নাটক/সিনেমাতে কিছু হিরো চরিত্র থাকে। বাস্তবে যখন তাদের বিভিন্ন নিষ্ঠুর আচরন সম্পর্কে জানি,তখন তাদের আর হিরো বলে মনে হতে চায় না। রিয়েল লাইফ হিরোইজম যদি কারোর মধ্যে দেখে থাকি তো সেটা বিদ্যাসাগর। এই মানুষটা সারাজীবন কখনো বসেননি,বিশ্রাম করেননি,মস্তিষ্কটাকে কখনো অন্যের ভাবনা ভাবা থেকে বিরতি দিতে পারেননি। নিজের জন্য অনাড়ম্বর সাদাসিধে জীবন বেছে নিলেও অন্যের জন্য,অন্যের ভালোর জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও দ্বিধা করতেন না তিনি। আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে নিজ স্বার্থকাতর মানুষ দেখি। নিজের দুঃখে তাদের চোখে জল আসে,অন্যের দুঃখ স্পর্শ করে না। বিদ্যাসাগর ছিলেন ঠিক তার উল্টো। নিজের দুঃখ তার কাছে দুঃখই মনে হতো না,অন্যের দুঃখে চোখের জল ফেলতেন। একবার তার খুব জটিল একটা অপারেশন হলো। বিন্দুমাত্র কাতর ধ্বনি অব্দি তোলেননি,পাশেই একজনের সাথে গল্প করতে করতে অপারেশন শেষ করে ফেলেছেন। আর একবার তার পায়ের ওপর লোহার কর্কপ্রেশার পড়াতে একমাস বিছানায় থাকতে হয়েছে কিন্তু পড়বার সময় ব্যাথায় একবার মুখ বিকৃত করেনি।
অথচ এই মানুষটিই অন্যের দুঃখ একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। যেখানে তার চেয়ে অনেক বড়,অর্থবিত্তশালী মানুষ অন্যের সমস্যা তারা সেধে শোনাতে এলেও শুনতেন না, সাহায্য করতেন না সেখানে এই ঈশ্বরচন্দ্র পথ চলতি মানুষের মন খারাপ,চোখের জল দেখে তাদের চেপে ধরে কথা আদায় করতেন, তারপর সাহায্য করতেন। অথচ এই সাহায্যের ব্যাপারটা আরেকজনকে জানতে দিতে চাইতেন না। একই সময়ে কখনও দুইজনকে ডাকতেন না,পাছে তারা জেনে যায়! মিথ্যা বলতেন, হয়তো অভাবী একজন বিধবা লজ্জায় অর্থ সাহায্য নিতে চাইছে না তাকে ডেকে বলতেন, " মা! তোমার স্বামীর কাছ থেকে এত টাকা ধার করেছিলাম একসময়,সেটার শোধ দিচ্ছি।"
কি হিন্দু,কি মুসলমান,কি ফিরিঙ্গী বিদ্যাসাগর সবার জন্য সমানভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। অসুস্থ হলে জাতপাত বিচার না করে মুচির ছেলে,ডোমের ছেলেকে কোলে বসিয়ে ওষুধ খাওয়াতেন।
একবার এক মহিলা পুত্রশোকে পাগল হয়ে বায়না ধরলেন, "বিদ্যাসাগর না খাইয়ে দিলে খাবো না।" বিদ্যাসাগর টানা কয়েকমাস নানা কাজের ফাঁকেও দুইবেলা খাইয়ে দিয়ে এসেছেন তাকে।
ঈশ্বরচন্দ্র এক বড়লোকের বাড়িতে জাজিমের ওপর টানাপাখার হাওয়ায় বসে গল্প করছিলেন। এই সময়ে দারোয়ান তার জন্য একটা চিঠি নিয়ে এলো। দারুন রোদে হেঁটে আসায় সে লাল টকটকে হয়ে গেছে,ঘেমে একসা। বিদ্যাসাগর তাকে জোর করে ধরে নিজের পাশে বসিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ালেন।
আরেকবার এক ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইতে আসলে তাকে জিজ্ঞেস করেন, "কি খেতে মন চায়?" ভিক্ষুক জানায়, "লুচি খেতে খুব ইচ্ছা করে।" বিদ্যাসাগর তৎক্ষণাৎ লুচি তৈরি করে তাকে খাওয়ান আর বলেন, "প্রতি মাসে একদিন এসে লুচি খেয়ে যাবি আর মাসিক কিছু অর্থ নিয়ে যাবি সংসার চালাবার জন্য।"
