মহানবী সা.-এর বিনয়
মসজিদে নববি তখন খেজুর পাতায় ছাওয়া। সামান্য বৃষ্টিতে মসজিদের ভেতরটা ভিজে একাকার হয়ে যায়। মসজিদে নববিতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসা। তিনি মানবতার মুক্তির কথা বলছেন। বলছেন সফলতার কথা। চারদিক নীরব। নিস্তব্ধ। কোনো সাড়া-শব্দ নেই। প্রিয়নবীকে ঘিরে বসে আছেন একদল ত্যাগী সাহাবি। যেন একঝাঁক মৌমাছি মৌচাকে বসে আছে।
নবীজির দরবারের বৈঠক সাহাবিদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। তাই অধীর আগ্রহে বসে আছেন সবাই। এমন সময় মসজিদের দরজায় কেউ এলো। দেখা গেল সে এক ইহুদি। আসতে আসতে সে নবীজির একেবারে কাছে চলে এলো। “কি ব্যাপার? কেন সে এখানে এসেছে?' সবার মনে এই প্রশ্ন।
লোকটির চেহারা দেখতেই মনে হলো, তার তনু-মন রাগে ভরা। এসেই ঝাঁজালো কণ্ঠে বলতে লাগল, মুহাম্মদ! ইজ্জত থাকতে আমার পাওনা পরিশোধ করে দাও। আসলে তোমরা বংশগতই এমন, মানুষের ঋণ নিয়ে টালবাহানা কর। আরো যা তা গালি-গালাজ করল সে। প্রতিউত্তরে নবীজি হাসিমাখা সুরে বললেন, আপনার ঋণ পরিশোধের আরো দুইদিন বাকি আছে। সময়মতো পাওনা অবশ্যই পাবেন। আপনার ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ করে দেব।
কঠোরতার জবাব দিলেন কোমলতার দ্বারা। ইহুদি যতই গরম দেখাল, নবীজি ততই নরম হলেন। দরদমাখা কথায় তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু না, ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। নবীজির এত মোলায়েম ব্যবহারেও ইহুদি ক্ষান্ত হলো না। সে আরো কর্কশ ভাষায় কথা বলতে লাগল। এমনকি একসময় সে সাহাবিদের সামনেই নবীজির জামার কলার চেপে ধরল এবং এক্ষুণি পাওনা পরিশোধ করতে বলল ।
সাহাবায়ে কেরাম আর চুপ থাকতে পারলেন না। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাগে আগুন হয়ে গেলেন। তিনি রাগের সুরে বললেন, বেদীন কোথাকার! আজ এই মজলিসে না হয়ে অন্য কোথাও হলে, আমার এই খোলা তলোয়ারের আঘাতে তোর মাথা দুই টুকরা করে দিতাম।
কিন্তু নবীজি বড় বড় চোখ করে তাকালেন হযরত উমরের দিকে। ব্যাপারটা যেন উল্টো হয়ে গেল। হযরত উমরকে চাপা ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুমি ইহুদিকে কেন রুক্ষ ভাষায় কথা বলছো? তোমার উচিত ছিল আমাকে ঋণ পরিশোধ করতে বলা, আর তাকে ঋণ আদায়ে কোমল হতে বলা। এই মুহূর্তে উত্তেজিত হওয়া তোমার মোটেও উচিত হয়নি। যাও, এখনই তার ঋণ পরিশোধ করো! আর নিজের বাড়াবাড়ির জন্য তার পাওনা থেকেও কিছু বেশি দিয়ে দাও।
পুরো মজলিস একেবারে ‘থ’ হয়ে গেল। প্রিয়নবীর আদর্শ নতুন করে আলোড়িত করল সাহাবিদের ঈমানি হৃদয়কে। ওদিকে হেদায়াতের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ল ইহুদির মনের কোষে কোষে। ইসলামের মহিমায় অবাক হলো সে। তবে কি মানুষ এমন হতে পারে? এত কোমল মনের অধিকারী হতে পারে? সে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে লাগল হেদায়াতের রাজপথে।
ওদিকে হযরত উমর স্তুপকরা খেজুর মাপছেন তার পাওনা পরিশোধের জন্য। ইতোমধ্যে তার পাওনা পরিমাণ মাপা হয়ে গেছে। এবার পাওনার অতিরিক্ত অংশ মাপতে লাগলেন। ইহুদি সব দেখছিল। হঠাৎ মৃদু আওয়াজে বলে উঠল, ক্ষান্ত হও উমর! আর মাপতে হবে না। এক্ষুণি আমাকে আল্লাহর রাসুলের কাছে নিয়ে চলো,
