আমরা হেঁটেছি যারা PDF লেখক : ইমতিয়ার শামীম | Amra Heteci Jara - Imtiar Shamim

  • বই : আমরা হেঁটেছি যারা PDF [last update 10/7/2022] 
  • লেখক : ইমতিয়ার শামীম 
  • প্রকাশক : পেন্ডুলাম পাবলিশার্স  
  • পৃষ্ঠাসংখ্যা : ১৫৮
  • ফাইল টাইপ : পিডিএফ ডাউনলোড
  • মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ ৳

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক লেখক লেখিকা অনেক গল্প উপন্যাস লিখে গেছেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে লেখায় হাত দিয়েছেন তাদের সংখ্যা তেমন একটা চোখে পড়েনা। এক্ষেত্রে ইমতিয়ার শামীম বেশ সাহসিকতার পরিচয় দেখিয়েছেন। 
'আমার হেঁটেছি যারা' এই বইয়ের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পরবর্তী তিন দশক সময়ে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার রূপক বর্ণনা দিয়েছেন। 

উনিশো একাত্তর সালে তো শুধু পাকিস্তানী বাহিনী ছিলো। কিন্তু তাদের প্রস্থানের পর দেশে জলপাই বাহিনী, রক্ষী বাহিনী, রাত বাহিনী, লাল বাহিনী, রগকাটা বাহিনী, ইগল বাহিনী সহ আরও কত কত বাহিনীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে কেউ রাজনৈতিক দোহাই দিয়ে আবার কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করেছে, অত্যাচার করে গেছে সাধারণ মানুষদের উপর। 

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও কিন্তু দেশের পরিস্থিতি একটুও বদলায় নি, বরং দিনকে দিন আরও খারাপ হচ্ছে। সেই ভিন্ন ভিন্ন নামের বাহিনীরা কিন্তু আজও রয়ে গেছে শুধু পরিবর্তন এসেছে তাদের বেশভূষায়, মুখে পাতলা কাপড়ের বদলে এখন তারা এঁটেছে শক্ত মুখোশ। 

উপন্যাসের মূল চরিত্র তথাগতর বাবা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, দেশ স্বাধীন হওয়ার বছর দু'একের মধ্যেই একদিন গায়েব হয়ে যায় বাবা। কিন্তু যাওয়ার আগে নিজের আদর্শের বীজ বুনে দিয়ে গিয়েছিলেন তথাগতর মধ্যে।

বাবা চলে যাবার পর পালাক্রমে রাত বাহিনী আর রক্ষি বাহিনী তাদের তান্ডব চালাতে থাকে। এসবের মধ্যেই বাবার আদর্শ আর প্রায় সমবয়সী সৎবোন মনিষাকে অবলম্বন করেই দিন কাটছিলো তথাগতর। 

এরপর একদিন দেশে সেনা শাসন আসে। কিছুদিন পর বাবাও ফিরে আসে, সাথে ফিরে আসে তাদের সুদিন। তাদের বাড়িতে সেদিন আয়োজন করে ভাত রান্না হয়, খাওয়া শেষে গল্প হয়, আনন্দ হয় । তবে সে আনন্দ বেশিদিনের মেয়াদ নিয়ে আসেনি। হেমন্তের এক বিকেলে তাদের বাড়িতে জলপাই বাহিনীর লোক এসে বাবাকে নিয়ে যায়। এবারেও বাবা ফিরে আসে তবে এবার বাবা সাথে করে নিয়ে এসেছে নিজের ডেথ সার্টিফিকেট। 
এরপর মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলো, একসময় তথাগত স্কুল পেরিয়ে কলেজ পৌছে, গ্রামের বাড়ি মাঠ এসব ছেড়ে কলেজ হোস্টেলে উঠে । তার শহুরে জীবনের মনীষার জায়গা হস্তান্তরিত হলো মারিয়া আর মামুনের কাছে । 

দেশে আবার নতুন করে সেনা শাসন এলো। এক সময় মনীষাও হারিয়ে গেলো তথাগতর জীবন থেকে, এরপর মামুনও। 
আচ্ছা, প্রিয়জনেরা কি এভাবেই হারিয়ে যায়? 
বাবা, মনীষা, মামুন...
এরপর কার পালা?  


