বই মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু। দুনিয়ার সব বন্ধু হারায়ে গেলেও বই হারায়ে যাওয়ার ভয় নেই। হাজার হাজার বই আছে যা একজীবনে পড়ে শেষ করা সম্ভব না। অনেকেই বই পড়া শুরু করেন যুবক বয়সে, কেউ বা তারও পরে। আর অনেকেই থাকেন স্কুলে থাকতে শুরু করেন। তাদের জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট আছে। সেটা হলো সেই বয়সে এমন কিছু বই পড়ে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা আসে, প্রচন্ড ভালো লাগা কাজ করে যেগুলোর মজা বড় হয়ে পড়ে কখনোই অনুধাবন করা সম্ভব না। ছোটো বয়সে ফ্যান হয়ে যাওয়ায় সেই ভালো লাগা থাকে আজীবন। আবার পাঠক হয়ে যাওয়ার পিছনেও সবচেয়ে বড় অবদান থাকে এই বই গুলোর। এই বইগুলোর জন্য কাজ করে অন্যরকম আবেগ। ঠিক তেমনি বইয়ের রিভিউ নিয়ে প্রতিযোগিতা উপলক্ষে আজকের রিভিউ।
জিনার মা এবং তিন গোয়েন্দার প্রিয় কেরোলিন আন্টি ভীষণ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। জিনার বাবা বিজ্ঞানী হ্যারিসন পার্কার হাসপাতালেই থাকছেন তার স্ত্রীর সাথে। বাসার দায়িত্ব টোড নামক এক পরিবারের উপরে দিয়ে গিয়েছেন। যাদের সাথে জিনা বা তিন গোয়েন্দার কিছুতেই বনছে না। নিজেদের বাড়িতেই অনেকটা কাজের মানুষের মত থাকতে হচ্ছে। টোড পরিবারের অত্যাচারে শেষে রাগ করে সবাই জিনার দ্বীপে চলে গেলো থাকতে। কিন্তু গোয়েন্দাদের কখনো শান্তিতে পিকনিক করতে দেখেছেন? কিশোর পাশা যেখানে সেখানে রহস্য থাকবেই। কি হলো সেই দ্বীপে?
পাঠ প্রতিক্রিয়া এবং বিস্তারিত আলোচনাঃ
জিনা ঘিনা জিনা ঘিনা
জিনার মুখে ছাই
দাড় কাকে ঠুকরে দিলে
আর রক্ষা নাই!
একবার চিন্তা করুন, নিজের বাসায় জিনার মত বদমেজাজি একটা মেয়েকে এভাবে সুর করে ভেঙাচ্ছে একটা ছেলে অথচ জিনাকে চুপচাপ সহ্য করতে হচ্ছে কতটা অসহায় অবস্থা হলে?
আমার জীবনে পড়া প্রথম তিন গোয়েন্দা জিনার সেই দ্বীপ। রোজার মাসে ক্ষুধা পেটে বইটা নিয়ে বসেছিলাম। বইটা শুরু করার পর ক্ষুধা কি দিন দুনিয়া কি সব ভুলে গিয়েছিলাম। এত বেশী ভালো লেগেছিলো আসলে এই ভালো লাগা কিভাবে প্রকাশ করবো বা কিভাবে লিখবো এটাও সমস্যা হয়ে যাচ্ছে।
বইয়ের আলোচনায় যাওয়ার আগে তিন গোয়েন্দার একটু পরিচয় দেয়া দরকার।
"হ্যালো, কিশোর বন্ধুরা আমি কিশোর পাশা বলছি, আমেরিকার রকি বীচ থেকে। জায়গাটা লস অ্যাঞ্জেলেসে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে, হলিউড থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। যারা এখনও আমাদের পরিচয় জান না, তাদের বলছি, আমরা তিন বন্ধু একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছি, নাম তিন গোয়েন্দা। আমি বাঙালী। থাকি চাচা-চাচীর কাছে। দুই বন্ধুর একজনের নাম মুসা আমান, ব্যায়ামবীর, আমেরিকান নিগ্রো; অন্যজন আইরিশ আমেরিকান, রবিন মিলফোর্ড, বইয়ের পোকা। একই ক্লাসে পড়ি আমরা। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে লোহা-লক্কড়ের জঞ্জালের নিচে পুরানো এক মোবাইল হোম-এ আমাদের হেডকোয়ার্টার।"
