অপরের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রেখো : লেখক মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ | Oporer Anuvutir Proti Lokkho Rekho

  • অপরের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রেখো
  • লেখক : মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ
  • প্রকাশনী : রুহামা পাবলিকেশন
  • বিষয় : পরিবার ও সামাজিকজীবন, আদব, আখলাক
  • অনুবাদক : হাসান মাসরুর
  • পৃষ্ঠা : 128, কভার : পেপার ব্যাক, সংস্করণ : 1st Published, 2021
  • ভাষা : বাংলা


কেউ আপনার খিদমতে নিয়োজিত, কখনো কি আপনার খিদমতকারী এ মানুষটির অনুভূতির প্রতি লক্ষ করেন? আপনি কোথাও মেহমান হয়েছেন, মেজবানের অনুভূতির প্রতি খেয়াল করা হয় কি? কিংবা কেউ আপনার বাসায় মেহমান হয়ে এসেছে, তার অনুভূতির যথাযথ মূল্যায়নের বিষয়টি কি ভাবেন? কেউ আপনার কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য এসেছে, কেউ আপনার সামনে ভুল করে বসেছে, আপনার প্রতিবেশীদের কেউ অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও কারও কাছে হাত না পেতে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে—এমন বহু মানুষের নানান অবস্থার প্রত্যক্ষদর্শী আপনি। সত্যিই বলুন তো, এমন নানান অবস্থার মানুষগুলোর অনুভূতির প্রতি লক্ষ রেখে যথাযথ আচরণ দেখানোর বিষয়টা কি আপনার ভাবনায় থাকে?… প্রিয় পাঠক, বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে অপরের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখার উত্তম শিক্ষাই আপনি পাবেন।

ভূমিকা

الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على أشرف الأنبياء والمرسلين نبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين.
ইসলাম মানুষের সাথে ভালো আচরণ এবং তাদের সাথে কোমলতার প্রতি আহ্বান করে। ইসলামের সুমহান নীতি ও আদর্শ মানুষের অনুভূতি ও চিন্তাধারার প্রতি লক্ষ রাখার কথা বলে। এ কারণেই তো প্রতিটি সদস্যের মাঝে সামষ্টিক সম্পর্কের ব্যাপারে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছে। উত্তম আচরণ ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে উত্তম ভাষা নির্বাচনের আদেশ করেছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :

وقولوا للناس حسنا
‘আর মানুষের সাথে ভালো কথা বলবে।১
আল্লাহ তাআলা এটিকে সেই হিকমতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন—যাকে তা দেওয়া হয়েছে, তাকে অনেক কল্যাণ দান করা হয়েছে। পক্ষান্তরে কঠোরতা ও রূঢ়তা এবং কায়কারবারে অবহেলা ও অন্যদের কষ্ট প্রদানের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।

এই কিতাবে কিতাবুল্লাহ, রাসুল -এর সুন্নাহ ও সালাফে সালিহিন থেকে বর্ণিত কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে উপকারী ইলম, নেক আমল এবং তাঁর পছন্দনীয় ও সন্তুষ্টিজনক বিষয়ে তাওফিক প্রার্থনা করছি । সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর বান্দা ও রাসুল আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মাদ -এর ওপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সঙ্গী-সাথিদের ওপর।
- শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ

মানুষের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা
নবিদের চারিত্রিক গুণাবলির মাঝে অন্যতম হলো, মানুষের অনুভূতির প্রতি লক্ষ রাখা। যেমন আল্লাহ তাআলা তাঁর নবি -কে বলেন :

فبما رحمة من الله لنت لهم ولو كنت فظا غليظ القلب لانفضوا من حولك فاعف عنهم واستغفر لهم وشاورهم في الأمر فإذا عزمت فتوكل على الله إن الله يحب المتوكلين
‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয় হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করুন এবং কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন।
আল-কাসিমি বলেন :

*(n) sad all je at hi) “আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন।” অর্থাৎ সকল মুমিনের জন্য; যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন

: ( Gi Saajil) “মুমিনদের প্রতি তিনি স্নেহশীল দয়াময়।
(Utgjg) “যদি আপনি রূঢ় হতেন ।” অর্থাৎ মন্দ চরিত্র ও শক্ত কথার অধিকারী হতেন। (iaj Bus) “কঠিন হৃদয়ের অধিকারী” অর্থাৎ শক্ত ও কঠিন হৃদয়ের অধিকারী। তাদের সাথে কঠোর রূঢ় আচরণ করা। (I, LUÝ) তথা তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। (ŚU;-) “আপনার কাছ থেকে।” ফলে আপনার কাছে তারা প্রশান্তি পেত না। আর আপনার দাওয়াতও পূর্ণতা পেত না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আপনাকে সহজ, সুমহান, হাস্যোজ্জ্বল, কোমল, সুহৃদয়, নেককার, স্নেহশীল ও দয়াময় হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। (ave be “কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন।

” অর্থাৎ আপনার অধিকারের ক্ষেত্রে তারা যে সীমালঙ্ঘন করেছে, তা আপনি ক্ষমা করে দিন, যেমন আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। (Jg) “এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।” তাদের প্রতি দয়ার পূর্ণতা প্রদান হিসেবে। (ও :Ÿi) “এবং কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন।” অর্থাৎ তাদের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে, তাদের অন্তরের প্রশান্তিস্বরূপ এবং তাদের মতামত প্রকাশ করার অধিকার দিয়ে আপনি তাদের সাথে যুদ্ধ ও অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ করুন।... জনৈক তাফসিরকারক বলেন, “আয়াতের ফলাফল হলো, উত্তম চরিত্রকে আঁকড়ে ধরা আবশ্যক।

বিশেষ করে যারা আল্লাহ তাআলার দিকে দাওয়াত দেবেন এবং সৎকাজের আদেশ করবেন তাদের জন্য।
ইমাম আস-সাদি বলেন 
:
....দ্বীনি ক্ষেত্রে নেতার উত্তম চরিত্র মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে আকৃষ্ট করে এবং বিশেষ প্রশংসা ও বিশেষ সাওয়াবের সাথে সাথে তাদেরকে তার প্রতি অনুপ্রাণিত করে। আর দ্বীনি ক্ষেত্রে নেতার মন্দ চরিত্র মানুষকে নিন্দা ও বিশেষ শাস্তির সাথে সাথে তার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দেয়। এই নিষ্পাপ রাসুলের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা যা বলার বলেছেন।

 তাহলে অন্যদের ক্ষেত্রে কী হবে? এটি কি সবচেয়ে বড় আবশ্যকীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় যে, তাঁর মহান চরিত্রের অনুসরণ করা হবে? তিনি আল্লাহর আদেশের ওপর আমল করে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট করতে মানুষের সাথে যে কোমল ভাষা ও উত্তম আচরণ করেছেন, সে অনুযায়ী তাদের সাথে আচরণ করা হবে?

সকল নবির চারিত্রিক গুণাবলি আমাদের নবি-এর অনুরূপই পাই। যেমন আল্লাহর নবি ইউসুফ -এর ভাইদের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান দেখতে পাই, যখন তারা নিজেদের অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছিল 

تالله لقد آثرك الله علينا وإن كنا لخاطئين
‘আল্লাহর কসম, অবশ্যই আল্লাহ তোমাকে আমাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং নিশ্চয় আমরা অপরাধী ছিলাম।

আল্লাহ তাআলা তাঁকে ক্ষমতা দান করার পর যখন তাঁর পরিবার তাঁর কাছে জড়ো হলো, তখন তিনি তাদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং খুব দ্রুত (এমন হয়েছে যে,) :

ورفع أبويه على العرش وخروا له سجدا، وقال يا أبت هذا تأويل رؤياي من قبل قد جعلها ربي حقاء وقد أحسن بي إذ أخرجني من السجن وجاء بكم من البدو من بعد أن نزع الشيطان بيني وبين إخوتي : إن ربي لطيف لما يشاء إنه هو العليم الحكيم

