বেগম রোকেয়া, 'একটি জীবন-একটি ইতিহাস'

  • বেগম রোকেয়া, 'একটি জীবন-একটি ইতিহাস'
  • লেখকঃ আহমেদ হাসান এমরান
  • প্রকাশকালঃ মিলন উৎসব। ফেব্রুয়ারী, ২০২২
  • আলোচনায়ঃ সোনিয়া তাসনিম ( লেখক ও কলামিস্ট। ঢাকা, বাংলাদেশ)

বেগম রোকেয়া, 'একটি জীবন-একটি ইতিহাস'
-------------------------------------------------------
"কল্যাণমুখী নারী জাগরণের সম্পর্কে কোনও কিছু লিখতে হলে, স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকে বাদ দিয়ে লিখলে তা হবে নিতান্তই অসম্পূর্ণ ও খন্ডিত আলোচনা। তাই বেগম রোকেয়ার জীবনীর শিরোনাম হতে পারে, 'একটি জীবন-একটি ইতিহাস'।"


বলিষ্ঠ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মহীয়সী এই নারীকে ব্যাপক রূপে ব্যাখা করার মধ্য দিয়ে একটি শক্তিশালী সূচনার যে ঈঙ্গিত লেখক পাঠকদের প্রতি দিয়েছেন তারই ধারাবাহিকতা তিনি সগৌরবে সমুন্নত রেখেছেন গোটা পুস্তিকা জুড়ে। ২২ পৃষ্ঠায় রচিত এই বইটিতে মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার বর্ণাঢ্য জীবনকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অত্যন্ত সুচারূভাবে। ১৭৫৭ সালে ইংরেজ কতৃক বাংলার শাসন ক্ষমতা দখলের পর ১৭৯৩ সালে "চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত" ও ১৮১৮ এর "লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত" আইনের মধ্য দিয়ে বাংলার কৃষিজীবী সম্প্রদায় থেকে আরাম্ভ করে গোটা মুসলিম সমাজে এর যে হতদরিদ্র অবস্থার জন্ম হয়েছিল; যার দরুণ নিদারুণ অর্থনৈতিক সংকটের মোকাবেলার ব্যর্থতায় পযর্বসিত হয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ে মুসলিম জাতির ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ব্যবস্থা। উপরন্তু, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে মুসলিম সমাজে জ্ঞানের আহরনের যে ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছিল, সেই দৈন্য দশা ও করুণ ক্রান্তিকালকে বেগম রোকেয়ার জন্ম লগ্নের সাথে একই সাথে গ্রথিত করে নিয়ে লেখক এই দুই বিপরীত পরিস্থিতি অর্থাৎ অশিক্ষার আঁধার থেকে শিক্ষার আলোয় ধাবিত হওয়া এক জাতির ভাগ্য পরিবর্তন ইতিহাসের দুর্দান্ত নকশা তাঁর শক্তিশালী কলমে এঁকে নিয়েছেন।


ছোট্ট এই বইটিতে, নারী জাতির অগ্রদূত, বেগম রোকেয়ার গোটা জীবনীকে ছটি বর্ণিল ভাগে বাগ করে লেখক তাঁর গোটা জীবন দর্শনকে পাঠকের সম্মুখে উপস্থাপন করে নিয়েছেন অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাবে। শৈশব কাল থেকে বেগম রোকেয়ার জ্ঞানের প্রতি গভীর একাগ্রতা এবং তাঁর যুক্তিবাদীতা কী করে তাঁকে জীবনের প্রতি স্তরে উন্নীত করে নিয়েছে সেই গল্পটাই বুঝি লেখকের কলমে উঠে এসেছে বিমূর্ত ভাবে। ব্যক্তি জীবনে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জোরসে লড়ে যাওয়া এই হার না মানা নারী তাঁর গোটা জীবনেও ন্যায় নীতি, ধর্মীয় জ্ঞান ও অনুশাসনকে হাতিয়ার হিসেবে আঁকড়ে নিয়ে সমাজের কথিত কুসংস্কার ও অন্যায়ের সঙ্গে একাই লড়ে গিয়েছেন আপোষহীন লড়াই। সেই সমরে একক যোদ্ধা হিসেবে অবতীর্ণ বেগম রোকেয়া নারীমুক্তি এবং নারীশিক্ষা, নারী অধিকার এই তিনটি স্তম্ভের ভিত্তি কী করে স্থাপন করে নিয়ে তাদের পর্যায়ক্রমে বিকশিত করেছিলেন সেই বর্ণাঢ্য ইতিহাসই অকপটে সরল ভাষায়, স্বল্প পরিসরে বিন্যস্ত হয়েছে বই এর প্রতিটি পাতার মাঝে।