গতবছরের এ সময়েও ইমতিয়ার শামীমের লেখা সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না, এমনকি নামই শুনিনি কখনো । 'আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিক ঝিক' নামক উপন্যাসের মাধ্যমে ইমতিয়ার শামীম এর নামটা প্রথম শুনি ৷ কিছুদিন আগে দেখলাম এবছর কথাসাহিত্যে' বাংলা একাডেমি পুরষ্কার ২০২০’ পুরস্কার পেয়েছেন ইমতিয়ার শামীম। এরপর উনাকে নিয়ে মোটামুটি কয়েকজনের আলোচনা দেখে উনার বই পড়ার আগ্রহ হলো। ফলস্বরূপ এই বইটা পড়া। এর আগে 'আমাদের চিঠি যুগ কুউউ ঝিকঝিক' বইটা পড়া হয়েছে। দুটো বইয়েই সেনা শাসন সময়কালে দেশের দুটো জায়গারই দৃশ্যপট ব্যাখ্যা করেছেন। 

তবে 'আমরা হেঁটেছি যারা' এই বইয়ে অনেকটা খোলাখুলিভাবেই লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী তিনটি দশককে শব্দজালে বেঁধে ফেলেছেন মাত্র দেড়শ পৃষ্ঠার একটি বইয়ে। 

'আমরা হেঁটেছি যারা' উপন্যাস টিতে লেখক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তথাগতের মাধ্যমে আমাদের দেশের তৎকালীন পরিস্থিতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছেন সত্যিই এমন বাংলাদেশ কি আমাদের কাম্য ছিলো? 
যতদূর জানি ২০০০ সালে 'আমরা হেঁটেছি যারা' বইটা প্রথম প্রকাশিত হয়, দীর্ঘ ২০ বছর পর বইটির দ্বিতীয় মূদ্রণ প্রকাশিত হয়েছে। পেন্ডুলাম প্রকাশনীকে অনেক ধন্যবাদ বইটাকে নতুন করে পাঠকের সামনে নিয়ে আসার জন্য।

বইটাকে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দলিলও বলা যায়। ক্ষয়িঞ্চু, ব্যক্তি, প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদের বিকৃত উল্লাস এবং বিপন্ন অস্তিত্বের স্বরূপ উদঘাটনে লেখক আসলে তার সময়কেই পুননির্মাণ করেছেন। যারা ভালো বই খুঁজছেন এই বইটা অবশ্যই অবশ্যই পড়বেন।

তথাগতের সাথে আমরাও কি হাঁটি এক মহাকাব্যিক সময়ের পথে? তথাগতের যাত্রা কি আমাদের কালের এক সাহসী স্বাক্ষর?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর বুকে লুকিয়ে উপন্যাসের দু’মলাটের ভাঁজে তথাগত হাঁটে, নিঃসন্দেহে সাথে আমরাও। এখন ঠিক মনে পড়ছে না, একবার কোথায় যেন লিখেছিলাম- লেখকেরা বিকল্প ইতিহাস তৈরি করে। যে ইতিহাসে আস্থা রাখা যায় শাসকের ইতিহাস পাশ কাটিয়ে। হাজার দুয়েক বছরের জানা ইতিহাসও এমনই ইঙ্গিত আমাদের দেয়।

নানা সময়ে সক্রেটিসকে নিয়ে রচিত রচনাগুলোর চোখেই আমরা প্রাচীন গ্রীসকে দেখি আজ, সেসব শাসকের চোখে দেখি না যারা সক্রেটিসকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল। আমরা প্লেটোর চোখে তার সময় ও রাজনীতিকে দেখি। একইভাবে এরিস্টটলের চোখে দেখি, ইমাম গাজ্জালির চোখে দেখি, ইবনে খালদুনের চোখে দেখি, চসার-শেক্সপিয়ারের চোখে দেখি, সার্ত্রের চোখে দেখি, এডওয়ার্ড সাঈদের চোখে দেখি, চমস্কির চোখে দেখি….. শুধু যে দেখি তা না, আমরা আস্থাও রাখি।

মূলত শাসকের ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে হাঁটেন বলেই লেখকেরা সময়ের স্রোতে টিকে যান, দৃশ্যত ক্ষমতাহীন হয়েও। অথচ সবল পরাক্রমশালী কত কত শাসক হারিয়ে গেছেন কালের গর্তে! হ্যাঁ, অতীতের পরাক্রমশালী শাসকেরা কখনো টিকে যান, তবে সেটা অবশ্যই কোন না কোন লেখকের কলমেই। আর গত হয়ে যাওয়া সময়েরা আমাদের বলে, দৃশ্যত ক্ষমতা-অর্থকে শক্তিমান মনে হলেও কলমই শক্তিশালী। কলমের আঁচড় থেকে যায়, ক্ষমতা-অর্থ হারায়।

