মুসলিমদের নামকরণে আধুনিক স্টাইল - বইপাও ব্লগ

একজন শিশু জন্মগ্রহণ করার পর তার নাম রাখতে হয়। সে সময় তার যে নাম রাখা হয়, সবাই তাকে সেই নামেই ডাকে। দুধ পানরত অবস্থায় তাকে ডাকলেও সে বুঝতে পারে, তাকে ডাকছে। তাই কেউ ডাকলে তার দিকে তাকায়। আর বড়ো হওয়ার পর এ নামেই সে পরিচিতি লাভ করে।

মুসলিমদের নামকরণে আধুনিক স্টাইল - বইপাও ব্লগ

জনৈক স্বনামধন্য ভদ্রলোক তার দুই ছেলের নাম রেখেছেন ড্যাভিট আর টুইট। ড্যাভিটদের মা-বাবা উভয়ে উচ্চ শিক্ষিত। রহিম, করিম এই সব অনাধুনিক নাম একটি অত্যাধুনিক পরিবারে বেমানান। তাই হয়তো আধুনিক ধারায় চলছে নামকরণ প্রতিযোগিতা। যেমন- ড্যাভিট, ক্রেডিট, পাপ, পাপ্পি, ডন, প্রিন্স, ডলার, লকেট, লাভলী, বিউটি, চায়না ইত্যাদি। যার সন্তানের নাম সে রাখবে এতে কারও কোনো অভিযোগ থাকার কথা নয়। তবে অনুতাপের বিষয় হচ্ছে- নামকরণ প্রতিযোগিতায় বেসামাল হয়ে এমন সব শব্দে ভদ্রলোকেরা নামকরণ করেছেন, যা সেই শব্দের স্বভাষীদের কাছে হাস্যকর ব্যাপার। যেমন- ড্যাভিট, ক্রেডিট অর্থ জমা-খরচ, যা কোনো নামবাচক বিশেষ্য নয়। পাপ বা পাপ্পি অর্থ কুকুর ছানা, পনি অর্থ টাট্টু ঘোড়া। কিছু পরিবারে শিশুদের আব্বা বা বাবা ডাক না শিখিয়ে শেখানো হয় পাপ্পি । অর্থাৎ সন্তান তার পিতাকে ডাকছে ‘কুকুরের বাচ্চা'।

তবে হ্যাঁ, ১৯৪৭ সালের পূর্বে যখন এদেশ ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিল সেই সময় যদি বাঙালি সন্তানের এমন নামকরণ করা হতো, তবে ভাবা যেত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দমননীতির চাপে অথবা তাদের খুশি করার জন্য এমন সব নামকরণ করা হচ্ছে। কিন্তু না, সে সময়েও বাঙালি হিন্দু মুসলমানরা নিজ নিজ ধর্মীয় ভাবধারায়, মুস্তফা, মুহাম্মদ, আলি, ওসমান, আমেনা, ফাতেমা এবং হিন্দুরা গোবিন্দ, গোপাল, রাখাল, কানাই, নিতাই, সীতা, সাবিত্রী এইসব প্রাতঃস্মরণীয় নামে নামকরণ করেছে। এতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি।

বহু দশক পর নামগুলো হয়ে গেল পুরোনো ধাঁচের। আধুনিক যুগধারায় অভিনব বৈশিষ্ট্য শুরু হলো নামের আধুনিকীকরণ। যেমন- রাজিব, সজিব, পলাশ, গোলাপ, শাপলা, পল্লবী, শিমুল, ডালিম, লেবু, লিচু, দৃষ্টি, বৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি । নামগুলোর বৈশিষ্ট্যে হিন্দু-মুসলমানের কোনো ধর্মীয় বিভেদ নেই এবং বাংলা ও বাঙালির গৌরব ক্ষুণ্ন করেনি। এইসব বাংলা শব্দের নামকরণে তৃপ্ত হলো না ভদ্রলোকদের অনেকেই। ইংলিশ শব্দ প্রয়োগে শুরু হলো নামের আধুনিকীকরণ। তবে এতে তৃপ্ত হলো না তারা। রেগান, কাটার, নিউটন, মার্কনি, যীশু, মেরী, কুরি, ডায়না, তেরেসা ইত্যাদি বিশ্ববরেণ্যদের নামে নামকরণ শুরু করে দিলো। এইসব ব্যক্তিদের অবদান অস্বীকার করার নয়, কিন্তু তাই বলে বাংলা কৃষ্টিতে তাদের নাম নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করার যৌক্তিকতা কোথায়? শুধু নাম নয়; ডাকও আধুনিকীকরণে তারা ব্যস্ত। সানন্দে শিশুদের ডাক শেখানো হচ্ছে ডেডি, মাম্মি, আঙ্কেল, আন্টি ইত্যাদি।

