কলির কথা শুনে সায়ন হাসে!

অনেকদিন পর একটা বই নিজের মতো করে লিখে শেষ করতে পারলাম। বই না বলে উপন্যাসিকা বলাই উত্তম। টেনে-টুনে ৮০ পাতা হবে। এবং লেখাটাও আদপে অ্যাডাপ্টেশন। যদিও মূল গল্প ৩৫-৩৬ পাতার। লিখতে গিয়ে নিজের মতো করে সাজাতে সাজাতে হয়ে গেল বড়ো!

কিন্তু ৮০ পাতার বই কে ছাপায়? কার কাছেই বা যাই? আমার অনুবাদ বই যত বিক্রি হয়, মৌলিক বই ঠিক ততটা হয় না। কিংবা নিজের প্রকাশনীর বাইরে যাই না বলে ততটা ছড়ায় না। যেটাই হোক: দিন শেষে কথা একই--ডাউন মার্কেট লেখক। তাই অন্যকে চাপ দিয়ে লাভ নেই।

অত্যন্ত হালকা ধাঁচে লেখা এই উপন্যাসিকাটির নামও হালকা ধাঁচের। খুব উচ্চমার্গীয় কিছু নেই। আবার ফেলনা না বলেই মনে করি। মূল লেখক অ্যান্থনি হরোউইটয। আমার বইটির নাম: কলির কথা শুনে সায়ন হাসে। এখনও জানি না বইটি নিয়ে কী করবো! শুধু ই-বুক আমার ভালো লাগে না। ই-বুক থাকুক, তবে শক্ত বইয়ের সাপোর্টার হিসেবে। আবার এটাও তো ঠিক, ই-বুকের চাইতে ফিজিক্যাল কপির দাম অনেক বেশি থাকে!

সেসব চিন্তা নাহয় ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। আপাতত একটা দুটো চ্যাপ্টার শেয়ার করি আপনাদের সঙ্গে। সমালোচনা কাম্য, প্রশংসা আরও বেশি করে কাম্য।

কলির কথা শুনে সায়ন হাসে

এক

কলি হাসান!

কেন রে বাবা, এর চেয়ে সুন্দর সুন্দর আর আধুনিক নাম কি আর ছিল না? আব্বু-আম্মু দুজনের নামই ক দিয়ে শুরু, তাই নাকি ওর নামটাও ক দিয়েই রেখেছেন তারা। বেশ তো, এমন আধুনিক নামের কোনো কমতি আছে নাকি? 

কাব্য হাসান...কী সুন্দর একটা নাম। সাপও মরে, লাঠিও ভাঙে না। অথবা কথামৃত হাসান। অবশ্য কথামৃত মানে কি তা জানে না কলি, শুনতে ভালো লাগে যখন তখন অর্থও ভালো কিছুই হবে। দেশের সেরা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে সে, নামটা তাই একটু ইংরেজি হলেও সমস্যা ছিল না। কেন? ওর সবচেয়ে কাছের দুই বান্ধবীর নাম তেমন না? অদৃতা অনন্যা, কী দারুণ একটা নাম! শুনলেই মনে হয়, খুবই কালচারড আর সফিসটিকেটেড হবে এই নামধারী মেয়েটা। কিংবা ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিক্কি চৌধুরী...নিকি না কিন্তু! এই নামটা ছোট্ট, কিন্তু কী আধুনিক!

অথচ ওর নাম?

কলি হাসান। সেই মান্ধাত্তা আমলে বাংলা নাম!

চোদ্দো বছর বয়সি কলি হাসানের মনে তাই অনেক দুঃখ। নাম দিয়ে দুঃখ, নিজের খানিকটা রুঠা চেহারা, পাতলা-সাতলা ছোট্ট দেহ আর বিবর্ণ চেহারা নিয়েও দুঃখ, বয়সের তুলনায় বাড়েনি বলে বান্ধবীরা সপ্রংশ দৃষ্টি পেলেও নিজে তার কিছুই পায় না বলে দুঃখ...

