আকাঙ্ক্ষা | সাবের চৌধুরী


| আকাঙ্ক্ষা | সাবের চৌধুরী |

মানুষ জাগতিক সকল তুচ্ছতা অতিক্রম করে মহান হয়ে উঠুক—এই কামনা ও এর ন্যায্যতা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ও সচ্ছলতার দরকার আছে, দরকার আছে একটু আরাম, খানিকটা আয়েশেরও; কিন্তু আবেগের মূল জায়গাটিতে থাকুক এমন কিছু, যা আমার ব্যক্তিগত আনন্দে সীমাবদ্ধ নয়; চরাচরব্যাপে বিস্তৃত, সমগ্র ও সমস্তের বেদনায় আপ্লুত এবং জাগতিক সাধ ও আহ্লাদ পেরিয়ে পারলৌকিক এক মহান জীবনের চেতনায় সমর্পিত। কিন্তু দুঃখ এই—আমি নিজেই নিজের জীবনের ভিতর মহান হয়ে উঠতে পারিনি। ফলে মহত্ত্বের এই আকাঙ্ক্ষা আমার যাপিত জীবনের বাস্তবতা নয়; অন্তর্গত চেতনা ও বিশ্বাস শুধু। এই বিশ্বাসটুকু আমি লালন করে এসেছি সেই কৈশোর পেরোনো তারুণ্যের প্রারম্ভ হতে। 

তবু, যখন যৌবনপ্রাপ্ত হলাম, টিন এজটুকু পেরিয়ে একাকী হাঁটতে শুরু করলাম তুমুল তিরিশের পানে, তখন হৃদয়ের গহিন কোথাও সন্তর্পণে জেগে উঠতে শুরু করল সলজ্জ আকাঙ্ক্ষারা। অল্প অল্প। ছোট ছোট। জীবনে সচেতনভাবে আমি কখনো বিত্তের কামনা করিনি। মনে হতো জীবনটা পেরিয়ে যাবার মতো সামান্য কিছু জুটে যায় যদি, ঢের; কিন্তু পঁচিশ পেরোনোর পর নাকের ডগায় মৃদু ঘাম নিয়ে নতমুখো কোনো রমণীকে চাইতাম, ঘরদোর উঠোন আঙিনাজুড়ে নিজস্ব পরিসরে। সেই সাথে পিতৃত্বের একটা গোপন আকাঙ্ক্ষা অযথাই আনন্দিত করে তুলত আমাকে, সময়ে সময়ে। মনে হতো, পঁচিশ পেরিয়ে এসেছি, এখন এই চাওয়া, এই সামান্য আকাঙ্ক্ষা অসংগত কিছু নয়। 

ভিতর থেকে কে যেন বলত, আমার ছোট্ট তুলতুলে একটা শিশু দরকার, যে ছোট ছোট পাগুলো সোজা আমার মুখের উপর তুলে দিয়ে খুবই অদ্ভুত কোনো ভাষায় কথা বলতে চাইবে, বোকার মতো নাকে মুখে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকবে, আর আমি ভয়ের ছলে ভিতরের উথালপাতাল সমস্ত ভালোবাসা নিয়ে গুটিয়ে সুটিয়ে আত্মসমর্পণ করব তার দুহাতের ভেতর৷ একটা শিশু একটু একটু করে চোখের সামনে বড় হবে, হাঁটবে ঘরজুড়ে, ভাঙা ভাঙা শব্দে কথা বলতে গিয়ে সবটা বুঝাতে পারবে না, তখন হঠাৎ হেসে ফেলবে; সারাদিনের পর সন্ধ্যায় বা আসরের একটু পর ঘরে ফিরব যখন, দূর থেকে দেখেই কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে, আর বাবাকে কাছে পাওয়ার আনন্দে তড়পাবে বুকের ভেতর—এইসব ভেবে আমি খুশি হয়ে উঠতে শুরু করলাম, খুব গোপনে, বুঝি বা সচেতনভাবে নিজেও টের পেতে চাই না, লজ্জায়!

