অরুণিমা : আহসান কবীর - সামাজিক-রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস | Arunima

At A Glance Of Arunima

  • বই : অরুণিমা
  • ঘরানা : সামাজিক-রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস
  • লেখক : আহসান কবীর
  • প্রচ্ছদকার : পরাগ ওয়াহিদ
  • প্রকাশনা : ভূমিপ্রকাশ
  • প্রকাশকাল : মার্চ ২৬, ২০২১
  • পৃষ্ঠাসংখ্যা : ২৭০
  • মুদ্রিত মূল্য : ৳৩৮০

সংক্ষিপ্ত ধারণা

“শহরটা সত্যিই ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে কাজী সাহেবকে, যেন ভূতেরই শহর। শহর ভূত বা কবি যার দখলেই যাক সবচেয়ে ভয়ংকর চেহারাটা নেয়; ভূতের দখলে গেলে শহরবাসীর জন্য ভয়ংকর, কবির দখলে গেলে নেতাদের জন্য।”

কবির কাছে যা প্রেমিকা, পুঁজিপতির কাছে তা পণ্য। কবির কাছে যা প্রত্নতত্ত্ব, পেটি-বুর্জোয়ার কাছে তা আবর্জনা। কবির কাছে যা বিপ্লব, ডানপন্থীর কাছে তা অশ্লীলতা। কবির কাছে যা ধর্ম, বামপন্থীর কাছে তা মেয়াদোত্তীর্ণ। কবির কাছে যা ইতিহাস, গোঁড়াপন্থীর কাছে তা অপচয়। প্রেমিকা-প্রত্নতত্ত্ব-বিপ্লব-ধর্ম-ইতিহাসকে কবিতায় ভরে কবি যখন নেতার মুখোমুখি, কবিতা তখন নেতার কাছে কী?

অরুণিমা উপন্যাসের আখ্যানে এক রাজনৈতিক নেতা এবং এক কবির গল্প বলা হয়েছে যারা অপরাজনীতি এবং উগ্রসাংস্কৃতিক চর্চার মাঝে ‘একা’। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নেতাকে কবির খোঁজে বের হতে হয় এবং এই যাত্রাপথে সে শেকড়চ্যুত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দশার নানারকম স্তরের মুখোমুখি হয়। এই একেকটা স্তরে উঠে এসেছে একেকটা স্বতন্ত্র উপাখ্যান, স্বতন্ত্র কিছু চরিত্র। প্রাসঙ্গিক এসব উপাখ্যান, তার সাথে জড়িত বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে একজন কবির খোঁজে একজন রাজনৈতিক নেতার যাত্রাপথের ওপর বিস্তৃত হয়েছে এই উপন্যাসের অবয়ব।

প্রারম্ভ

তিনবার সাংসদ নির্বাচিত হওয়া বর্তমান এমপি কাজী আমানুল্লাহ সাহেব। ‘দো-আঁশ’ নামক স্থানীয় একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তাঁকে একটা ভাস্কর্য উদ্বোধনের জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে উদ্বোধনের তারিখ পড়ে যায় রমজান মাসে। ‘জামাতুল মুসলিম’ নামক আরেকটি রাজনৈতিক সংগঠন তা মেনে নিতে যারপরনাই অসম্মত। ফলে—এই দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের মাঝে পড়ে যান কাজী সাহেব। নির্বাচন আসন্ন। সেজন্য তাঁকে দু’দিক সামাল দিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। এদিকে, ব্যাপারটা খানিক আঁচ করতে পেরে সাংস্কৃতিক সংগঠন ও অন্যান্য কবি পরিষদের কবি-সাহিত্যিকরা তাঁর বিরুদ্ধে কলম তুলে নেয় এবং বিবৃতি পেশ করে। এসময় তিনি নিজের অধস্তনে এমন একজন কবির অভাববোধ করেন, যে তাঁর পক্ষে সর্বসমক্ষে কলমের মাধ্যমে জবাব দেবে। এই লক্ষ্যে তিনি তার সহকারী আব্দুল হককে সাতদিন সময় দেন একজন কবি খুঁজে আনতে৷ আর সেই কবির খোঁজেই ‘অরুণিমা’ আখ্যানের সূচনা।

পাঠ-প্রতিক্রিয়া—

বইটা পড়ার পর, ফেলুদার মতো করে বলা আমার মুখনিঃসৃত প্রথম শব্দ—“মোক্ষম”!