বিদেশিদের ডেডি, মাম্মি আর বাঙালি পরিবারের বাবা, মা ডাকের ভাবার্থ এক নয়। কারণ, যারা হাতি দেখেছে, হাতির কথা মনে হলেই তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে শুঁড় ও লেজ বিশিষ্ট বৃহদাকার একটি চতুষ্পদ জন্তু। তদরূপ মাম্মি, আন্টি শুনলে বাঙালির চোখের সামনে ভেসে উঠে অশালীন, বেপর্দা, উচ্ছৃঙ্খল একজন পাশ্চাত্য নারী। আর ডেডি, আঙ্কেল শব্দে মনে হবে বিদেশি কৃষ্টিতে গড়া অত্যাধুনিক অস্থিরতায় বেসামাল একটা পুরুষ চরিত্র।

পক্ষান্তরে মা, খালা, আপা এবং পিসি, মাসি শব্দ উচ্চারণ করলেই বাঙালির চোখে ভেসে উঠে ঘোমটা পরা সুশীলা মমতাময়ী শ্রদ্ধাভাজনী একজন রমনী। যার স্বরণে সন্তানের মস্তক এমনিতে অবনত হয়। আর বাবা, চাচা, জ্যাঠা শব্দে সামনে ভেসে গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক মহান শ্রদ্ধেয় পুরুষ। যার বৃহৎ ভান্ডারের কাছে চিরকাল থাকবে সন্তানদের চাওয়া-পাওয়ার অধিকার।

ডেডি, মাম্মি ডাকা শিশুরা কি বড়ো হয়ে বাবাকে বাবা, মাকে মা ডাকতে পারবে? তবে এখানে অন্য এক প্রসঙ্গ তুলতে হয়— জীবনে আমি কিন্তু আমার বাবাকে বাবা, মাকে মা ডাকতে পারিনি। মা ডাকতাম ঠাকুরমাকে, বাবা, কাকা ও পিসিদের অনুকরণে। বাবাকে ডাকতাম বেটা, আর মাকে ডাকতাম বেটি বলে। বড়ো হয়েও এ অভ্যাস আর গেল না। বাবাকে বাবা, মাকে মা ডাকতে লজ্জা করত। আসলে আমার ঠাকুরদাদা আদর করে আমাকে এসব ডাক শিখিয়েছেন। এখানে আমার গর্ব হলো এ ডাক শেখানোতে ঠাকুরদাদা যত বড়ো অন্যায়ই করুক না কেন, বাংলা শব্দের বিকৃতি ঘটিয়ে আমাকে ডাক শেখাননি। তাই আমার বিশ্বাস ডেডি, আন্টি ডাকা শিশুরা বড়ো হয়ে আমার মতই বাবাকে বাবা, মাকে মা ডাকতে লজ্জা পাবে। আধুনিকীকরণের প্রভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সুন্দর নাম। নামের সাথে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বাংলার মা, বাবা ডাক।

নাম শুধু পরিচয়েরই বাহন নয়; বরং ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা ও রুচি অভিরুচিরও আয়না স্বরূপ। সুন্দর নাম মন-মানসিকতার উপর প্রভাব ফেলে এবং মন্দ নামেরও কিছু না কিছু পভাব ব্যক্তির উপর থাকে।

একটু কল্পনা করুন- এক ব্যক্তির নাম হচ্ছে কালু। উচ্চশিক্ষা লাভ করে সে বড়ো ডাক্তার বা প্রফেসর হয়ে গেলেন। এখন তাকে ডাকা হচ্ছে ডাক্তার কালু বা প্রফেসর কালু বলে। তাহলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে? তার নাম ও পদের মধ্যে কি কোনো সামঞ্জস্য থাকবে? এ ধরনের নাম দ্বারা ব্যক্তিত্বের মানহানি হয়। পাশাপাশি ব্যক্তির ধর্ম ও জাতীয় পরিচয়ও থাকে অস্পষ্ট।

তাই ঘরের ফুলবাগানে যখন কোনো শিশু কলি হয়ে আসবে, তখন সতর্কতার সাথেই তার নাম নির্বাচন করা উচিত; যেন নামটা হয় ইসলামী, সুন্দর ও ভাবগম্ভীর।

ভালো নাম রাখা পিতা-মাতার সর্বপ্রথম দায়িত্ব। আমরা এভাবেও বলতে পারি যে, পিতা-মাতার উপর সন্তানের সর্বপ্রথম হক হচ্ছে তার জন্য সুন্দর নাম নির্বাচন করা।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন

‘সন্তানের সুন্দর নাম রাখা এবং তার উত্তম তারবিয়াতের ব্যবস্থা করা বাবার উপর সন্তানের হক।' [মুসনাদে বাযযার : ৮৫৪০]

মানসিকতা ও স্বভাবের উপরও নামের একটা প্রভাব থাকে। আবদুল হুমাইদ বিন শায়বা বলেন

‘আমি সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিবের কাছে বসা ছিলাম। তিনি তখন বললেন, আমার দাদা “হাজান” একবার নবীজির দরবারে উপস্থিত হলেন। নবীজি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কী?” দাদা বললেন, “আমার নাম হাজান।” (হাজান অর্থ শক্তভূমি) নবীজি বললেন— “না, তুমি হচ্ছ ‘সাহল' (অর্থাৎ তোমার নাম হাজানের পরিবর্তে সাহল রাখো; সাহল অর্থ, নরম জমিন।)

দাদা বললেন, “আমার বাবা আমার যে নাম রেখেছেন আমি তা পরিবর্তন করব না।” সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব বলেন- এর ফল এই হলো যে, এরপর থেকে আমাদের বংশের লোকদের মেজাজে রূঢ়তা ও কর্কশভাব রয়ে গেল।' [সহীহ বুখারী : ৬১৯৩]

কারও নাম অসুন্দর হলে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পরিবর্তন করে সুন্দর নাম রাখতেন। হাদীসে এ ধরনের অনেক ঘটনা বর্ণিত আছে। উদাহরণস্বরূপ নিম্নে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে আতা বলেন

‘আমি আমার মেয়ের নাম রাখলাম- বাররা (নেককার, ভালো মানুষ)। তখন জয়নব বিনতে আবি সালামা বললেন-“আমার নাম ছিল, বাররা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা নিজেরা নিজেদের পবিত্রতা ঘোষণা করো না। (কারণ, বাররা অর্থ, ভালো, নেককার, পূত-পবিত্র) আল্লাহই জানেন, তোমাদের মধ্যে ভালো ও পূত-পবিত্র কারা। জিজ্ঞেস করা হলো, তাহলে আমরা তার কী নাম রাখতে পারি? তখন নবীজি বললেন- তার নাম জয়নব রাখো। (নবীজির আদেশে তখন বাররা নাম পরিবর্তন করে তাঁর নাম জয়নব রাখা হল)। [সহীহ মুসলিম: ২১৪২]

জয়নব হচ্ছে উম্মুল মুমিনিন উম্মে সালামা রা.-এর মেয়ে। আবু সালামার ইন্তেকালের পর উম্মে সালামা রা. নবীজির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এজন্য উম্মে সালামা রা. -এর সন্তানগণ নবীজির কাছ থেকে তারবিয়াত লাভের সৌভাগ্যে ধন্য হন। জয়নব রা. ছিলেন অনেক বুদ্ধিমান এবং নেককার নারী। হাদীসের কিতাবে তাঁর থেকে অনেক হাদীস বর্ণিত আছে। জয়নবের পাশাপাশি তাঁর ভাই ওমর ইবনে আবি সালামাও নবীজির তারবিয়াত লাভে ধন্য হন।

জয়নব বিনতে আবি সালামার মতো উম্মুল মুমিনিন জুওয়াইরিয়া রা.-এর নামও ছিল বাররা। এ নাম পরিবর্তন করে নবীজি তাঁর নাম রাখেন জুওয়াইরিয়া।

ইবনে আব্বাস রা. বলেন
‘জুওয়াইরিয়া রা.-এর নাম ছিল বাররা। নবীজি তাঁর নাম পরিবর্তন করে জুওয়াইরিয়া রাখেন (জুওয়াইরিয়া অর্থ ছোট্ট বালিকা)। কেউ যদি বলত, “বাররা-এর কাছ থেকে বের হয়েছে”, তাহলে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা অপছন্দ করতেন।' [সহীহ মুসলিম : ২১৪০] - লেখক : মুনিরা বিনতে আমীন

Comments

Popular posts from this blog

[PDF] সীরাহ মুহাম্মদ প্রথম খন্ড এবং দ্বিতীয় খণ্ড রেইনড্রপস পিডিএফ - Sirah Muhammad (sa:) First & Last Raindrops

সিক্রেটস অব জায়োনিজম Full PDF : লেখক হেনরি ফোর্ড | Secrets of Jainism Bangla Anubad PDF

[PDF] জীবন যদি হতো নারী সাহাবীর মত, ড. হানান লাশিন | Jibon Jodi Hoto Nari Sahabir Moto by Dr. Hanan Lashin