এরপর স্বপ্ন একদিন সত্য হলো। নাকের ডগায় মৃদু ঘাম নিয়ে সেই নতমুখো, আর সেই তুলতুলে ছোট্ট শিশু৷ সমস্ত ঘর ও হৃদয় আলোকিত করে আল্লাহ তাআলা আমাকে দুটো কন্যাসন্তান দিয়েছেন। বিয়ের আগে সন্তানকে কেন্দ্র করে আমি যে আনন্দকে কল্পনা করতাম, অবাক হয়ে দেখলাম বাস্তবে এ আনন্দ শতগুণ বেশি। এই মধুময় পিতৃত্বকে নিবিষ্ট হয়ে আমি উপভোগ করছি শুরু থেকে।
 
আনন্দ উদযাপন বা বেদনার লগ্ন পেরোতে হয় কীভাবে? বোধ করি এখানে প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব একটা তরিকা আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি অত্যধিক আনন্দ, বেদনা ও মুগ্ধতার সামনে বিহ্বল হয়ে পড়ি। এবং আনন্দের কোনো ব্যাপার হলে খুব সুনির্দিষ্টভাবে একে তার সমস্ত ব্যাপ্তিসহ খুঁটিয়ে অনুভব করতে চেষ্টা করি। কারণ, আমার মনে হয়েছে আনন্দের যে ব্যাপারটি ঘটল, তা অল্পতেই ফুরিয়ে যাবে। জাগতিক আনন্দের ধর্মই এমন। ফলে এ থেকে নিজের মতো করে যেটুকু অনুভব আমি নিতে পারলাম, সেটুকুই পেলাম শুধু। বস্তুত নিবিড় উদযাপন ও গভীর অনুভব ছাড়া আনন্দের প্রতিটি উপলক্ষ্যই অর্থহীন। এবং গভীরতর অনুভবের মাধ্যমে স্মৃতির ভিতরে যদি একে শিলাভূত করা যায়, তা থেকে যাবে, স্মৃতি হবে সুখদ ও সমৃদ্ধ। এ স্মৃতি পরেও আমাকে দেবে সুখ ও প্রেরণা। 

তাই পরিবারের ভিতরে কাটানো প্রতিটা আনন্দমুহূর্তের দিকে আমি তাকিয়ে থাকি লোভী মানুষের মতো, পূর্ণ চোখ মেলে। কিন্তু এর ব্যাপ্তি ও গভীরতার কোনো হদিস আমি পাই না। এ যেন দিক-চিহ্নহীন এক অসীম প্রান্তর, যেখানে আমি দিকভ্রান্ত হয়েছি, হয়েছি নিখোঁজ স্বেচ্ছায়, সানন্দে। এ সময়টিতে আমার ভিতরে আবেগ ও অনুভবের যে প্লাবন বয়ে যায়, অনির্দিষ্ট ও অশরীরী অজস্র শব্দরূপে তা আমাকে অশান্ত করে তোলে। গভীর বেদনার সময়েও এমনটি ঘটে। ফলে, আমি তখন শব্দগুলোকে নির্দিষ্ট করতে চাই। শব্দের আশ্রয়ে সে আনন্দকে স্পর্শ করতে চাই আরও বেশি করে। আমি ফেসবুক নামক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটা মৌলিকভাবে ব্যবহার করি এ আনন্দ উদযাপনের অংশ হিসেবেই। লক্ষ করে দেখেছি, এখন পর্যন্ত যে বিষয়গুলো নিয়ে সেখানে লিখেছি, নির্দিষ্ট বিষয় হিসেবে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি লিখেছি শিশুদের নিয়েই। এবং নিশ্চিত করে বলতে পারি, এসব কেবল লেখার জন্য লেখা ছিল না; ছিল জীবনের আনন্দ উদযাপনের শব্দরূপ। 