শিল্প তো এমন হওয়া চাই, যা শিল্পপ্রেমীদেরকে নৌকার গুণ টানার ন্যায় টেনে ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবে নদীতটের (কাহিনির) প্রান্ত অবধি। একটা উপাখ্যান বেশ ক’দিন পাঠকের মস্তিষ্কে হুটোপুটি করানোর ক্ষেত্রে ‘অরুণিমা’ দারুণ এক কীর্তি। আমি লেখককে চিনতাম না, কখনো তার পোস্টও পড়া হয়নি। এক জায়গায় উপন্যাসটার কাহিনি-সংক্ষেপ পড়ে মূল বই পড়ার আগ্রহ জন্মেছিল। যা-হোক, তেলবাজির মতো লাগলেও... আমি হলপ করে বলতে পারি, এটা ভূমির মৌলিকগুলোর মধ্যে একটা ‘Souvenir’ হয়ে থাকবে।

আমি খুবই সাধারণ মানের একজন পাঠক, সে হিসেবে ‘অরুণিমা’ আমার জন্য অসাধারণ এক অভিজ্ঞতার নাম। উপন্যাসটিকে উপমা খণ্ড, বেহুলা খণ্ড, শরীর খণ্ড, মনসা খণ্ড—এই চার ভাগে বিভক্ত করে একই সূত্রে এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর ঘটনাপরিক্রমা, শৈল্পিক ছাঁচ, বাক্যপ্রবাহ, গল্পের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন, অতীত রোমন্থন, কবিতা প্রয়োগে স্থান-নির্দিষ্টতা, ভাবাবেগ, দৃঢ়তা, বিসর্জন, কূটনীতি, জন্ম-মৃত্যু, প্রণয়-পরিণয়, ভ্রমণবৃত্তান্ত প্রভৃতি একে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উৎকর্ষ দিয়েছে। আমি সাধারণত কবিতা পড়ি না বললেই চলে, তবে মাঝেমধ্যে প্রেমিকার জন্য টুকটাক লিখেছি। কতক দৃশ্যে-কতক কথোপকথনে ‘কবি’ চরিত্রটা আমাকে ধারণ করে রেখেছে, না-কি আমিই কবিকে ধারণ করে আছি—দ্বিধান্বিত ছিলাম। কী দারুণ এক চরিত্র সে! নিজের সাথে তুলনা করাটা রীতিমতো ধৃষ্টতা।

বইটিতে কয়েকটা কবিতার কিছু পঙক্তি আমার চক্ষু ঝাপসা করার পর মনে হলো, আমার কবিতা পড়া উচিত, আমাদের কবিতা পড়া উচিত। প্রশ্ন জাগতে পারে, রাজনীতির সাথে সাহিত্যের কী সম্পর্ক—তাও আবার কবিতার? আহসান কবীর সেটা হাতে-কলমে করে দেখিয়েছেন। এতসব চরিত্র, অথচ সবাই কেমন করে শিকলাবদ্ধ! বইটি পাঠককে রাজনীতির শেকড় জানাবে, আপন-ভাবা-জনের প্রতি কেয়ারিং শেখাবে, একটা পতিত অঞ্চলের সমাদৃত হয়ে ওঠার গল্প বলবে। বইটি ইতিহাসভিত্তিক, রাজনীতিকেন্দ্রিক, নদীমাতৃক—সর্বোপরি কবিসত্তায় যাপিত সহস্র জীবনের গল্প-সমারোহ।

পড়ার আগে থেকেই কেন যেন মনে হচ্ছিল, লোকটা বুঝি পরিপক্ব হয়েই সাহিত্যিক অঙ্গনে নিজেকে জাহির করতে নেমেছে।

কাকতালীয়ভাবে এই ‘মনে হওয়া’ থেকে আমি আর সরে আসতে পারিনি। দক্ষ ও দূরদর্শী কলমে লেখক কিছু নির্মম সত্য উন্মোচন করেছে, যা পাঠককে ভাবাবে। তার শব্দশৈলী, মানসিক বিবর্তনের ক্ষমতা, গল্পকথন কিংবা স্মৃতিরোমন্থনের ঢং—অকৃত্রিম প্রশংসার দাবি রাখে। বইটিকে আমি সামাজিক-রাজনৈতিক তকমার সাথে ‘মনস্তাত্ত্বিক’ জুড়ে দেওয়ার কারণ হলো, লেখক মনস্তত্ত্ব নিয়ে উৎকৃষ্ট কিছু কাজ রেখে গেছে প্রায় প্রতিটি চরিত্রে। অনেক চরিত্রের মিশেলে বইটি দুই-এক জায়গা বাদে খুব বেশি খেই হারায়নি।