...দুঃখ সবার থেকে একটা বিশেষ বিষয়ে আলাদা বলেও।

ও লেভেল পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে সে সামনের বছর। দক্ষিণ ঢাকার একটা নামি ইংরেজ মিডিয়াম স্কুল, লোগিয়াতে পড়ে। ইংরেজিতে চরম দক্ষ, বাংলায় ততটাই অদক্ষ। ইতিহাস আর ভূগোলেও খারাপ না। কিন্তু বাংলাটা ওর ঠিক আসে না। সেই সঙ্গে আসে না গণিত। শুধু গণিত না, অঙ্ক-টঙ্ক আছে এমন বিষয়েই পাশ করতে হিমশিম খেতে হয়। 

অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রী আর শিক্ষকরা তাকে খুব একটা পছন্দও করে না, আবার অপছন্দও করে না। জীবনের সব দিক দিয়ে তাই ওকে গড়পড়তা বলা যায়। কিন্তু হ্যাঁ, একটা কারণে আবার সে সবার থেকে আলাদাও।

সেটা হলো: কলি হাসান কানে শুনতে পায় না!

নাহ, কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়নি মেয়েটা। পুরো ব্যাপারটাই আসলে দুঃখজনক। কনজেনিটাল, মানে জন্মগত সমস্যা বেচারির এই কানে শুনতে না পাওয়াটা। গর্ভবতী থাকা অবস্থায় ওর মা, কাজিমা হাসান, হামে আক্রান্ত হন। ডাক্তাররা তো ভয়ই পেয়ে গেছিল, কাজিমা হাসানের গর্ভপাতই হয়ে যায় কি না!

তবে ও জন্মাবার পরপরই বাবা-মা বুঝে যান: কোথাও কোনো কিন্তু আছে। মেয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে জন্ম নেয়নি! পরে যখন কলি কিছুটা বড়ো হয় তখন একের-পর-এক ডাক্তার দেখান তারা, জানতে চান—মেয়ের কী হয়েছে এবং তার চিকিৎসা কী! দেশের ডাক্তারদের ওপর খুব একটা ভরসা নেই তাদের। বলেন: তারা ভালো হলে তো বাচ্চা জন্মাবার আগেই কিছু একটা পদক্ষেপ নিয়ে নিতে পারত। 

যত দোষ, নন্দ ঘোষ আরকি!

যাই হোক, হিল্লি-দিল্লি আর ব্যাংকক-বুংকক ঘুরে আসার পর জানা যায়—কলির সমস্যার নাম আছে একটা: সেন্সরি নিউরোনাল ডেফনেস। আর নাহ, পুরোপুরি কালা নয় মেয়েটা। শুনতে পায় বটে, তবে আলাদা করে পার্থক্য করতে পারে না। ওর কানের একটা অংশ—ককলিয়া যার নাম—পুরোপুরি কর্মক্ষম নয়। উঁচু কম্পনের শব্দগুলো মোটামুটি ধরতে পারে বেচারির অসুস্থ কান। কিন্তু এর বেশি কিছু ধরতে পারে না।

এই সমস্যা নিয়েও বেঁচে তো থাকতে হবে। তাই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ আর লিপ রিডিং, দুটোই শেখানো হলো কলিকে। বাবা-মা দুজনেই চাকরি করেন। মা কম্পিউটার পোগ্রামার, একটা ফার্মের সফটওয়্যার ডিভিশনের প্রধান; আর বাবা মাল্টিন্যাশনাল ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। ওহ, কলির বাবার নাম তো এখনও পর্যন্ত বলাই হয়নি: কে.ইউ. হাসান। কে মানে কলিম আর ইউ মানে উদ্দীন।

কলি তাই নিজেকে মাঝে মাঝে সান্ত্বনা দেয়: আমার নাম তো তাও চলে, কিন্তু পাপা?

আপনমনে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে পরক্ষণেই।

সে যাই হোক, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ আর লিপ-রিডিং শিখলেও, খুব একটা কাজে লাগাবার দরকার হয় না ওটা। প্রিয় পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন? ওর বাবা-মা আলাদা একটা সামাজিক স্তরে বাস করেন। যে স্তরে বাংলাকে ছোটো করে দেখা হয়, বাংলাদেশকে ধরা হয় তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আর এদেশের মানুষকে? 