সত্যি বলতে কী, বইটি পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে নিজেকেই সেই শ্বাসরুদ্ধকর বেড়াজালে আবদ্ধ কোন কয়েদী মনে হচ্ছিল। খোলা হাওয়ায় স্বাধীন ভাবে শ্বাস নেবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছি একেক সময়। চোখের সামনে যেন বিমূর্ত হয়ে উঠেছে এক কালের সেই না দেখা এক খন্ড হৃদয় বিদারক ইতিহাস। একবিংশ শতাব্দীর দ্বারে বসেও শিউরে উঠেছি নারীদের প্রতি তৎকালীন সমাজের অনিয়ম আর অবিচারের বিবরণে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আত্মাহুতি দেওয়া নারীদের ডেবে যাওয়া আর্তচিৎকার যেন আঁছড়ে পড়েছে কর্ণ প্রদেশে।


বিপরীতে আবার নিজেকে আবিষ্কার করেছি অনাচারের বিরুদ্ধে এক আপোষহীন অদৃশ্য যোদ্ধা বেশে। অনাচারের বিরুদ্ধে জেগেছে ক্ষোভ। হাতের বজ্র মুষ্ঠিতে চেপে ধরতে চেয়েছি নারী স্বাধীনতা হরণকারীদের জান্তব গর্জনকে। সাথে মুগ্ধতায় ভেসেছি এই কালজয়ী নারীর সাহসিকতা আর দূরদর্শিতার অখন্ড যুক্তি খন্ডনে। ধর্ম যে কেবল নামে মাত্র পালন করার নাম নয়, ধর্মের প্রায়োগিক শিক্ষার যে প্রয়োজনীয়তা কতখানি তা সত্যি ভেবে নিতে বাধ্য হয়েছি আবারো। মস্তিষ্ক ক্ষুরধার করে তুলতে, সমাজের কালিমা নিরসনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সত্যিকারের ধর্মীয় শিক্ষা চর্চা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা অনুধাবন করে নিতে স্বচেষ্ট হয়েছি খুব করে। মহান আল্লাহপাকের দয়া, স্বীয় প্রচেষ্টা আর সৎ সাহসের সামনে আসলে কোন বাধাই দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সম্ভব নয়, এই বিশ্বাসখানার ভিত আরো বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে, বইটি পাঠ করতে গিয়ে। ধর্মীয় চেতনা, সৎসাহস আর আত্মবিশ্বাস বস্তুত যে কোন প্রতিকূলতার শেকড় গোড়া থেকে উৎপাটন করে নিতে সক্ষম, তাঁরই বাস্তব প্রমাণ সেঁটে রয়েছে এই মহীয়সী নারীর পুরো জীবনী জুড়ে।