কুমুবউ’কে এক নজর দেখার ইচ্ছে হচ্ছিল, হাসিটা এক মুহূর্ত শোনার শখ জাগছিল। প্রাকৃতিক বিবরণ আর নদীর বর্ণনাগুলো অনিন্দ্য! বইয়ে বানান-বিভ্রাট কিংবা বাক্যের অসামঞ্জস্যতা তেমন একটা চোখে পড়েনি। গল্প উপভোগকালীন সময়ে এগুলো চোখে পড়ারও কথা না। স্বল্প ও দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করা সবগুলো চরিত্রই উপন্যাসের কাহিনি বিল্ড-আপে উপযুক্ত ভূমিকা রেখেছে। পরিশেষে… লেখকের আগামী কাজগুলোর জন্য শুভকামনা রইল। প্রচ্ছদটা নয়নাভিরাম, প্রচ্ছদকারের কাজ আরো সমৃদ্ধ হোক। বাকি সকলে ভালবাসা জানবেন। বইটি সংগ্রহে রাখার জোর সুপারিশ করছি।

প্রিয় উক্তিসমূহ—

• “সম্পর্কের দূরত্বকে কিলোমিটারে মাপছেন, আলম সাহেব! সম্পর্কের দূরত্বের একক হলো ‘বোঝাপড়া’।”

• এসব শুনে তুমি কী ভাবছ, অরুণিমা, আমি জানি না।
আমি ভাবছি, “খাঁটি হতে পুড়তে হয়?
না-কি ক্ষয়ে ক্ষয়ে জীর্ণ হয়ে
প্রাচীনতার দৈর্ঘ্য প্রমাণ করতে হয়”!

• সম্পর্কের ব্যাপারটা প্রাকৃতিক, আর প্রকৃতি হিসাব বুঝিয়ে দেওয়ার বেলায় সাম্যবাদী।

• গণতন্ত্রে রাজনীতিক আর পুঁজিপতিদের একে অপরের ওপর নির্ভর করতে হয় ঠিকই, কিন্তু বিশ্বাস করতে হয় না।

• ক্ষতস্থানের রক্তের লাল আর গোলাপের লাল এক না। কিন্তু আমরা বোধ হয় লাল বলতেই গোলাপের লাল বুঝে ভুল করি।

• কবিকে নিয়ে মেয়েটা কিছু বলতে চায় না—মানে হলো, কবিকে নিয়ে না-বলার মতো কিছু সুন্দর বা অসুন্দর মুহূর্ত তার নিকট জমা আছে।

• ‘তুমি শিক্ষিত কিন্তু তোমার পেটে ভাত নাই’ এই কথার চেয়ে ‘তুমি শিক্ষিত কিন্তু তোমার কোনো রাজনৈতিক বা দার্শনিক মতাদর্শ নাই’—এটা যেন বেশি বেমানান শোনায়।

• ভাঙা আর গড়া নিয়ে একই জীবনের পরস্পর দুই মেরুতে মানুষের অবস্থান।

• ধুলোবালি জমা বিছানার চাদরটা ঝাড়লও না সে। ধুলোবালিরা জানুক, পৃথিবীটা খাটের মতো—ধুলোরা ঘাসের মতো। এরা যার যার জায়গায় ঠিকই থাকে, শুধু মানুষরা জন্ম আর মৃত্যুর মাঝে এই ঘাসে দু’দণ্ড শুয়ে-বসে যায়। এই দু’দণ্ডের প্রতাপেই তারা ঘাস তুলে ফেলতে চায়; সেখানে বসার মাচা, শোয়ার বিছানা পাতে। দুইদিন পর দুইদিনের মেহমান এই মানুষ বিদায় নিলে ঘাস আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মানুষ পড়ে থাকে কবরে, সেই কবরের বুকেও ঘাস মাথা তুলে দাঁড়ায়। 

[ছবি কৃতজ্ঞতা: শুভঙ্কর শুভদা…]

গঠনমূলক রিভিউ করেছেন—আল কাউসার আব্দুল্লাহ। তাঁকে বইপাও.কমের পক্ষ থেকে অশেষ ধন্যবাদ। 

📚 [বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে, বইনগর, বিবিধ, বুক হার্বার, ধী, বুক সিটি, রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন শপে যোগাযোগ করতে পারেন।]

অরুণিমা : আহসান কবীর

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