সে উপলক্ষ্যগুলো কেমন, এক দুটো দৃশ্য দেখাই। আমরা ঘর থেকে বেরোতে গেলে শিশুরা কোত্থেকে যেন দেখে ফেলে, তারপর দৌড়ে এসে পিছু নেবেই। এ বোধ করি তাদের বৈশ্বিক ও সার্বজনীন প্রবণতা। জামা টেনে ধরে রাখে। তারস্বরে কান্না জুড়ে দেয়। অসম্ভব সব আবদার নিয়ে বড় জেদিভাবে পিছু নেয় অবোধ শিশুগুলো। হয়তো যেতে দেবে না, না হয় ধরবে সাথে যাওয়ার বায়না। তাদের জেদি ও আগ্রাসী ইচ্ছার কাছে সমস্ত প্রবোধ তখন নিষ্ফল হয়ে পড়ে। আমার ছোট মেয়ে হুমাইরাও এমন করে ছুটে আসে, অন্য শিশুদের মতোই; কিন্তু খুবই অদ্ভুত, অধিকাংশ সময় সে আসে সাথে যাওয়া বা অন্য কোনো বায়না নিয়ে নয়; খুব সামান্যই চাওয়া তার। দূর থেকে আকুল হয়ে ডাকতে থাকবে—বাবা, বাবা! আমি তখন দাঁড়িয়ে পড়ি। একটু নুয়ে থেকে অপেক্ষা করি কাছে আসার। বেচারি ছোট ছোট পা ফেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। যেন কতই না দরকারি কিছু! তারপর আমার চেহারাটি দু হাতে জড়িয়ে বলবে: বাবা, একটা চুমু দিব! এত আবেগ নিয়ে সে চুমু দেয়, আমার চোখে জল চলে আসে। কোনো কোনো দিন পাল্টা চুমুটা না দিয়ে ইচ্ছে করেই চলে যাওয়ার ভান করি। সে তখন কচি সোনামুখটুকু বাড়িয়ে বলে, আমাকে একটা চুমু দিন, বাবা! 

মাঝে মাঝে আমার হাত ধরে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। গেট থেকে আমাদের ঘরটির দূরত্ব একশো হাতের মতো হবে। পেরুনোর আগে আমি গেটের ছোট্ট অংশটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকি৷ আর সে এটুকু পথ দৌড়ে পার হয়ে ঘরে ফেরে। ঘর পর্যন্ত পৌঁছার আগে দৌড়ের ভিতরেই সে দুই বার হাসিমুখে পিছন ফিরে তাকায়। তারপর ঘরের লাগোয়া গেটটিতে দাঁড়িয়ে প্রথমে কচি হাত দুটো দিয়ে টাটা দেবে, তারপর বলবে আসসালামু আলাইকুম। ছোট্ট এই ফুলেল শিশুর উচ্চারিত শব্দগুলো এত নরম, পৃথিবীটা যেন মিহি দানার মতো গলে গলে যায়। 

গেট পর্যন্ত যাবার এই ঘটনাটি প্রতিদিন তো ঘটে না। এমনই এক যাবে-না-মতো দিনে আমি বললাম, আসো, বাবাকে গেটের কাছে এগিয়ে দাও! সীমানায় পৌঁছে তাকে বললাম, এখন একটু একটু দৌড় দিয়ে ফিরে যাও বাবা! সে বলল, কেন? আমি বললাম, তুমি দৌড়ে গেলে, দৌড়ের ভিতর পিছন ফিরে তাকালে, তারপর টাটা দিলে আমার ভালো লাগে। এত খুশি হলো! এরপর থেকে প্রায়ই আমাকে বলে—‘বাবা আপনার সাথে গেটের কাছে যাব। তাপ্পর দৌড় দিয়ে চলে আসব, আপনার ভালো লাগবে!’ হ্যাঁ, ঠিক এ শব্দ দিয়েই বলবে। আমি ভেবে পাই না সাড়ে তিন কি চার বছরের ছোট্ট শিশুটা ‘আপনার ভালো লাগবে’র মতো উচ্চাঙ্গের একটা হৃদয়গত ব্যাপার ধরতে পারে কীভাবে? 
আমাদের জীবনের অজস্র দৃশ্যের ভেতর ছোট্ট এই দৃশ্য দুটো আকার ও আঙ্গিকে সামান্যই; কিন্তু ছোট ছোট এই দৃশ্যগুলোতেই আমি বিভোর হয়ে থাকি। তাছাড়া মাত্র তো দুটি নয়; শিশুময় একটি পরিবারে প্রতিদিন এমন অজস্র দৃশ্য তৈরি হয়। আমি সকলের অলক্ষ্যে এসবের দিকে তাকিয়ে থাকি লোভাতুর হয়ে। জীবন কত সুন্দর! কী মনোরম এই পৃথিবী, এইসব শিশুগণ! আমি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। জীবনের কাছে এর চেয়ে বেশি আর কীই বা চাওয়ার আছে! 

