দুআর প্রতি সবচেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী। উপকরণের সাথে সাথে বান্দা আল্লাহর সামনে যতই মিনতি ও অনুনয়কারী হবে, তত বেশি সে তার দুআর ফল ও তাকে দেওয়া আল্লাহ তাআলার তাওফিক দেখতে পাবে, যা সে কখনো কল্পনাও করেনি।
দ্বিতীয় বিষয় : লক্ষ্য অর্জনে খালিস নিয়ত
গুণ বর্ণনাকারীর বর্ণনা বা প্রশংসাকারীর প্রশংসার অপেক্ষা করবেন না এবং কাউকে হতবাক করে দেওয়ারও অপেক্ষা করবেন না। যেকোনো ইবাদতের ক্ষেত্রে এটি হলো, সর্বপ্রথম ধ্বংস ও অবাধ্যতা। বিশেষ করে ব্যাপারটি যখন ইলম অন্বেষণের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়, তখন আরও ভয়াবহ হয়; কারণ, এটি এমন এক ইবাদত, যা শ্রবণকারী, পাঠকারী এবং যার কাছে আপনি পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন, তার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে। সুতরাং আপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেন হয় আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি।
এখানে এমন একটি বিষয় আছে, যাতে শয়তানের ভাগ রয়েছে। সেটি হলো কোনো কোনো ইলম অন্বেষণকারী যখন বারবার তার নিয়ত সংশোধন করে নেওয়ার পরও দেখে যে, নিয়ত পরিপূর্ণ সংশোধন হয় না, তখন তার ওপর শয়তান বিজয়ী হয়ে যায়। ফলে শয়তান তাকে ইলম অন্বেষণ ও এর জন্য চেষ্টা করতে বাধা প্রদান করে । আলিমগণ এটি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তালিবে ইলমের জন্য সবচেয়ে বড় শয়তানের কুমন্ত্রণা হলো এটি । সুতরাং তালিবে ইলমকে নিয়তকে একমাত্র আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করে নিতে হবে এবং এ ব্যাপারে সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। আর যখনই শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দেবে, তখন তাকে অব্যাহতভাবে সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। আর এটিও ইবাদত এবং আল্লাহর পথে এক ধরনের মুজাহাদা ।
তৃতীয় বিষয় : গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা
পাপ দূষিত জিনিস। এটা প্রতিটি কল্যাণ অর্জনের পথে শক্ত প্রাচীরের ন্যায় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। আর একজন তালিবে ইলমকে গুনাহ পরিত্যাগ এবং তা থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের চেয়ে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।
ইবনে মাসউদ বলেন, “আমি মনে করি মানুষের ইলম ভুলে যাওয়ার কারণ হলো, ভুলে (গুনাহে লিপ্ত হওয়া।”
আলি বিন খাশরাম বলেন, 'আমি ওয়াকি বিন জাররাহ এর হাতে কোনো কিতাব দেখলাম না; অথচ তিনি আমাদের চেয়ে বেশি বিষয় মুখস্থ করতেন। এতে আমি বিস্মিত হলাম। আমি তাকে প্রশ্ন করে বললাম, “হে ওয়াকি, তুমি কোনো কিতাবও নিয়ে আসো না এবং সাদা জিনিসে (কাগজে) কালো কিছু লেখো না; অথচ আমাদের চেয়ে বেশি বিষয় মুখস্থ করো?!”” তখন ওয়াকি—আলির কানে চুপিসারে–বললেন, “হে আলি, যদি আমি তোমাকে ভুলে যাওয়ার চিকিৎসা বলে দিই, তাহলে কি তা আমল করবে?' আমি বললাম, ‘আল্লাহর শপথ, অবশ্যই।' তিনি বললেন, ‘গুনাহ ছেড়ে দেওয়া।' আল্লাহর শপথ, আমি মুখস্থের জন্য গুনাহ পরিত্যাগের চেয়ে অধিক উপকারী কোনো জিনিস দেখিনি।
এ কারণেই শাফিয়ি -এর কবিতায় উল্লেখ রয়েছে :৩
*** فأرشدني إلى ترك المعاصي *** ونور الله لا يؤتى لعاصي سوء حفظي شكوت إلى وكيع . وقال اعلم بأن العلم نور
‘আমি ওয়াকি-এর নিকট আমার দুর্বল মুখস্থশক্তির ব্যাপারে অভিযোগ করলাম। তিনি আমাকে গুনাহ ছেড়ে দিতে নির্দেশ করলেন । আর তিনি বললেন, “মনে রেখো, ইলম হলো নুর । আর আল্লাহর নুর কোনো অবাধ্যকে দেওয়া হয় না । ””
২. সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৬/৩৮৪।
৩. এই কবিতাটি ইমাম শাফিয়ি -এর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারে কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করেছেন। তার কারণ হলো ইমাম শাফিয়ি ওয়াকি -এর ছাত্র ছিলেন না। এর উত্তরে বলা হয়, ইমাম শাফিয়ি তার কিতাবুল উম্ম-এর কিতাবুস সদাকাতে ওয়াকি-এর ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। আর এই কবিতাটি তো ইমাম শাফিয়ি -এর ব্যাপারেই প্রসিদ্ধ হয়েছে।
চতুর্থ বিষয় : আলিমদের জীবনী পাঠ করা
এটি অনেক উপকারী একটি বিষয় । সুতরাং আপনি ইলমের হাফিজ ও মুহাদ্দিসিন ও অন্যান্যদের জীবনীসংক্রান্ত গ্রন্থগুলো পাঠ করুন, তাহলে বিস্ময়কর অনেক কিছু দেখতে পাবেন। যদি সনদ ও সংবাদের ধারাবাহিকতা না থাকত, তাহলে অনেক বাস্তব বিষয়কেও অস্বীকার করা হতো। কারণ, মানুষ তাদের দৃঢ়তার শক্তি, বুঝের বিশালতা এবং রচিত গ্রন্থসমূহের সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । জীবনীসংক্রান্ত গ্রন্থ অনেক । তবে এর মাঝে সবচেয়ে উপকারী কিছু গ্রন্থ হলো ‘তাজকিরাতুল হুফফাজ’ এবং ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা' । দুটিই ইমাম আজ-জাহাবি -এর রচিত গ্রন্থ। আর সকল মাজহাবের ইমামদের জীবনী নিয়ে রচিত গ্রন্থসমূহের কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।
যা-ই হোক, তালিবে ইলমের জন্য উচিত হলো, জীবনীসংক্রান্ত গ্রন্থ পাঠের জন্য নিজের কিছু সময় বরাদ্ধ রাখা; যেন পূর্ববর্তী মহা মনীষীদের জীবনী পাঠ করে তার হিম্মত শক্তিশালী হয় এবং তার দৃঢ়তা মজবুতি লাভ করে ।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....