অভিমান জিনিসটা আসলে কী, এ বুঝিয়ে বলাটা বোধ করি অহেতুক হবে। কারণ এটা এমন এক ঘটনা, যার অভিজ্ঞতা আমাদের সবার জীবনেই আছে৷ এবং এর সাথে যে প্রেম ভালোবাসা ও স্নেহের একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে, এ সত্যটিও সবার সামনে উজ্জ্বলতরভাবে প্রকাশিত৷ বস্তুত, অভিমান আমাদের হৃদয়গত এই নৈকট্য ও প্রেমবোধেরই বিচিত্র প্রকাশ। যার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক যত গভীর, তার উপর অভিমানের দাবিও তত বেশি৷ আমি ছোটবেলা থেকেই ঘরমুখো মানুষ। যদিও ছাত্রজীবনের দীর্ঘ একটা সময় বাইরে বাইরে কাটাতে হয়েছে; কিন্তু অল্প কয়েকজন ছাড়া বহির্জগতের মানুষদের সাথে অভিমান করবার মতো ওই অর্থের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়নি কখনো৷ ‘ওই অর্থের ঘনিষ্ঠতা’টা কী জিনিস? এই জায়গাটায় আমার উপলব্ধি একটু বলি।
বহির্জগতে আমরা নানা মানুষের সাথে লেনদেন, ভাববিনিময় ও সম্পর্কে জড়াই। এসব অগুরুত্বপূর্ণ নয়, সামান্য বা তুচ্ছও নয়। সম্মানি, শ্রদ্ধাপূর্ণ ও জীবনের সার্বিক আয়োজনে অনিবার্যও বটে; কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটি হয়, এ সম্পর্কগুলো আমাদের আত্মায় কোনো শেকড় তৈরি করতে পারে না৷
ফলে, ছাত্রজীবনে উদ্দাম সম্পর্ক ছিল যাদের সাথে, যাদের সাথে একদিনের চায়ের আড্ডা মিস হলে মনে হতো জগতের কোথাও বিরাট গোলযোগ পড়ে গেছে, সেই তাদের সাথেই পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে আসার পর বছরের পর বছর চলে যায়, কে কোথায় কেউ জানি না। হঠাৎ কোথাও কোনো ভিড়ে সাক্ষাৎ ঘটে গেলে তুমুল কিছু মুহূর্ত; তারপর যে যার পথে। আমরা বিশেষ একটি আয়োজনের ভিতর একত্রে সময় কাটিয়ে পরস্পরের স্মৃতিকে সমৃদ্ধ করেছি, সুখদ ও স্বপ্নময় করেছি; কিন্তু ভালোবাসার কোনো দায় অনুভব করিনি, বা বলা ভালো দায় অনুভব করার মতো ভালোবাসাটা গড়ে ওঠেনি। তবে, স্মৃতির আবেশমেশা সুন্দর সম্পর্কটা থেকে যায়। যেকোনো উপলক্ষ্য ও প্ররোচনায় তা জীবন্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু অভিমান করবার মতো ঘনিষ্ঠতা—সেই যে আত্মার ভিতরে ঢুকে পড়া শেকড়—তা কি গড়ে ওঠে? অবশ্য এর ভিতরে ব্যতিক্রম থাকে। আবার অনেক সময় কর্মজীবনে প্রবেশের পর পুরনো সহপাঠীর কারো কারো সাথে গড়ে ওঠে নতুন যোগাযোগ৷ কিন্তু গড়পরতা হিসাবটা তেমনই, যেমনটি উপরে বলে এসেছি।