সেটা নাহয় আন্দাজ করে নিন।

অবশ্য সমস্যা হলো: এই স্তরটি ঠিক সবচাইতে উপরের স্তর নয়। উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা হয়তো টেনে-টুনে। এরা টাকা তো কামায়, কিন্তু খানিকটা উন্নত বিশ্বের কোনো শহরে থাকার পর্যায়ে যেতে পারে না। আবার যা কামায়, তা দিয়ে দেশে রাজা-বাদশাহের হালে থাকতে পারে! ছেলে-মেয়ের দিকে নজর কমই থাকে, ক্যারিয়ারই তাদের ধ্যান-জ্ঞান। কিছু হলেই ছোটে ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর, আবার ওখানে যে চিরতরে চলে যাবে...সেই যোগ্যতাটুকুও নেই।

তবে কিনা, পিতার অপরাধের দায় পুত্রের ওপর বর্তায় না। আর আমাদের গল্পের মূল চরিত্রও কলি। তাই আমরা ওর বাবা-মাকে নিয়ে যত কম মাথা ঘামানো যায়, ততটাই নাহয় ঘামাই। অবশ্য ন্যাচার বনাম নার্চারের যুদ্ধে, জয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নার্চারেরই হয়। সেজন্য বস্তুত কলি যত মিষ্টি মেয়েই হোক না কেন, বাবা-মায়ের মানসিকতার প্রভাব খানিকটা হলেও তো পড়বে তার ওপর!

যেটা বলছিলাম, লিপ-রিডিং আর সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ জানলেও সেগুলো কলির ব্যবহার করার দরকার হয় না। মেয়েকে সময় দিতে পারুন আর না-পারুন, তার পেছনে টাকা ঢালতে কার্পণ্য করেননি ওর বাবা-মা। লোগিয়াতে ক্লাস শুরু করার সময়ই বিশেষ একটা হেয়ারিং এইড জার্মানি থেকে কিনে এনেছেন তারা। দারুণ একটা যন্ত্র ওটা, কানের পেছনে লাগাতে হয়। দুটো আলাদা সেটিং আছে—গতানুগতিক কথোপকথন শোনার জন্য ব্যবহার করা যাবে। 

অথবা চাইলে ওটাকে লাগিয়ে দেওয়া যাবে আরেকটা বাক্সের সঙ্গে, বাক্সটা আকারে ম্যাচ বাক্সের চাইতে খানিকটা বড়ো হবে আকারে। এইটা ক্লাসে স্যার-ম্যামদের কথা শোনার জন্য ব্যবহার করে কলি। যার ক্লাস, তিনি আরেকটা একই রকম বাক্স বহন করেন। শিক্ষক কথা বলেন, সেই কথা ওই বাক্সের সাহায্যে এসে পৌঁছায় কলির কানে। শুনতে একদম বেগ পেতে হয় না কলিকে। বিশেষ এই বাক্সটা হিপ পকেটে সবসময় রাখে সে।

যন্ত্রটার ব্যবহার এতটাই সহজ যে নিজেকে কলির কখনও কালা কিংবা পঙ্গু কিংবা আলাদা কিছু বলে মনে হয় না। অনেকগুলো বছর ধরে ব্যবহার করতে করতে ওটা দেহের অংশই হয়ে গেছে। তাছাড়া এদিক-সেদিক করে আরও কিছু ক্ষেত্র খুঁজে বের করেছে কলি, সেসব পরিস্থিতিতে হেয়ারিং এইডটা স্বর্গের আশীর্বাদ বলে মনে হয়।

যেমন?

এই যেমন মি. তাফসিরের অঙ্ক ক্লাসের কথায় ধরা যাক। কলির কাছে ক্লাসটা এত্ত বিরক্তিকর লাগে যে আর কী বলবে! দিনের-পর-দিন, একরকম ঘুমুতে ঘুমুতে ক্লাসটা করতে হতো ওকে। কিন্তু একদিন মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল, হিপ পকেটে থাকা বাক্সটার ভলিউম বাটন নিয়ে ওপর-নিচ করতে গিয়ে কী ভেবে যেন ওটাকে একেবারে নামিয়ে দিল একেবারে নিচে।

ব্যস, বিরক্তিকর মি. তাফসিরের হাত থেকে চিরতরে মুক্তি!