এরকমই ছিলেন বিদ্যাসাগর। কখনো অতি অভাবী কেউ সাহায্য চাইলে একবার নামমাত্র দান করেই দায়িত্ব শেষ করতেন না,তার মাসিক বন্দোবস্ত করে দিতেন অর্থের। এসবের সুযোগ নিয়ে অনেকেই আবার তাকে ঠকাতো, মিথ্যা বলে টাকা নিয়ে যেত। বিদ্যাসাগর বলতেন,"তা নিক,ওর উপকার তো হলো? ঠকানোর চেয়ে ঠকা ভালো।"
উজ্জ্বল চারিত্রিক এই দীপ্তি,দাতা স্বভাব এসবের বাইরেও ঈশ্বরচন্দ্রের একটা কঠোর রুপ ছিলো। রাজা মহারাজার দেয়া অন্যায় অর্থ তিনি গ্রহন করতেন না,চাকরি ছেড়ে দিতে টাকার মায়া করতেন না,অন্যায় দেখলে মাথা ঠিক রাখতে পারতেন না। দরিদ্রের জন্য বড়লোককে অপ্রস্তুত করেছেন এমন অনেক নজির থাকলেও বড়লোকের তোষামোদের জন্য কোন দরিদ্রকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এমন নজির কোথাও নেই।
এসব থেকে কিছু মানুষের মনে হয়তো নানা প্রশ্নের উদয় হতে পারে যে, তিনি এসব কেন করতেন? না তার কোন রাজনৈতিক স্বার্থ ছিলো না,তিনি এসব স্বর্গ পাবার জন্যও করতেন না বা জনপ্রিয়তা পাবার লোভেও না। ঈশ্বরচন্দ্র বলতেন, "যে দেশে দলে দলে লোক না খেয়ে মরে যাচ্ছে সেই দেশে আস্ফালন করে, বক্তৃতা করে লাভ কি? আমরা তো দরিদ্র মানুষদেরকে মানুষ ভাবতেও শিখিনি!"
এ গেল তার মাত্র একটা দিক। তার পান্ডিত্য, শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান,বিধবা বিবাহ এরকম আরো অনেক দিকই খুঁজে পাবেন বইটাতে।
ছোট করে রিভিউটা দিলাম। কিন্তু বইটাতে বিদ্যাসাগরের পুরো জীবন, জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা সবই তুলে ধরা হয়েছে, একদম ফিকশনের মতো করেই।
এই বইটি ১৯৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হবার পর সাধারণ পাঠক/পাঠিকা থেকে শুরু করে বিখ্যাতরা অব্দি উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন তাদের মধ্যে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়,প্রমথনাথ বিশী,সাহিত্যরত্ন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় অন্যতম। তাদের বক্তব্য থেকে এটুকু পরিস্কার যে, এর আগে রাজনীতি,সমাজ এসবকে পাশ কাটিয়ে এত সাহসের সাথে এত নিখুঁতভাবে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে কেউ লেখেনি। তাদের মতে, এই এক বই পড়েই পরিপূর্ণভাবে বিদ্যাসাগরকে জানা সম্ভব।
আর আসলেও তাই। এই বই পড়ে কখনো অবাক হয়েছি,কখনো মুগ্ধ তো কখনো কেঁদেছি। সে অনুভুতিগুলো লিখে আসলে বোঝাতে পারবো না আমি।
আর লেখক ইন্দ্রমিত্র দাক্ষিণ্যেও কোনো অংশে কম যান না, তিনি এই বই হতে প্রাপ্ত সম্পূর্ণ রয়্যালিটি রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করে গেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনী লেখার জন্য উপযুক্ত মানুষ,তাই না?
হুমায়ূন আহমেদের হিমু সিরিজের একটা গল্পে হিমু রুপাকে একটা ফোনকল করে দোকানীকে ৫০০ টাকার একটা নোট দিয়ে বলে,"এখন যে কলটা আমি করেছি তার দাম পাঁচশ টাকা।" ঠিক সেরকম এই বইটা পড়ার পর মনে হচ্ছে দোকানীকে এক লাখ টাকা দিয়ে বলা উচিত ছিলো, যে বইটা আমি কিনেছি তার মূল্য আসলে এক লাখ টাকা।
ননফিকশন যারা পছন্দ করেন,বিদ্যাসাগরকে যারা জানতে চান চমৎকার এই বইটা মিস না দিয়ে পড়ে ফেলুন শীঘ্রই।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....