আমার বিশেষ কিছু ভীতি আছে বেশ প্রবল৷ এর মধ্যে অন্যতম হলো সর্প ও উচ্চতাভীতি। আরেকটা ছিল—গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার ভয়। যদিও এটা এখন আর আগের মতো নেই। কমে এসেছে অনেক দূর। মৌলিকভাবে গাড়ি চালানোর পুরো প্রক্রিয়াটিই আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হতো। এত বড় একটা জিনিস প্রচণ্ড গতির ভিতরেও খুব সূক্ষ্মভাবে সামলে চলতে হয়। ব্যাপারটা এতই স্পর্শকাতর যে, সামান্য ভুল হলে লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে। জীবন-মরণের প্রশ্ন, ছেলেখেলা তো নয়। এ কীভাবে সম্ভব? তারপরও কৈশোরের কৈতূহল থেকে একটু করে ড্রাইভিং শিখেছিলাম। কিন্তু এ কাজে দক্ষ হতে হলে অন্তত শুরুর দিনগুলোতে বিশেষ যে নেশাটি থাকতে হয়, আমার তা ছিল না। ফলে সেভাবে চালক হয়ে উঠিনি কখনো। বিয়ের পর ড্রাইভিংয়ের প্রতি লোভ সৃষ্টি হলো নতুন করে। এই লোভের পেছনে কিছুটা অনুঘটকের মতো কাজ করেছে আমার শ্বশুরবাড়ি শ্রীমঙ্গল যাতায়াতের সুন্দর পথটি।

ইচ্ছে হতো পাহাড়ি টিলা আর চা বাগানের ভিতর দিয়ে একাকী যে পথটি চলে গেছে আনমনে, নির্জন হয়ে, আমি এই পথ ধরে ছোট্ট একটা গাড়ি চালিয়ে যাব। পাশে থাকবে প্রিয়তম একান্ত মানুষটি। প্রান্তরজুড়ে রোদ আর ছায়ার ভিতরে ছড়িয়েছে যে সবুজ আলো, এর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব চুপচাপ। ফিসফিস করে বলব—'দেখো, এখানে জীবন কী সুন্দর!' একসময় শিশুরা আসবে। মধুর কোলাহলে পূর্ণ করে তুলবে গাড়ির ভিতর, আমাদের চারপাশ। আমি দৃষ্টি সামনের পথে নিবদ্ধ রেখে হাসিমুখে তাদেরকে বলব—বাবা, হাতটা ভিতরে নাও; বাবা, দেখো, ওই যে, বানর! ওরা বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠবে। মূলত ৪০ কিলোমিটারের মতো এটুকু পথ অতিক্রম করার জন্যই আমি আবারও ড্রাইভিংয়ে মনোযোগী হলাম। 