‘আমরা হেঁটেছি যারা’ পড়ে মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে শুরু করে প্রায় দুই হাজার সাল পর্যন্ত দেশের যে চিত্র ইমতিয়ার শামীম এঁকেছেন, যে দৃশ্যপটে আমাদেরও হাঁটিয়েছেন সেসব দৃশ্যপট এবং চিত্র নানা সময়ে রচিত ইতিহাসের চেয়েও শক্তিশালী। কেননা ব্যুরোক্রেসির নানান নিয়ম কানুন মেনে যে তথাকথিত ইতিহাস রচিত হয় তা হাঁটে সাধারণ মানুষের মননের বিপরীতে। কিন্তু ইমতিয়ার শামীম সাধারণের সাথে সাথেই হেঁটে গেছেন আর সাধারণের চোখে দেখা বিশ্বস্ত চিত্রই এঁকে গেছেন। কালের স্রোতে অগণিত ইতিহাস আস্তাকুড়ে চলে গেলেও ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ ছোট্ট নভেলায় ইমতিয়ার শামীম যে জনমনের ইতিহাস এঁকে গেছেন তা টিকে যাবে দীর্ঘকাল। একজন লেখক ঠিক এ দীর্ঘকালের প্রশ্নেই শক্তিশালী, অপ্রতিদ্বন্দ্বী- তার সামনে অজস্র ট্যাঙ্ক-বুলেট-মিসাইল, ফাসির দড়ি, জেলখানার নির্দয় গরাদও অসহায়।

‘আমরা হেঁটেছি যারা’ নভেলার গল্পটা নিয়ে কিছু বললাম না, কেননা যারা বইটা পড়বেন তারা নিজেরাই আবিষ্কার করবেন, গল্পটা মুখ্য নয়। গল্পের ভেতর দিয়ে লেখক যে যাত্রায় পাঠককে শামিল করেন, যে উপলব্দি বুকে ছড়িয়ে দেন, মাথায় যে চিন্তার পথ তৈরি করে দেন- সেসবই আসলে লেখক বলতে চেয়েছেন। গল্পটা ছিল বরং এক মশাল। কোন অন্ধকার পথে মশাল জ্বালালে আমরা যেমন পথ দেখি। ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ এর গল্পের ভেতর দিয়েও ইমতিয়ার শামীম আমাদের দেখাতে চান , স্বাধীনতার পর থেকে দেশ ও মানুষের জীবন কোন কোন পথে হেঁটে এদ্দুর এসেছে।
আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- ইমতিয়ার শামীমের এঁকে যাওয়া দৃশ্যপটে কতটা আস্থা রাখা যায় ? সেক্ষেত্রে বলব, এ প্রশ্নের উত্তর দেবে সময়। দেবে মহাকাল। যদি শ’খানেক বা তারও বেশি বছর পরে ভুত হয়ে এ বঙ্গে আসেন তবে মহাকাল উত্তরটা আপনাকে দিলেও দিতে পারে!

মৃত্যুর আগে

আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়,
দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল
কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়
তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল
জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ–কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;

আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো,
খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার:
পুরোনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক;

আমরা দেখেছি যারা বুনোহাঁস শিকারীর গুলির আঘাত
এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতরে,
আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের ’পরে হাত,
সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে;
শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ
আমরা পেযেছি যারা ঘুরে ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারোমাস;

দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,
হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,
ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ,
চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হ’য়ে ঝরেছে দু-বেলা
নির্জন মাছের চোখে; পুকুরের পারে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ–মেয়েলি হাতের স্পর্শ ল’যে গেছে তারে;

মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে,
বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন নীল হ‘য়ে আছে,
নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বার বার তীরটিরে মাখে,
খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জ্যোৎস্নার উঠানে পড়িয়াছে;
বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ—বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;
নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাঢ় আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসে;

আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল-লাল ফল
পড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে;
যত নীল আকাশেরা র’য়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল;
পথে-পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর ’পরে;
আমরা দেখেছি যারা শুপুরীর সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ,
প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতে সবুজ সহজ;

আমরা বুঝেছি যারা বহুদিন মাস ঋতু শেষ হ’লে পর
পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা
ক’য়ে গেছে; আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর
আরো-এক আলো আছে: দেহে তার বিকালবেলার ধূসরতা;
চোখের-দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হ’য়ে আছে স্থির:
পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর;

আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো—সোনা ছিলো যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন্ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।
কি বুঝিতে চাই আর? . . . রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক
শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