তিন গোয়েন্দার প্রথম বইয়ের নাম হচ্ছে তিন গোয়েন্দা। একটি প্রতিযোগিতায় ৩০ দিনের জন্য রোলস রয়েস জিতে তিন গোয়েন্দা নামে একটি গোয়েন্দা সংস্থা খুলে ফেলে কিশোর পাশা। যার প্রধান সে নিজেই, সহকারী মুসা আমান আর নথি গবেষক রবিন মিলফোর্ড। নিজের অসামান্য অভিনয় প্রতিভা দিয়ে বিখ্যাত পরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফারকে বোকা বানিয়ে হরর মুভি বানানোর জন্য ভৌতিক বাড়ি খুঁজে দেয়ার দায়িত্ব নেয়। সেই যে টেরর ক্যাসলের রহস্যের সমাধান করে, তারপর শুধু একের পর এক দূর্দান্ত সব রহস্যের সমাধান করে গেছে। জিনার সাথে তিন গোয়েন্দার প্রথম পরিচয় প্রেতসাধনা বইতে৷ কিন্তু খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় সাগরসৈকত বইতে। তারপর স্কুলের বিভিন্ন ছুটিতে একসাথে অনেক রহস্যের সমাধান করেছে।
ফেরত আসি জিনার সেই দ্বীপে। তিন গোয়েন্দা এসেছে জিনাদের বাড়িতে। কিন্তু কেরোলিন আন্টি অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। বাসার দায়িত্ব বিচিত্র এন পরিবারের উপরে। টোড ফ্যামিলি। বাংলায় যাকে বলে ব্যাঙ। তাদের ছেলের নাম আবার টেরি। টেরি নামের ছেলেদের মনে হয় সমস্যাই আছে। তা না হলে এই ব্যাটা শুটকি টেরির এক কাঠি বাড়া কেন হবে?
বইটা এক কথায় অসাধারণ। আমার পড়া সবচেয়ে প্রিয় তিন গোয়েন্দার লিস্টে একদম উপরের দিকে থাকবে। বইটাতে একই সাথে পরিবার, বন্ধুত্ব, রাগ, জেদ, কমেডি, রহস্য খুবই সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। বদমেজাজি জিনার যে অসাধারণ সহ্য ক্ষমতা, সেটাও কিন্তু এই বইয়েই দেখা যায়। মা হলো পরিবারের প্রাণ। সেই মা অসুস্থ হলে সন্তান অনেক কিছুই সহ্য করতে পারে। গল্পের শুরুটা হয় মন খারাপ দিয়ে। কিন্তু এই মন খারাপের ভীতরেও রকিব হাসান এত চমৎকার ভাবে কমেডি ঢুকিয়েছেন হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যাবে। বইয়ের প্রতিটি চরিত্র একেকরকম ভাবে অসাধারণ। কারো উপরে রাগ হবে তো কারো উপরে হাসি আসবে।
জিনার সেই দ্বীপ বইটায় আমার সবচেয়ে পছন্দ হলো এর গল্প বলার ধরণ। কোনো অতিরিক্ত জটিল কিছু করার চেষ্টা নেই, একেবারেই সহজবোধ্য। বইটার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুশ্চিন্তা, রাগ, অসহায় অবস্থা, এডভেঞ্চার, রহস্যের সমাধানের পাশাপাশি হাসাহাসি চলতেই থাকবে। কিছু কিছু বর্ণনা এত অসাধারণ আপনার মনে হবে আপনি নিজেও বোধহয় তিন গোয়েন্দা জিনা রাফিয়ানের সাথে আছেন। জিনার সেই দ্বীপের রহস্য খুব একটা জটিল নয়, কিন্তু এর এডভেঞ্চার আর কমেডি অংশটা খুবই সুন্দর।
