একটি শতাব্দীর সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ

বাঙালি লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন ❝বাংলা সাহিত্যে একটি শতাব্দীর সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক❞ এবং তার মতে ❝----- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধায়ের চেয়েও জনপ্রিয় ছিলেন❞। কার সম্পর্কে বলেছেন? আরেকটু ক্লু দেই,
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাকে ❝উপমহাদেশের অন্যতম সেরা লেখক❞ বলে উল্লেখ করেন।
হ্যাঁ, এই অন্যতম জনপ্রিয় লেখকটি ❝হুমায়ূন আহমেদ❞।

হুমায়ূন আহমেদ: তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন

বাংলা সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটকে যার অবদান অবর্ণনীয়। যার কলমের ছোঁয়ায় তৈরি হয়েছে মিসির আলি, হিমু, শুভ্র, রূপার মতো চরিত্র। চরিত্রগুলো পাঠকমনে এতোটাই স্থান নিয়েছে যে পাঠকদল নিজেদের সে চরিত্রে কল্পনা করতে, তাদের মতো চলতে চেষ্টা করে। হিমুর মতো হলুদ পাঞ্জাবী খালি পায় রাস্তায় চলতে চায় কিংবা নীল শাড়িতে নিজেকে রূপাতে কল্পনা করে। বাংলা সাহিত্যে অসাধারণ সব উপন্যাস দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ আশি-নব্বইর দশকের সকল পাঠকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন।

আমাদের ছেলেবেলায় সাহিত্যের প্রথম পাঠ শুরু হয়েছিল এই কিংবদন্তি কথা সাহিত্যিকের মাধ্যমেই। সহজ সাধারণ ভাষাশৈলী কিন্তু পাঠক মনে দাগ দিয়ে যাওয়ার মতো লেখা দিয়ে যুগ যুগ ধরে ছোটো বড়ো সকলের প্রিয় লেখক হয়ে উঠেছেন। লেখকের লেখায় সামাজিক জীবনধারা, আমাদের আশেপাশেই ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো উঠে এসেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বারান্দায় রাস্তা দেখা একটা নিত্য নৈমিত্তিক দৃশ্য হলেও লেখকের লেখার গুণে সেটাও কেমন মনোমুগ্ধকর লাগে। লেখকের লেখায় খলনায়ক চরিত্রও যেন অন্যরকম এক রূপ পায়। খলনায়ককেও কোথাও কোথাও ভালো লাগতে শুরু করে। 

১৯৭১ সালে হুমায়ূন আহমেদ লিখেন তার প্রথম উপন্যাস ❝শঙ্খনীল কারাগার❞। তবে সেটি প্রকাশ হয় ১৯৭৩ সালে। একই সালে (১৯৭১) তিনি লিখেন নাতিদীর্ঘ উপন্যাস ❝নন্দিত নরকে❞। যুদ্ধের কারণে সে বছর প্রকাশ সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে আরেক কিংবদন্তি সাহিত্যিক আহমদ ছফার উদ্যোগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি। পাঠকমহলে ক্রমেই সাড়া ফেলতে থাকেন নিজের উপন্যাস দিয়ে। ধীরে ধীরে পরিচয় করিয়ে দেন মিসির আলি, হিমুর মতো চরিত্রের সাথে। যারা ফিকশনের অংশ হয়েও বাসব জীবনে পাঠকের হৃদয়ে জীবন্ত।

নাটক দিয়েও তিনি যথেষ্ঠ পরিচিতি লাভ করেন। তার রচিত প্রথম ধারাবাহিক নাটক ❝এইসব দিনরাত্রি❞ এতো জনপ্রিয় হয় যে সেখানে লিউকোমিয়া আক্রান্ত শিশু চরিত্র ❝টুনি❞ কে বাঁচিয়ে রাখতে হুমায়ূন আহমেদের কাছে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে দর্শকের প্রচুর চিঠি আসে, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ তার চিত্রনাট্যের ধারায় অটল থাকেন। এছাড়াও কালো চশমা, ব্যাক ব্রাশ চুলে এলাকার গুন্ডা জাতীয় ❝বাকের ভাই❞ কে ভালোবাসে না এমন দর্শক বা পাঠককে যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ❝কোথাও কেউ নেই❞ উপন্যাসের সেই বাকের ভাই আর মুনার গল্প উপন্যাস বা নাটক হিসেবে প্রতিটি দর্শকের কাছে প্রিয়। নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রুখতে দর্শক ❝বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে❞ স্লোগান দিয়ে মিছিল বের করে। এমনকি- হুমায়ূন আহমেদের ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে দর্শকেরা আক্রমণ করে। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে তিনি রমনা থানায় জিডিও করেছিলেন। নাটক কতটা বাস্তব হলে এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় আর একজন লেখক বা নির্মাতা তার কাজে কতোটা বাস্তবিক হতে পারেন, তা এই ঘটনা দিয়েই বোঝা যায়।

