- বইঃ শবনম PDF
- লেখকঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনীঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- ধরণঃ উপন্যাস
- প্রচ্ছদঃ ধ্রুব এষ
- মুদ্রিত মূল্যঃ ২২০/-
"শত্রু বেদনা দেয় মিলনে, মিত্র দেয় বিরহে"
আফগানিস্থান। শাসন ক্ষমতায় আছে আফগান বাদশা আমানুল্লাহ। ১৯১৯ থেকে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি আফগানিস্তান শাসন করেছেন। তাঁর শাসনামলে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রচেষ্টা দেখা যায়। তিনি পাশ্চাত্য কায়দায় আফগানিস্তানকে আধুনিক করার প্রচেষ্টাকারী প্রথম আফগান শাসকও বটে। তবে হাবিবউল্লাহ কালাকানি ও তার অনুসারীদের জনপ্রিয় উত্থানের ফলে তাঁর এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি আমানউল্লাহ খান ক্ষমতা ত্যাগ করে পালিয়ে প্রথমে ব্রিটিশ ভারত, পরে ইউরোপে চলে যান। যেহেতু বলায় হয়েছে আমানুল্লাহর আধুনিকায়নের বেশ জোর সমথর্ক ছিলেন তার শাসনামলে আফগানিস্তানের মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পাগমান শহরে আয়োজন করা হয় নৈশ বল-ডান্সের। সেই বল ডান্স আফগান সমাজের জন্য যদিও বেলেল্লাপনা বল ডান্স।
সেই বেলেল্লাপনার বল ড্যান্স দেখতে যাওয়া এক তরুণীর সাথে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয় পরদেশী এক হিন্দুস্থানী তরুণ। মজনুন নাম এই তরুণ অধ্যাপকের। আফগানিস্তানে একেবারেই নতুন। বয়স, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, ভাষা, পরিবেশ সবকিছু মিলিয়ে আফগান সমাজের যাপিত জীবন মজনুনকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমনি এক অভিজ্ঞতার নাম শব্নম্।
তরুণ অধ্যাপক যে সুন্দরী কন্যার প্রেম সাগরের অবগাহনে ভেসেছে। শব্নম্ সর্দার আওরঙ্গজেব কন্যা। সে যে এই দেশের রাজকুমারী তা ভিনদেশী যুবার কল্পনার আকাশে একবারও উদিত হয় নি। প্রেম চিরকাল ভাবনা আর চিন্তার সমর্থক নই। এর থাকেনা কোনো জাত, কাল। আর পাত্রভেদে প্রেমকে ফ্রেমবন্দী করা যায় না। শবনমকে মজনূনের দেয়া প্রথম উপহার ছিল সিলেটি লেবু। আর শবনমের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছিল কাগজে লেখা কবিতা। বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের আমন্ত্রণে পারস্যের কবি হাফিজের লেখা সেই কবিতা।
শবনমের বয়স আঠারো-উনিশ। কিন্তু চালচলন, রীতিনীতি আর আচার-আচরণে সে অনেক পরিণত। অনেক মার্জিত এবং পরিশীলিত। হিন্দুস্থানী মজনুনের সম্পদ বাংলা ও ইংরেজি, তবে একটু-আধটু ফার্সি ও ফরাসি ভাষা চর্চা ও সে জানে। কবি হাফিজ থেকে শুরু করে কালিদাস সবাই এসে জড়ো হতে থাকে শব্নম্ আর মজনুনের প্রেমকাহিনীতে। প্রেমের সুন্দরতম রূপে শব্নম্ কি পারবে মজনুনের সাথে বিবাহ ডোরে আবদ্ধ হতে? দুই দেশের স্থান, কাল কি বাধা হয়ে দাঁড়াবে বহু পার্থিব এই মিলনে?