তাকে নিয়ে যাওয়া হলো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে। সে নবীজির হাতে হাত রেখে পড়ে নিল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ-আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল - [সূত্র : সীরাতে ইবনে হিশাম]
সরে এলেন পেছনে
সাহাবি হযরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একবার তীব্র গরমের মৌসুমে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতুল বাকীর দিকে যাচ্ছেন। কয়েকজন সাহাবি নবীজির পেছনে পেছনে হাঁটছেন। নবীজি তাঁর পেছনে জুতার শব্দ শুনতে পেলেন। কেউ কেউ তাঁর পেছনে হেঁটে চলেছেন।
নবীজি এটাকে নিজের সম্মানের মাধ্যম মনে করলেন। লোকজন নিয়ে সামনে সামনে হাঁটতে পারলে যেমনটা মনে হয়। তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে পথিমধ্যে বসে পড়লেন। এরপর সাহাবায়ে কেরামকে সামনে চলতে বললেন। তিনি সরে এলেন পেছনে। যাতে অহংকারের বিন্দু পরিমাণও ভাব সৃষ্টি না হয়।
[সূত্র : আল্লাহওয়ালু কী মাকবুলিয়াত কা রায]
সাদাসিধে জীবন যার
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খাদেম হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোগীদের সেবা করতেন, মৃত লোকের জানাযায় শরিক হতেন এবং গোলামদের দাওয়াতও কবুল করতেন। আর প্রয়োজনে অন্যের পেছনে বসে গাধায় সওয়ার হতেও দ্বিধাবোধ করতেন না। খায়বার ও বনি কুরায়যার যুদ্ধে তিনি এমন ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়েছিলেন— যার লাগাম ছিল খেজুরের রশি, আর গদি ছিল খেজুরের ছাল দ্বারা তৈরি। [সূত্র : আল্লাহওয়ালু কী মাকবুলিয়াত কা রায]
আমিও তোমাদের মতোই
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের একটি জামাতের সঙ্গে কোথাও যাচ্ছেন। তখন সাহাবায়ে কেরাম রোদ থেকে বাঁচানোর জন্য নবীজির উপর চাদর দিয়ে ছায়া দিলেন। নবীজি ছায়া অনুভব করে উপরে মাথা মোবারক তুলে দেখলেন, চাদর দিয়ে ছায়া দেওয়া হয়েছে। তখন নবীজি বললেন, ‘এটি সরিয়ে ফেলো'। এরপর তিনি নিজেই তাঁর হাত দিয়ে টেনে মাথার উপর থেকে চাদর নামিয়ে নিলেন। আর বললেন, তোমাদের মতোই একজন মানুষ।' ‘আমিও
[সূত্র : মাজমাউয যাওয়াইদ, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ২১]
বসিয়ে দিলেন নিজের পাশে
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাবার খাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে অন্যরাও খাবারে শরিক আছেন। এমন সময় একজন বসন্ত রোগী এলো। তার শরীর বসন্তে ভরা। বসন্তের ক্ষত স্থানগুলো ঘায়ে দগদগে। লোকটি মজলিসের যে কারো সঙ্গে বসতে চাচ্ছে, পাশের লোকটি তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কেউ এই রোগীর পাশে বসতে রাজি হচ্ছে না। এ অবস্থায় রহমতের নবী লোকটিকে নিজের পাশে বসিয়ে খাবার খাওয়ালেন। [সূত্র : এহইয়াউ উলুমিদ্দীন, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩০৬]
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....