ধীর ধীরে ভয়টা কেটে গেছে অনেকখানি৷ পারিবারিক ব্যবহারের জন্য আমাদের ভাঙাচোরা ছোট্ট নীলচে একটা গাড়ি আছে। এই গাড়ি দিয়ে শিশুগণ ও তাদের জননীকে নিয়ে শশুরবাড়ি আসা-যাওয়াটা আমার কাছে লোভনীয় একটি অভিযান। মিরপুর এলাকা পার হলেই চায়ের বাগান শুরু হয়। এরপর থেকে শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত এই পথটা এত সুন্দর! রোদের দিনেও রাবার বাগানের ভিতর জমে থাকা অন্ধকারগুলো এত কোমল! উচু টিলার উপর ঘন জঙ্গলগুলো এত অচেনা আর স্বপ্নময়! এই দৃশ্যগুলার ভেতর ঢোকার পর আমার গতি সর্বদাই শ্লথ হয়ে আসে। যেন আমি চাই না এ পথ ফুরিয়ে যাক। 

শ্রীমঙ্গল থেকে একটু সামনে গেলেই আমার নানাবাড়ি। ফলে এই পথ, টিলা, রাবারের বন আর চায়ের প্রান্তরের সাথে আমার পরিচয় সেই ছোটবেলা থেকেই। তখনো সুন্দর লাগত। কিন্তু এই সময়ে এসে সে সৌন্দর্য যেন একটি রাজকীয় ময়ূরের মতো শত পালকে পেখম মেলে ফুটে উঠেছে চোখের উপর। একটা জায়গা আছে, যেখানে এসে পথটা কিছুটা ইউটার্ন নিয়ে সরে গেছে ডান দিকে, আর একটা প্রশস্ত মেঠো পথ সোজা গিয়ে ক্রমশ নিচু হয়ে মিলিয়ে গেছ দিগন্ত বিস্তৃত চায়ের প্রান্তরে। বাঁ দিকেও চা বাগান, টিলা, একটু একটু স্বচ্ছ জল নিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি ছরা, রেইনট্রি। এখানে এসে আমি প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকি। মনে হয় যেন সেই ‘ওয়েস্টার্ন’, আর আমি কোমরে পিস্তল ঝুলানো সতর্ক এক ফোরম্যান। মাথা নিচু করে শটগান হাতে দাঁড়িয়ে আছি। শহরে নতুন আসা আউটলু’র একটি দল ঝামেলা পাকানোর পাঁয়তারা করছে। এদেরকে শায়েস্তা করতে হবে। আর সেই যে স্মৃতির ভেতর জেগে থাকা বাক্যগুলো! ফিসফিস করে বলি: 'এসো টের পাই—এই আকাশ, দিগন্ত আর বৃক্ষবিথীকা। এই ছায়া আর সবুজ প্রান্তর!' পিচ্চি হুমাইরা আর বারীরা যখন হইচই করে ওঠে—বাবা, কী সুন্দর! আমার তখন মনে হতে থাকে এ যেন বাস্তব নয়। স্বপ্নের ভেতর ডেকে উঠেছে বিস্ময়ে আচ্ছন্ন এই শিশু দুটো। 

আমি জানি, জাগতিক সাধ ও আহ্লাদের কোনো সমাপ্তি নেই। সেসবে মগ্ন হয়ে জীবনকে জাগতিক তুচ্ছতায় বিলীন করার কোনো অর্থ হয় না। ফলে আদর্শ ও বিশ্বাসগত দিক থেকে পার্থিব আনন্দ ও অভিসারকে আমার মনোযোগের কেন্দ্রে নিতে সম্মত নই। আমি তো মূলত ভাবুক হতে চাই৷ চালচুলোহীন সেই দরবেশের মতো, যে আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজছে অচেনা অলৌকিক কোনো পথ! 