সৈয়দ মুজতবা আলীর এক অমর সৃষ্টি শব্নম্। এই উপন্যাসটি নিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন,
“বাঙ্গালী তরুণ-তরুণীদের প্রেমে পড়ার পূর্বে অবশ্যই সৈয়দ মুজতবা আলীর শবনম উপন্যাসটি পড়ে নেয়া উচিত।
এমন শিক্ষণীয় প্রেমের উপন্যাস বিশ্ব সাহিত্যে আর একটিও নেই।”
কথাটির সত্য মিথ্যা বিচার পাওয়া যাবে গোটা উপন্যাসটি পড়ার পরেই। কাবুলের ডাক্তার সাহেবের শব্দভাণ্ডার কতোখানি শক্তিশালী তা উপন্যাসটির প্রত্যেকটি পরতে পরতে বোঝা যায়। উপন্যাস জুড়ে পাঠক ঠোকরও খাবে এই শব্দের জোরেই। ভাষার কঠিন প্রয়োগ উপন্যাসর প্রাঞ্জলতাকে ক্ষুন্ন করে কিন্তু সেটা তবে শব্নম্ ও মজনুনের চমৎকার সব কথোপকথনে অনেকাংশেই কেটে যায়।
যেমন মজনুনের অদ্ভুত ফার্সি ও ফরাসি ভাষা সম্পর্কে শবনমের মন্তব্য,
"আপনার ফ্রেঞ্চ অদ্ভুত, আপনার ফার্সিও অদ্ভুত।" তবে কেমন অদ্ভুত তাও সে ব্যাখ্যা করেছে, " অদ্ভুত মানে খারাপ? ফার্সি উচ্চারণে কেমন যেন পুরনো আতরের গন্ধ। দাঁড়ান, বলছি। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ঠাকুরমা সিন্দুক খুললে যেরকম পুরনো দিনের জমানো মিষ্টি গন্ধ বেরোয়। অন্য হিন্দুস্তানিরা কী রকম যেন ভোঁতা ভোঁতা ফার্সি বলে।"
আর শব্নম্ সেতো শিশিরবিন্দু, হিমকণা। সে তো শিউলি। শরৎ-নিশির স্বপ্ন-প্রভাতের বিচ্ছেদ বেদনা। সে যখন ভোরবেলা সর্ব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়, সে কি স্বেচ্ছায়? শব্নম্ এবং রূপের ঐশ্বর্য নিয়ে লেখক বলেছেন,
"প্রথমে দেখেছিলুম কপালটি। যেন তৃতীয়ার ক্ষীণচন্দ্র। শুধু, চাঁদ হয় চাপা বর্ণের, এর কপালটি একদম পাগমান পাহাড়ের বরফের মতই ধবধবে সাদা। সেটি আপনি দেখেন নি? অতএব বলব নির্জলা দুধের মত। সেও তো আপনি দেখেন নি। তা হলে বলি বন-মল্লিকার পাপড়ির মত।
নাকটি যেন ছোট বাঁশী। ওইটুকুন বাঁশীতে কি করে দুটো ফুটো হয় জানি না। নাকের ডগা আবার অল্প অল্প কাঁপছে। গাল দুটি কাবুলেরই পাকা আপেলের মত।"
উপন্যাস না বলে কাব্য উপাখ্যান বললেই হয়ত শব্নম্কে উপলব্ধির সীমানাতে আরো নেওয়া যায়। প্রতিটি উক্তি কোনো পদ্য সাহিত্যের চেয়ে কম নয়। শব্নম্ আর মজনুনের প্রতিটি কথোপকথন কবিতায় হয়েছে। ফার্সি আর নানান ভাষার কবিতার অনুবাদ পাওয়া যাবে পুরো বই জুড়ে। আর উপন্যাসে প্রথম এভাবেই অপারেজয় সেই উক্তিটি আসে,
"আমার মিলনে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেওনা"
শব্নম্ যেন একটা গোটা আফগান সভ্যতার প্রস্ফুটন।
বোরখা সম্পর্কে শবনমের স্পষ্ট কথা, লোকে বলে বোরখা নারীদের বন্দি করে রেখেছে, আমি তো দেখি বোরখা নারীর সুবিধের জন্যই, ইচ্ছে করলেই নিজেকে লুকিয়ে ফেলা যায় বোরখার আড়ালে।