বইটিতে বেগম রোকেয়ার বর্ণাঢ্য সংগ্রাম ও কর্মজীবনের পাশাপাশি নারী জাগরণ ও শিক্ষা প্রসারে তাঁর অনন্য অদম্য উদ্যোগ, মননশীল চিন্তাধারা, অকাট্য ধর্মীয় যুক্তি বিশ্লেষণের সাথে তুলে ধরা হয়েছে তাঁর মূল্যবান সাহিত্য কীর্তি সম্পর্কেও। যাদের মূলেও ছিল নারীর পারিবারিক ও সমাজ জীবনের দুঃখ দুর্দশার কারণ ও তার মোচনের কথা। মূলত বেগম রোকেয়া শাস্ত্রিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক উপযোগবিরহী বিশ্বাস- সংস্কারের বিরুদ্ধেই তাঁর বলা কথাগুলো তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তাই এখানে বলা হয়েছে। মূলত তাঁর সাহিত্য কর্মগুলো খুব উঁচুদরের না হলেও এগুলো ছিল মুসলিম সমাজের সংকট নিরসনের অকাট্য দলিল স্বরূপ। যার কারণে হিন্দু মুসলিম মিলিয়েও সে যুগের লেখিকাদের মধ্যে অনেকেই তাঁকে অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন।


পরিশেষে, "বেগম রোকেয়া ও আমরা" অধ্যায়টিতে বেগম রোকেয়ার স্তুতি আঁকা হয়েছে এক অনন্য মাত্রায়, বিনীত শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে। বেগম রোকেয়া কেবল মুসলিম সমাজের হয়ে নয়, নয় কেবল বাংলা কিংবা ভারতেরও, তিনি প্রথম নারী যিনি প্রথম এই উপলব্ধিতে আসতে পেরেছিলেন যে, কলম এবং লেখার মাধ্যমে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে, সমাজের প্রতি স্তরে নারী অধিকারকে সমাজের সামনে উন্মোচন করা সম্ভব। তাঁর এই প্রগতিশীল চিন্তা চেতনাতেই অনেকক্ষেত্রেই তাঁকে "নারীবাদী" মহিলা হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। বইটি জুড়ে বেগম রোকেয়ার কিছু উক্তি তুলে ধরা হয়েছে যাতে করে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজের অনিয়মের প্রতি ক্বচিৎ বিদ্রুপ ও রোষ। তবে বাড়াবাড়ি নেই কোথাও৷ প্রতিটি কথাই তাঁর উপস্থাপিত হয়েছে স্থির বিশ্বাস ও ধীর বিচার ব্যবস্থার বিচার বিশ্লেষণে, দৃষ্টান্তে ও যুক্তিপ্রয়োগে।


তাঁর এই হার না মানা নীতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে তাঁর চৌকষ চিন্তাচেতনাকে বাংলার অখন্ড সমাজের কাছে সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরবার তাগিদ লেখক বইটির শেষাংশে স্বল্পকথায় লিপিবদ্ধ করেছেন চমৎকার ভাবে। যা কিনা সকলের মানষপটে এক সুগভীর চেতনার ভিতকে নাড়া দিয়ে যাবে নিঃসন্দেহে।
"WBMDFC-KNOWLEDGE SERIES" এর মাধ্যমে পুস্তিকার মধ্য দিয়ে বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিগত দিনের কয়েকজন মনীষীর জীবন ও কর্মসাধনার বিবরণ সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্র বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে দেওয়ার এই মহৎ প্রয়াস সত্যি সাধুবাদ পাবার দাবী রাখে।


আকর্ষণীয় ঝকঝকে পেইজ, চমৎকার প্রোডাকশান এবং প্রাঞ্জল সম্পাদনা এই বইটিকে এক অনন্য অলংকারে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। বেগম রোকেয়ার স্মৃতি বিজরিত বিভিন্ন স্থানের কিছু ছবির সংযুক্তিও বইটিকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলে নিয়েছে।


সব শেষে, সরল ভাষায় চমৎকার ভাবে এই মহীয়সী নারীর জীবন গাঁথাকে পাঠকের সামনে অনিন্দ্য ভাবে উপস্থাপন করবার জন্য শ্রদ্ধেয়, শক্তিশালী লেখক আহমেদ হাসান এমরান ভাইয়ের প্রতি রইল অসংখ্য শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।


জীবনী নির্ভর, ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক বইটি শুরু থেকে শেষ অবধি পাঠক আকর্ষণ ও মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে দারুণ ভাবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