মেঘ বলেছে যাব যাব, অপেক্ষা, লীলাবতী, নীল মানুষ, মৃন্ময়ীর মন ভালো নেই সহ দুই শতাধিক সাহিত্যের স্রষ্টা তিনি। উপন্যাস, নাটক ছাড়াও তিনি নির্মান করেছেন একাধিক পুরষ্কার প্রাপ্ত অসাধারণ সব চলচ্চিতে। হুমায়ূন আহমেদের নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ❝আগুনের পরশমণি❞। এছাড়াও শ্রাবণ মেঘের দিন, আমার আছে জল, শ্যামল ছায়া, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা তার নির্মিত চলচ্চিত্র। তার সর্বশেষ নির্মিত চলচ্চিত্র ❝ঘেটুপুত্র কমলা❞। এটিও দর্শকমহলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়।

সাইকোলজিক্যাল বা অতিপ্রাকৃত ঘরনার লেখা দিয়ে লেখক পরিচয় করান আমাদের প্রিয় ❝মিসির আলি❞ কে। ❝দেবী❞, ❝নিশীথিনী❞, ❝নিষাদ❞, ❝অন্য ভুবন❞ ও ❝বৃহন্নলা❞ তে মিসির আলিকে দেখা যায়।

❝চোখ খুব খারাপ, চোখ থেকে চশমা খুলে ফেললে সে প্রায় অন্ধ; ফলে তার ক্লাসের বন্ধুরা তাকে কানাবাবা নামে ডাকে❞ এইটুক পড়েই বুঝতে পারছেন কার কথা বলছি। হ্যাঁ, হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট আরেক চরিত্র ❝শুভ্র❞। শুদ্ধতম চরিত্রের শুভ্র। শুভ্রের যাত্রা শুরু হয় সাদা গাড়ি নামক গল্প থেকে, যদিও সেখানে সে শুভ্র হিসেবে না থেকে সাব্বির নামে ছিল। ❝দারুচিনি দ্বীপ❞ উপন্যাস দিয়ে পরবর্তীতে শুভ্র চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এটি ২০০৭ সালে চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মিত হয়।

ইতিহাস-আশ্রিত প্রথম উপন্যাস ❝জোছনা ও জননীর গল্প❞ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। এছাড়াও ❝মধ্যাহ্ন❞, ❝মাতাল হাওয়া❞ তার বেশ জনপ্রিয় লেখা। হুমায়ূন আহমেদের সর্বশেষ লিখিত উপন্যাস ❝দেয়াল❞। এটিও ইতিহাসকে উপজীব্য করে লেখা।
গীতিকার হিসেবেও হুমায়ুন আহমেদ তার প্রতিভা দেখিয়েছেন। শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রের জন্য তার রচিত ❝একটা ছিল সোনার কন্যা❞ এবং ❝আমার ভাঙা ঘরে❞ গান দুটো আজও জনপ্রিয়।

সামাজিক, অতিপ্রাকৃত, শিশুতোষ (কালো জাদুকর প্রমুখ) ছাড়াও লেখক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিও লিখেছেন। তার রচিত প্রথম সাই-ফাই ❝তোমাদের জন্য ভালোবাসা❞। এছাড়াও ❝শূন্য❞, ❝নি❞, ❝ফিহা সমীকরণ❞, ❝ওমেগা পয়েন্ট❞ ইত্যাদি।

সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদক (১৯৯৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদকসহ নানা সম্মাননা
নন্দিত এই কথাসাহিত্যিকের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর তার মাতৃগৃহে। বন্যাঢ্য সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক জীবন পার করেন তিনি। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে ২০১২ সালের ১৯শে জুলাই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। গাজীপুরে তাঁর প্রিয় নুহাশ-পল্লীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। 

বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র তিনি। তিনি চলে গেলেন সাথে করে নিয়ে গেলেন হিমু, রূপা, শুভ্র, মিসির আলিকে। হিমু কি এখনও খালি পায়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটে? রূপা কি অপেক্ষা করে? জানা হলো না। তার অসংখ্য অসমাপ্ত গল্পের মতো এটাও অসমাপ্ত হয়ে রইলো।

এখনও লেখকের বই পড়তে গেলে শুন্যতা অনুভব হয়। আসবে না নতুন কোন বই। গল্পের জাদুতে নতুন করে মাতাবেন না তিনি।
❝পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে।
শ্রাবন মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে।
সেই অলৌকিক সঙ্গীত শোনার জন্য আমি থাকব না। কোনো মানে হয়!❞ 
মানুষের জীবন এতো ক্ষুদ্র কেন?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