উপন্যাসে উঠে এসেছে আরেকটি চমৎকার দিক। আফগান মেয়েদের বিয়ের পরে মাথার জুলফ কেটে দিতে হয়।যাতে করে বোঝা যায় সে বিবাহিতা। বাঙলা জুলফি কথাটা মুলত এই জুলফ থেকেই এসেছে। ইরান, তুরানের অনেক কুমারীদের অনেকেই দু-গুচ্ছ চুল রগ থেকে কানের ডগা অবধি ঝুলিয়ে রাখে। এটাকেই জুলফ বলে। উপন্যাসে শবনমের জুলফ কাটা নিয়েও বেশ কিছু চিত্তাকর্ষক সংলাপ রয়েছে উপন্যাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে।
মুজতবা আলীকে প্রথম পড়ি রসগোল্লা গল্প দিয়ে। মনে আছেতো রসগোল্লার ঝান্ডুদার কথা? শার্টের কলার ধরে একটি রসগোল্লা নাকের কাছে নিয়ে বলছে, "ও পরাণ খাবি নে? তোর গুষ্ঠি খাবে।" এরপরে রম্য দিকে কাবুলের এই ডাক্তার সাহেব একেবারেই বাঙালির হৃদয়ে আসীন হয়ে যায়। সেখানে শব্নম্ ক্লাসিকাল রোমান্টিজমের এক অনবদ্য ঝঙ্কার! মিলন আর বিরহের এক সম্ভার। সেই সম্ভার থেকেই উঠে আসে আরেকটি বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উক্তি,
– "আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না।"
অমর প্রেমের এই উপাখ্যান জুড়ে রয়েছে একের পর এক উক্তির সম্ভার। উপন্যাসটি পড়ার সময়ে যেকেউ ভেসে যাবে প্রতিটি লাইনের ধ্রুমজালে।
"হে খুদা, আদম এবং হাওয়ার মধ্যে, ইউসুফ এবং জোলেখার মধ্যে, হজরৎ এবং খাদিজার মধ্যে যে প্রেম ছিল, এ দুজনার ভিতর সেই রকম প্রেম হোক।"
সমস্ত উপন্যাস জুড়ে পাঠক ঘুরে আসতে পারবে আফগানিস্তানের কাবুল, পাগমান, মাজার-ই-শরীফ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সিলেটে।
উপন্যাসটি আত্মবর্ণনায় লেখা। যে কেউ পড়ে প্রথমে মনে হবে এই মজনুন স্বয়ং বুঝি লেখক! তবে সত্যিই কি মুজতবা আলীর সাথে শবনম নামের কোনো নারীর প্রণয় ছিল? ক্ল্যাসিক্যাল এই উপন্যাসটি ঘিরে এমন উত্তর কিন্তু লেখক নিজেই দিয়েছেন।
লেখকের ভ্রাতুষ্পুত্র, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর এই প্রশ্নের উত্তরে আলীসাহেব বলেন,
"বাঘে মানুষ খায়, এটা সত্যি তো, না কি? হ্যাঁ, তা তো বটেই।’ তা হলে এই বাঘে মানুষ খেয়েছে কি না তা দিয়ে কম্মটা কী? কী আর বলব, বোকার মতো মুখ করে বসে রইলাম। চাচা বললেন, "শোনো, যুবক-যুবতী প্রেম করে, সেটা যেমন সত্যি, এই গপ্পও তেমনই সত্যি! তবে তুমি যেহেতু গাড়ল, তাই খোলসা করে বলছি। কাবুলে থাকাকালীন একজন কাবুলি নারীর সঙ্গেই আমার পরিচয় হয়েছিল। সে আমার বাড়ি রোজ সকালে দুধ দিয়ে যেত। তার বয়স আশি! ভাতিজা, বাড়াও, বাড়াও! কল্পনাশক্তিটা আর একটু বাড়াও হে!"
উপন্যাসটি শেষ করে পাঠকের মনে বারবার অতৃপ্তির আভাস বইবে। আমাদের সমগ্র জীবন আসলে আক্ষেপের এক অদ্ভুত চোরাবালি। তাইতো,
"গোড়া আর শেষ, এই সৃষ্টির জানা আছে, বল কার?
প্রাচীন এ পুঁথি, গোড়া আর শেষ পাতা কটি ঝরা তার?"
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....