তবু, আমাদের জীবনে যে প্রেম আসে, আসে সংসার, প্রণয়িণী, মমতায় আচ্ছন্ন শিশুর দল, এসব তো তুচ্ছ নয়। খোদার অপার অনুগ্রহ। পরম আনন্দে তুলে নিই তাই মাথায়, চোখে, বুকের গভীরে, হৃদয়ের মণিকোঠায়। 
এ পৃথিবীতে মানুষের দুঃখেরও অন্ত নেই। একেকজনের দুঃখ একেকরকম। সাদা কালো লাল নীল। কারোটা কারো সাথে মিলে না। এসবের ভিতর দিয়েও কোনো কোনো চোরাপথে আসে সুখ, আসে আনন্দ। পৃথিবীর জীবনটাই এমন—সুখ দুঃখের অদ্ভুত মিশেল। আমার জীবনেও অজস্র দুঃখ আছে। কিন্তু আমি সবসময় চেষ্টা করেছি সামান্য যেটুকু সুখ পাই, গভীরভাবে আঁকড়ে ধরতে, উপভোগ ও উদযাপন করতে। হাজারো পীড়ন ও যন্ত্রণার ভিতর পরিবার আমার কাছে তাই তপ্ত মরুর বুকে সুন্দর সবুজ একটি উদ্যানের মতো। 

এই গল্প আমি কেন করলাম জানি না। হয়তো সে কারণটিই, যার কথা পেছনে বলে এসেছি: আনন্দ ও বেদনা সকল কিছুকে আমি শব্দ দিয়ে টের পেতে চাই, নির্দিষ্ট করতে চাই হৃদয়ের অস্ফুট উচ্চারণ। হয়তো এটিও একটি কারণ যে, এর ভেতর দিয়ে আমি মূলত একটা আক্ষেপ প্রকাশ করতে চাই সেসব মানুষের প্রতি, যারা পরিবার বিষয়টিকে জীবনের ভিতর গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করে না। আমার বালকবেলার বন্ধুদের মাঝে অনেকেই আছে, তিরিশ পেরিয়েছে অনেকদিন হলো, তবু একা। জিজ্ঞেস করলে বলে: ‘এই তো, আর কটা দিন—একটু দাঁড়িয়ে নিই।’ আমি ভেবে পাই না আর কোথায় দাঁড়াতে চায় তারা! কীসের অপেক্ষা করে? ক্যারিয়ার কি এতই জটিল কিছু যে, জীবনের স্বর্ণ সময়টা পার করে ফেলতে হবে একা, নিদারুণ অবহেলায়? সচ্ছলতা, সাবলম্বী হওয়া এসবের শেষ পর্যন্ত মানে কী আসলে? 

আমার অবাক লাগে সেসব মানুষের প্রতিও, যারা মোটামুটি চলবার মতো সম্পদ উপার্জনের পরও আরও আরও সম্পদের নেশায় বছরের পর বছর পড়ে থাকে বিদেশ বিভুঁইয়ে, স্ত্রী-সন্তান সব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, একা। কী দরকার? সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে উজ্জ্বল নাকের ডগায় মৃদু ঘাম নিয়ে নতমুখো মানুষটাকেই যদি দেখা না গেল, কচি হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে বাবা বাবা বলে দুর্বল পায়ে শিশুটিই যদি এগিয়ে না এল, তবে এ সম্পদের অর্থ কী? বিস্মিত হই তাদের প্রতিও, যারা সামান্য রাগে অভিমানে ভেঙে দেয় সোনার সংসার, নষ্ট করে ফেলে সম্পর্কের অনাবিল সে মাধুর্য! আহা! 

পরিবার—পৃথিবীতে মানুষের শত সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ উপার্জন। মানব সভ্যতার অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা। চলমান বিরূপ এই সময়ে এসে দিকে দিকে ‘পরিবার’ ধারণাটি মহিমা হারাচ্ছে। বিকল্প খুঁজছে মানুষ। একে শৃঙ্খল মনে করে স্বাধীন হতে চাইছে ব্যক্তিগত আনন্দ ও উন্মাদনায়। কিন্তু আমি জানি, ‘পরিবার’ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে আপন মহিমায়, সে শক্তির বলেই, যে শক্তির বলে সে গড়ে উঠেছিল। মুনাজাত করি, তাই যেন হয়। 

সাবের চৌধুরী
কথাসাহিত্যিক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