এই সম্পর্কগুলো থেকে আঘাত এলে আমরা প্রথমত একধরনের কষ্ট পাই, যেটি আমাদেরকে অভিমানের সীমানা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না৷ এরপর বিরক্ত হই এবং ‘ধুর, আমার কী!’ বলে সেই সম্পর্কটি থেকে চোখ বন্ধ করে ফেলি।
এর বিপরীতে জীবনজুড়ে হৃদয়ের গভীরতর লেনদেন সবটুকু হয় আম্মা আব্বা আর ভাইবোনদের সাথে। কারণ, এখানের ভালোবাসাগুলোর মৌলিকত্বই হলো আত্মার অনেক গভীরে ঢুকে যাওয়া। তাই অভিমানটা হয়ও মূলত তাদের সাথেই। আজকে যখন নিজের সাদাকালো জীবনেতিহাসটির দিকে পেছন ফিরে তাকাই, দেখি সেখানে ছোট ছোট বেশ কিছু অভিমানের ঘটনা আছে, যার বেশিরভাগ বা বলতে গেলে সবটুকুই নিতান্ত ছোটবেলায় ঘটা, তুচ্ছ সব বিষয়কে কেন্দ্র করে। মোটামুটি বড় হবার পর এই ব্যাপারটা খুব একটা ঘটেনি আসলে। আম্মা আব্বা ভাইবোনদের থেকে কষ্ট পাওয়ার মতো বলতে গেলে কিছুই ঘটেনি।
আল্লাহ তাআলার প্রতি আমার দিল উজাড় করা কৃতজ্ঞতার শেষ নেই এ জন্য যে, তিনি আমাকে এমন একটি পরিবারে জন্ম দিয়েছেন, যেখানে আর্থিক অনটন ছিল; কিন্তু কখনো ভালোবাসার অভাব ছিল না। আমরা পরস্পরকে পাগলের মতো ভালোবেসেছি। সবাই এখন বড় হয়েছি, বড় ভাইয়ার বয়স ৪৫ পেরিয়েছে, সবারই হয়েছে পরিবার সন্তান; কিন্তু আমরা এখনো আছি সেই আগের মতো: হাসি আনন্দে, স্নেহে শাসনে, শ্রদ্ধায় আনুগত্যে। কদাচ কারো সাথে মন খারাপ হয়েছে সত্য, কিন্তু একটু পরই আবিষ্কার করেছি ভুলটা আমার। তখন বিনীত হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছি। এ কারণে জীবনে পরিবারের ভিতরে সত্যিকারের অভিমান করবার সুযোগটা পেয়েছি নিতান্ত কম৷
অবশ্য, আম্মা যখন সুস্থ ছিলেন, তখন মাঝে মাঝে তাঁর সাথে এই ব্যাপারটা ঘটত। কিন্তু এর হিসাবটা একটু আলাদাই রাখতে হবে। কেন আলাদা রাখতে হবে, এই বিষয়টা বুঝিয়ে বলা মুশকিল আসলে। কারণ, জননীদের সাথে পৃথিবীর সন্তানদের সম্পর্কের যে গভীরতা, ধরন ও প্রকৃতি, একে ব্যাখ্যা করবার মতো শব্দ ও ভাষা কি জন্ম নিয়েছে পৃথিবীতে? আম্মার সাথে আমার অযথাই অভিমান করতে ইচ্ছে করত। এসবের উপলক্ষ্যও ছিল বিচিত্রতর।
হয়তো ঘুম খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করছি না বলে আচ্ছামতো বকে দিয়েছেন। আর আমি নিজের একটি হাঁটু উঠিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে রেখে, অপর হাঁটুটা বিছিয়ে, দাঁত দিয়ে ডান হাতের আঙুলের নখ কাটতে কাটতে কিছু সময় তাকিয়ে থেকেছি তার মুখের দিকে। নিজের জীবনের এই বিস্রস্ততার কারণে নিজেরই মন খারাপ হয়ে আছে; এবং একটু পর কোনো এক অদ্ভুত হিসাবে সেটাই পরিণত হয়েছে আম্মার প্রতি অভিমানে। তারপর শুধু চেহারাটা জানালার দিকে ঘুরিয়ে তাকিয়ে থেকেছি বাইরে, আঙিনায়। আম্মা তখন বুঝে ফেলতেন আমার মন খারাপ হয়েছে। তার কথার সুর পালটে যেত। কিন্তু ততক্ষণে আমি ট্র্যাপে ফেলে দিয়েছি তাঁকে। মানসিকভাবে আমিও ঢুকে পড়েছি মনোরম এক দ্রবণের ভিতর।