‘আর তিনি তার পিতামাতাকে সিংহাসনের ওপর বসালেন এবং তারা সবাই তার সামনে সিজদাবনত হলো। তিনি বললেন, “পিতা, এ হচ্ছে আমার ইতিপূর্বেকার স্বপ্নের বর্ণনা, আমার পালনকর্তা একে সত্যে পরিণত করেছেন এবং তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আমাকে জেল থেকে বের করেছেন এবং আপনাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে

এসেছেন, শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেওয়ার পর। আমার পালনকর্তা যা ইচ্ছা করেন, তা সূক্ষ্ম উপায়ে বাস্তবায়ন করে থাকেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
ইবনুল কাইয়িম বলেন :

এখানে তিনি এ কথা বলেননি যে, আল্লাহ আমাকে কূপ থেকে বের করেছেন; এটি করেছেন ভাইদের প্রতি আদব রক্ষা এবং তাদের প্রতি এই ইহসান করার জন্য যে, তিনি কূপে নিক্ষেপের মাঝে যা হয়েছে, তার মাধ্যমে তাদের লজ্জিত করেননি। তিনি বলেন, (وجاء بكم من البدو) “এবং আপনাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন।

 তিনি আদবের প্রতি লক্ষ রেখে এ কথা বলেননি যে, ক্ষুধা ও প্রয়োজনের তীব্রতা তোমাদের নিয়ে এসেছে। তিনি এখানে যা ঘটেছে, তার কারণটি শয়তানের দিকে সম্পৃক্ত করেছেন, সরাসরি তাদের দিকে সম্পৃক্ত করেননি; যদিও সরাসরি ক্রিয়া সম্পাদনকারী কারণ হিসেবে উল্লেখ হওয়ার অধিক নিকটবর্তী । তিনি বলেছেন, (gf এর ঊ) “শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেওয়ার পর।” তিনি উদারতা, দয়া এবং আদবের হক আদায় করেছিলেন। এ ধরনের পরিপূর্ণ গুণ

শুধু নবি-রাসুলগণই অর্জন করতে পারেন। আল্লাহ তাআলা তাঁদের ওপর শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন।
ইমাম সাদি বলেন :

‘এটি ইউসুফ -এর উদারতা এবং সুন্দর সম্বোধনের অংশ যে, তিনি জেলের অবস্থা তুলে ধরেছেন; কিন্তু কূপে নিক্ষেপের অবস্থার কথা বলেননি। কারণ, তিনি তাঁর ভাইদের পরিপূর্ণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তাই তিনি আর সে অপরাধের কথা আলোচনা করেননি। আর গ্রাম থেকে তোমাদের এখানে আসা আমার প্রতি আল্লাহ তাআলার করুণা। ফলে তিনি বলেননি, ক্ষুধা ও ক্লান্তি তোমাদের নিয়ে এসেছে। এ কথাও বলেননি যে, আমি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছি।

 বরং তিনি বলেছেন, (ও ২) “তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।” অনুগ্রহ-দানকে তিনি আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। কতই না মহান সে সত্তা, যিনি নিজ বান্দাদের থেকে যাকে চান, নিজের রহমতের মাধ্যমে বিশেষায়িত করেন। (sofas be BUEJ1) “শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেওয়ার পর।” তিনি এ কথা বলেননি যে, আমার ভাইদেরকে শয়তান পথভ্রষ্ট করেছে। বরং তিনি অপরাধ ও অজ্ঞতাকে উভয় দিকেই সম্পৃক্ত করেছেন। 

সম্মানিতের ছেলে সম্মানিতের ছেলে সম্মানিতের ছেলে সম্মানিত নবি-এর এই মহান অবস্থান আমাদের সামনে নবি-রাসুল এবং আল্লাহর বিশেষ নির্বাচিত বান্দাদের সুমহান চরিত্রের বিশালতা বর্ণনা করে দেয়। হে আল্লাহ, আমাদেরকে আপনার এ কথা বাস্তবায়নস্বরূপ তাঁদের অনুসরণের তাওফিক দান করুন :
أولئك الذين هدى الله فبهداهم اقتده
‘এঁরাই তাঁরা, যাঁদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং তুমি তাঁদের পথনির্দেশনা অনুসরণ করো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