একটি ডিম পাড়তে মুরগির কতটুকু তেল লাগে?

একটি ডিম পাড়তে মুরগির কতটুকু তেল লাগে? boipaw

আমাদের এলাকার রহমত ভাইয়ের কাছ থেকে আমরা নিয়মিত ডিম কিনি। প্রতিটি ডিমের স্বাভাবিক দাম ১০ টাকা হলেও হঠাৎ দেখি রহমত ভাই ডিমের দাম বাড়িয়ে ১২ টাকা করে দিল। কারণ জিজ্ঞেস করলে রহমত ভাই বলল—‘ডিজেল, অকটেন আর পেট্রোলের দাম বাড়ায় ডিমের দামও বেড়েছে’… এ কথা শুনে আমার সাথে থাকা অন্য একজন কাস্টমার তো রেগেমেগে আগুন, সে রহমত ভাইকে ধমকের সুরে বললো—‘মিয়া, তামাশা করো আমাগো লগে? তেলের দাম বাড়লে ডিমের দাম ক্যান বাড়বো? ডিম পাড়তে কি মুরগির তেল লাগে?’ …এমন প্রশ্ন শুনে আমিও তাজ্জব বনে গেলাম। আসলেই তো, ডিম পাড়তে তো মুরগির তেল লাগে না; তাহলে তেলের দাম বাড়লে মুরগির ডিমের দাম কেন বাড়বে?
তেলের দাম তো বেড়েছে; ভবিষ্যতে আরো বাড়ার আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তেলের দাম বাড়ার সাথে-সাথে বাড়ছে অন্যান্য সবকিছুর দাম। যারা প্রকাশনী ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেন—তাদের ইতোমধ্যেই মাথায় হাত, কারণ কাগজের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ! ভোজ্যতেল আর সবজীর বাজার ছিলো আগে থেকে চড়া, এবার বোধহয় দাম ধীরেধীরে লাগাম ছাড়া হতে শুরু করবে। বাড়বে চাল-ডালসহ নিত্য-প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসের দাম।
কিন্তু জ্বালানী তেলের দাম বাড়লেই অন্যান্য এমন সব পন্যদ্রব্যের দামও সাথে-সাথে কেন বাড়ে—যে পণ্য উৎপাদনের সাথে তেলের কোনো সম্পর্কই নেই? অনেক সময় আমরা তেলের সাথে সম্পর্কহীন পন্যের দামবৃদ্ধির কারণে অনেককে জালিম আখ্যা দিতেও ছাড়ি না; গোটা জাতির চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করতেও কার্পন্য করি না! অনেকেই ভাবেন—নিশ্চয়ই অসাধু-অসৎ ব্যবসায়ীরা গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সাথে-সাথে অহেতুক জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে ক্রেতাদের ভোগান্তিতে ফেলে, আর নিজেরা লাভবান হয়!!
আসলে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সাথে জড়িত। কিন্তু আমরা অর্থনীতির বেইসিক কনসেপ্টগুলো ঠিকমতো বুঝি না। ভিন্ন ফিল্ডের অনেক উচ্চশিক্ষিত লোকজনও বাজার ও অর্থনীতির মধ্যকার বিভিন্ন মিথস্ক্রিয়া ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারে না।
কোনো কিছুর দাম কেন বাড়ে? ইকোনমিক্সের থিওরি মতে—দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি-হ্রাসের সম্পর্ক রয়েছে বাজারে কোনো দ্রব্যের বিদ্যমান চাহিদা ও যোগানের সাথে। অর্থাৎ বাকীসব ডিটারমিন্যান্ট ঠিকঠাক থাকা সাপেক্ষে কোনো দ্রব্যের চাহিদা অনুপাতে সাপ্লাই কম হলে দ্রব্যটির দাম বাড়ে; আবার চাহিদা অনুপাতে সাপ্লাই বেশি থাকলে দ্রব্যটির দাম কমে। কিন্তু কিছুকিছু জিনিস রয়েছে—বাজারে সেগুলোর ঘাটতি শুধু ওই জিনিসগুলোর দামই বাড়ায় না, বরং নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রত্যেকটা জিনিসেরই দাম বাড়ায়।
খনিজ তেল, গ্যাস আর বিদ্যুতের মতো জ্বালানীগুলোর সাথে সার্বিক উৎপাদনের রয়েছে সরাসরি সম্পর্ক। তাই এইসব জ্বালানী ব্যবহার করে যা-ই উৎপাদন করা হোক না কেন—সেসবের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, ফলে উৎপাদনকারী প্রয়োজনীয় প্রফিট অর্জনের লক্ষ্যে তার উৎপাদিত পন্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দেন।
রহমত ভাইয়ের গল্পে ফেরা যাক।
রহমত ভাই ৫০ টা মুরগী পালেন, সে মুরগিগুলো প্রতিদিন গড়ে ৪০ টা করে ডিম পাড়ে। রহমত ভাই ডিমগুলো প্রতিটা ১০ টাকা দরে মোট ৪০০ টাকায় প্রতিদিন বাজারে বিক্রি করে, সেই টাকা মুরগির খাবার কেনার পাশাপাশি নিজের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের জন্য বিভিন্ন খাতে খরচ করে। কিন্তু হঠাৎ জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে যাতায়াত খরচসহ অনেক পন্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যায়। রহমত ভাই দেখল, মুরগীর খাবার ক্রয়সহ অন্যান্য যেসব প্রয়োজনগুলো সে তার দৈনিক ডিম বিক্রির ৪০০ টাকা দিয়ে পূরণ করত—সেটা আর ৪০০ টাকায় সম্ভব হচ্ছে না; বরং ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮০ টাকা। কিন্তু রহমত ভাইয়ের কাছে তো ডিম বেচার সেই ৪০০ টাকাই রয়েছে। ফলে নিজের একই প্রয়োজনগুলো পূরণ করতে রহমত ভাইকে প্রতিটি ডিমের দাম ১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।
রহমত ভাইয়ের গল্প থেকে আমরা দেখলাম—ডিম পাড়তে মুরগীর কোনো জ্বালানী তেলের প্রয়োজন না হলেও কীভাবে জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি ডিমের দাম বাড়িয়ে দেয়। এমনটা শুধু ডিমের ক্ষেত্রে ঘটে না, ঘটে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পন্যের ক্ষেত্রেই।
এই লেখার অবতারণা শুধু এই ব্যাপারটাই ধরিয়ে দিতে যে—জ্বালানী পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলে যে উৎপাদন খরচ বাড়ে—তাতে করে বাজারে টিকে থাকার তাগিদে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়িদের নিজেদের পন্যের দাম বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না।
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