তারপর সময় বয়ে যেত, আম্মার কষ্ট বাড়ত এর সাথে পাল্লা দিয়ে। ছটফট করতেন তিনি। আমার এ অভিমানগুলো কি সত্যিই ছিল, নাকি মিছে অভিমান? আমি কিছুই বুঝি না; শুধু এটুকু যে, এ থেকে যে অদ্ভুত আনন্দ ও মনোরম উপলব্ধিটি সৃষ্টি হতো, এর কোনো তুলনা হয় না। মন খারাপ করে থাকলে বা কথা না বললে আম্মা সহ্য করতে পারতেন না। কোনো কোনো দিন কেঁদেও ফেলেছেন। আচ্ছা, আম্মা কি বুঝতেন তাঁর সাথে অভিমান নিয়ে আমার এসব মূলত পাগলামিই ছিল?
আর অভিমানটা শুধু কি আমিই করেছি? আম্মাও করতেন। আমিও তেমনি ছিলাম, তাঁর মতোই। একটু পর পা দুটো মুখের সাথে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতাম। কতভাবে যে খুশি করার চেষ্টা করতাম, কত ছলনায়। তবে, আগেই বলেছি পরিবারের মানুষদের সাথে এইসব অভিমানের ঘটনা প্রায়ই যে ঘটত এমন নয়; মাঝে মাঝে। ফলে ‘ছেলেটা বড় বেশি অভিমানী’—কোমল এই নিন্দাবাক্যটি দিয়ে আমাকে চিহ্নিত করবার সুযোগটা কম আসলে।
.
কিন্তু বিয়ের পর অভিমান নিয়ে আমার ভিতরে নতুন একটি প্রবণতা ও চিন্তা সৃষ্টি হয়েছে। হয়েছে নতুনতর অভিজ্ঞতা। সেই ব্যাপারটা একটু বলি। লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি, অভিমান আর রাগ-বিরক্তি এক নয়। রাগ হলো আগুনের মতো। যা জ্বালিয়ে ভস্মিভূত করে দেয় ঘরদোর, হৃদয়, সম্পর্ক ও সম্ভাবনা। রাগ তাই ধ্বংসপ্রবণ। কিন্তু অভিমানে ধ্বংস নেই। আছে নির্মাণের আকুলতা। অভিমান মূলত ভালোবাসা ও প্রেমেরই বিচিত্র প্রকাশ। ভালোবাসা আপ্লুত হৃদয়ের আনন্দপ্রবাহটি যখন কোনো কারণে বিঘ্নিত হয়, তখনই তা পথ পরিবর্তন করে অশান্ত জোয়ার ও প্লাবনের সৃষ্টি করে। একেই অভিমান বলি। ‘বিরক্তি’ শব্দটা আপাতত মুঠোর ভিতরে রেখে দিলাম। তবে কথা দিচ্ছি, সামনে উপযুক্ত জায়গায় গিয়ে হাতের মুঠো খুলে দেবো।
যে আমি অভিমানে অভ্যস্ত ছিলাম না, সে আমিই বিয়ের পর ঘন ঘন অভিমান করতে শুরু করলাম। নতুন এই সম্পর্কটি ছিল পৃথিবীর অন্য সকল সম্পর্ক থেকে উপাদান ও বৈশিষ্ট্যে, আচরণ ও প্রবণতায় সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে প্রেমেকামে মিলেমিশে অদ্ভুত এক রসায়ন। সম্পর্কের উপলব্ধিটিও তাই বিশেষ রকমের মনোযোগিতায় পূর্ণ, প্রবলভাবে প্রকাশিত এবং স্পর্শে অত্যধিক কাতর। এই মানুষটির সাথে অভিমানের পর যেন মিহি সুরে গভীরতর শব্দাবলি নিয়ে বেজে উঠত একটি উচ্চাঙ্গ সংগীত। যেখানে সুরের প্রতিটি বাঁক ও পতন, প্রলম্বিত রেখা ও উত্থান পেরিয়ে যেতে হয় নিবিড়তম অনুভবের ভিতর দিয়ে। খুব সূক্ষ্ম কারুকাজে এ সংগীত তাই হৃদয়কে করে তুলত আচ্ছন্ন ও মোহগ্রস্ত। দিন দিন আমি যেন এই হৃদয়ানন্দ উপভোগের নেশায় পড়ে গেলাম।