আরেকটা ব্যবহার অবশ্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ! ভাবছেন, বিরক্তিকর শিক্ষকের একঘেয়ে ক্লাস থেকে মুক্তি পাবার চাইতে জরুরি আর কী হতে পারে? শিক্ষকের প্রশ্নের জবাব না পারলে সেই ফাঁদ কেটে বেরিয়ে আসা। যে প্রশ্নের উত্তর কলির জানা যেন, সেই প্রশ্ন করা হলে এমন ভান করে যেন যন্ত্র কাজ করছে না! 

শিক্ষক-শিক্ষিকার চাপে থাকে। অনেক পয়সা খরচ করে বাচ্চাদেরকে এই স্কুলে পড়ান বলে, তাদের বাবা-মায়ের অনেকটাই স্পর্শকাতর আচরণ করে। পান থেকে চুন খসলেই তাদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। তাই অন্তত কলির কানের সমস্যার প্রসঙ্গ আসলে যেন পালিয়ে বাঁচে তারা! দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করতে যায় না। ফলাফল?

ফাঁদ থেকে কলির মুক্তি। 

তবে একথাও সত্যি যে যন্ত্রটা মাঝে-মধ্যে উলটোপালটা আচরণ করে বটে! কোনো এক ছুটির মৌসুমে চুপচাপ বসে ছিল কলি। আচমকা জনপ্রিয় সবগুলো রেডিয়ো স্টেশন ধরতে শুরু করে ওর বাক্স। নাহ, এমন গোলমালে অখুশি হয় না কলি। প্রথম দিকে অবশ্য একটু চমকে উঠেছিল মেয়েটা। কিন্তু কদিন পরেই দেখা গেল, সবাইকে ভূত এফএমের গল্প শোনাচ্ছে।

বলাই বাহুল্য, লোগিয়া ইন্টারন্যাশনাল স্কুল আবাসিক নয়। বাংলাদেশে আবাসিক ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল নেই। তাই ক্লাস শেষে ওকে বাসায় ফিরতে হয় হালিমা খালার সঙ্গে। স্বামী পরিত্যক্তা হালিমা খালার বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়। তাই তার ভাষা বুঝতে ভালোই বেগ পেতে হয় কলির, এমনকী কানে হেয়ারিং এইড লাগানো থাকলেও। অথচ কিচ্ছু করার নেই, বাবা-মায়ের সময় কই মেয়েকে দেবার মতো? তারা তো ব্যস্ত যার যার ক্যারিয়ার নিয়ে।

বাড়িতে গিয়েও একঘেয়ে সময় কাটে বেচারির। ভাই-বোন নেই ওর। হয়তো প্রথমবারের চেষ্টায় পুরোপুরি সফল হতে ব্যর্থ হয়ে, ওর আব্বু-আম্মু আর বাচ্চা নেবার চেষ্টাই করেননি! প্রশ্নটা অবশ্য জিজ্ঞেস করার মতো সাহস জোগাতে পারেনি বেচারি। কিছু বলেও লাভ নেই, একটাই জবাব পায়: কী লাগবে বলো, এনে দিচ্ছি।

তোমাদেরকে লাগবে—অনেকবার বলতে ইচ্ছে হলেও, নাটকীয় কথাটা কলি কখনও বের করতে পারেনি মুখ দিয়ে।

অবশ্য খুব যে দরকার, তাও না। অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে কলির। লেখাপড়ায় খারাপও না খুব একটা, তাই স্কুল ওর কাছে আতঙ্কের সমার্থক হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া এক বছর পরেই আরেকটি স্কুলে চলে যাবে, দেশের বাইরে যাবার কথাও হচ্ছে। জীবনকে তাই উপভোগ করে কলি হাসান।

কিন্তু ওর তো আর জানা ছিল না, নতুন স্প্যানিশ শিক্ষক আসতে যাচ্ছে স্কুলে। যার নাম—মি. সায়ন চৌধুরী। 

এটাও জানা ছিল না, মি. সায়ন ওর জন্য বয়ে আনছে দুঃস্বপ্নের একখানা বহর!