কিন্তু সেই সাথে টের পেলাম আরও একটি ব্যাপার। এমন বুক প্লাবিত করা অভিমানের জন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন আত্মার গভীরে ঢুকে যাওয়া আপনত্ব ও ভালোবাসার অনুভূতি, অপরদিকে প্রয়োজন অভিমানের মূল্যায়ন ও নিরাপত্তাবোধ। সংগীতটি তখনই তার সবটুকু ঐশ্বর্য নিয়ে উচ্চকিত ও বিকশিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের জীবনে ব্যস্ততা আছে, অন্য নানাবিধ কারণে অজস্র মন খারাপ করা আছে, অবসাদ ও ক্লান্তি আছে। ফলে, উভয়পক্ষ সবসময় সমান মনোযোগিতায় এ খেলায় অংশ নেওয়া সম্ভব হবে না, স্বাভাবিক। এই জায়গাটায় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, এক পক্ষের সামান্য অমনোযোগিতা ও অনিচ্ছা-অবমূল্যায়নে ভিতরে অন্য এক কষ্ট তৈরি হয়। দাম্পত্যজীবনে আমাদের মধ্যে যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়, অনেক সময় এর বীজটি রোপিত হয় এখানেই। এই অন্য রকম কষ্টটি একসময় দুজনের মধ্যে সৃষ্টি করে অভিমানকে স্থূলভাবে প্রকাশ করবার প্রবণতা, অভিযোগ। এখান থেকে আসে বিরক্তি। একটা পর্যায়ে গিয়ে ভালোবাসার সেই মিছে অভিমানটিই পরিণত হয় ঘন ঘন সত্য অভিমানে, ভাষা ও বিনিময় পরিবর্তিত হয়, আসে দূরত্ব, একে অপরকে বুঝতে না পারা ও একতরফা আত্মসংকল্প: আমার অভিমানকে যে মূল্যায়ন করে না, আমি তার জন্য কাঁদব কেন?
এই উপলব্ধিটি আসার পরই আমি নিজের থেকে পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন করতে শুরু করি। এখনো সেই প্রেমময় মিছে অভিমানে আচ্ছন্ন হই; কিন্তু তা যেন বেশি না হয়, বিরক্তি উৎপাদন না করে। ফলে অভিমানের অনেক সুযোগকে সহজ হাসিতে পেরিয়ে যাই, জীবনব্যস্ততা ও বাস্তবতা বুঝার চেষ্টা করে। আর, কী সৌভাগ্য, তিনিও এমনই। কদাচ তন্তুর মতো পাতলা কাচের যে দেয়ালটি তৈরি হতে চায় সামান্য সময়ের তরে, দুজনের কোনো একজনের আচমকা আঘাতে তা ভেঙে পড়ে ঝনঝন করে।
লেখা বেশ দীর্ঘ হয়েছে, তাই অভিমানের বিষয়টি বলেই শেষ করছি আজ। অনুতাপের গল্পটি করব অন্য কোনো দিন, অন্য প্রহরে।
•
সাবের চৌধুরী
কথাসাহিত্যিক
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....