সায়ন স্যার দেখতে খারাপ না, তবে চেহারায় বিষণ্ণ একটা ভাব আছে। মনে হয় যেন পালাচ্ছে পৃথিবীর কাছ থেকে। যুবক বলা যাবে না তাকে, আবার ঠিক বুড়োও বলা যাবে না। মাঝখানে কোথাও আটকে আছে যেন। অধিকাংশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ইংরেজির পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ শেখার ওপর জোর দেওয়া হয়। কারণ যেসব দেশে ইংরেজি চলে, সেগুলোতে ফ্রেঞ্চও চলে ভালোমতোই। কিন্তু লোগিয়ার প্রিন্সিপালের মতে—ইংরেজি দিয়ে যদি ফ্রেঞ্চের কাজ চলে, তাহলে অতিরিক্ত আরেকটা ভাষা শেখাই ভালো না?

যাই হোক, একেবারে স্বাভাবিক পোশাক পরে সায়ন: শার্ট-প্যাট-টাই, গায়ে চড়ায় ব্লেজার। শীত হোক বা গরম, এই ব্লেজার তার গায়ের সঙ্গে লেগেই থাকে! তবে পোশাকগুলো দেখে বয়স্ক মনে হয়, অনেক পুরাতন। চোখ কালো, চুল কালো ও কোঁচকানো। অগোছালো দাড়ি ঢেকে রেখেছে তার চিবুক। শারীরিক ভাবে বেশ বড়োসড়ো, ছয় ফুটের কাছাকাছি হবে। দেখেই বোঝা যায়, মাংসপেশির অভাব নেই তার দেহে। অথচ আচরণে পরাজিতের ভাব স্পষ্ট, কাঁধ ঝুঁকে থাকে সবসময়। চোখ বারবার পিটপিট করে, হাসে না বললেই চলে!

সেমিস্টারের একেবারে প্রথম দিনেই কলির সঙ্গে দেখা হলো মি. সায়নের। ওদের স্কুল, মানে লোগিয়া ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, একেবারে বিদেশি স্কুলের আদলে বানানো। লম্বা লম্বা, প্রশস্ত করিডর; এক পাশে ক্লাসরুম, অন্যপাশে লকার কিংবা দেওয়াল। মাঝখানের অংশটুকুতে অবশ্য উভয়পাশেই ক্লাসরুম আছে। 

তো সেদিন ওর সবচাইতে কাছের বান্ধবী, অদৃতার সঙ্গে করিডর ধরে হাঁটছিল কলি। ‘অপ্রস্তুত আলোতে অনন্যতার অধিকারিণী অদ্ভুত আবেশে আমাকে আপ্লুত করে,’ পছন্দের অভিনেত্রীর ব্যাপারে বলছিল অদৃতা। কিন্তু সমস্যা হলো, কলির বাংলাটা ঠিক ‘না আসলেও’ অদৃতার আসে; ভালোভাবেই আসে। কলির বাংলা ভোকাবুলারি দুর্বল হলেও, অদৃতার শব্দভাণ্ডারে কোনো খামতি নেই। তাই সাধারণত বাংলা বলে আর সেটা ইংরেজিতে শোনায় মেয়েটা, নইলে কলি বুঝতেই পারত না কিছু। এখানেও সেই ন্যাচার ভার্সেস নার্চার—অদৃতার বাবা-মা এইদিকে খুবই স্ট্রিক্ট। ইংরেজি যত ইচ্ছে শেখ, অসুবিধে নেই; তবে বাংলা পারতেই হবে—কড়া নির্দেশ তাদের।

‘হোয়াট আই মিন টু সে ইজ,’ নিজের কথা তরজমা করতে শুরু করেছিল অদৃতা, কিন্তু তার আগেই হন্তদন্ত হয়ে শিক্ষকদের লাউঞ্জ থেকে ধুপ করে বেরিয়ে এলো মি. সায়ন। ওদের দিকে একবারের জন্যও না তাকিয়ে, হন হন করে হেঁটে গেল ক্লাসের দিকে। হতভম্ব কলিরা কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই ওদেরকে অতিক্রম করল সায়ন, তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে কলির কাঁধ স্পর্শ করল তার হাত।

একেবারে অল্প সময়ের জন্য। সেকেন্ড বললেও বেশি হয়ে যাবে...বড়োজোর এক পিকো কিংবা ন্যানো সেকেন্ড হবে। তবে ওইটুকু সময়ের মাঝে ঘটে গেল যা ঘটার...

...কেঁপে উঠল কলি। আর বুঝতে পারল: ওর জীবন পুরোপুরি বদলে যাচ্ছে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