সেবা প্রকাশনীর বইগুলোর লেখনী নিয়ে কখনোই সন্দেহ থাকার কথা না কিন্তু এই বইটা একটু বেশী ভালো। এত চমৎকার ভাবে প্রত্যেকটা দৃশ্যপট ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক, যে এক বই দিয়ে তিনি আমাকে তার আজীবনের ফ্যান বানিয়ে নিয়েছেন। অতিরিক্ত কোনো বর্ণনা নেই, যেখানে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই রয়েছে গল্পের উপাদান। কাহিনী খুবই দ্রুত এগিয়েছে। বইটা শুরু করার পর রাখার মত অপশন লেখক রাখেননি এই বইয়ের ক্ষেত্রে। একেকটা বইয়ের প্রাণ বইটার উপস্থাপনা, এর সংলাপ, গল্প বলার ধরণ। রকিবদা এইক্ষেত্রে নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। ছোট একটা গল্পকে কিভাবে সুন্দর করে উপস্থাপন করে সবার মনে জায়গা করে নেয়া যায় সেটা রকিবদা খুব ভালো মত জানেন। এইসব বই নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে যেয়ে আসলে শব্দভাণ্ডার ফুরিয়ে যায় কিন্তু মনের ভাব সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয় না। তারপরেও বলি, রকিবদা, আপনি অসাধারণ!
চরিত্রায়নঃ
তিন গোয়েন্দার বইতে স্বভাবতই তিন গোয়েন্দা মূল চরিত্র থাকবে। জিনা আর রাফিয়ান যেখানে থাকবে সেখানে তারাও মূল চরিত্রই হিসেবেই থাকে। সাথে থাকে আমাদের ফেভারিট কেরোলিন আন্টি, বদমেজাজি পার্কার আংকেল। এই বইয়ে যে জিনা প্রচন্ড বদমেজাজি, সেই জিনার সহ্য করার ক্ষমতা যেমন দেখেছি ঠিক তেমনি দেখেছি শান্তশিষ্ট কিশোর পাশার রেগে যাওয়া। ভুতের ভয়ে কাবু কথায় কথায় খাইছে বলা মুসা আমান বন্ধুদের বিপদে কিন্তু সবার আগে। রেগে যেয়ে সে কিন্তু কবিতাও লিখেছে দুই লাইনের,
"ব্যাঙাচি করে ঘ্যানর-ঘ্যান
চাইরডা পয়সা ভিক্ষা দ্যান!"
রবিন আছে সবার সাথে, সবকিছুতে। কিন্তু এই বইয়ে উপরোক্ত চরিত্রগুলোর সাথে পাল্লা দিয়েছে টোড ফ্যামিলি। টোড ফ্যামিলির কথা উঠেছে অথচ আপনি হাসেননি বা রাগেননি এমন জায়গা কমই আছে৷ নেগেটিভ রোল হিসেবে বইয়ে তাদের ইমপ্যাক্ট বেশ ভালোমত ছিলো। টেরির মায়ের আচলের তলায় থেকে কাপুরুষের মত জিনাকে উদ্দেশ্য করে কবিতা বলা, মিসেস টোডের বদমেজাজ, জিনা রাফিয়ানকে ক্ষতি করার চেষ্টা, তাকাও এদিকে থুড়ি মিঃ টোড গল্পকে দিয়েছে অন্যমাত্রা। ছোট্ট ডরোথি ছিলো আরেকটা সুন্দর চরিত্র। বাচ্চা হিসেবে যে সাহস দেখিয়েছে, টেরির উচিৎ দিনে তিনবেলা এই বাচ্চার পা ধোয়া পানি খাওয়া। জিনার সেই দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ এর রহস্য রোমাঞ্চ নয়, এর চরিত্রগুলো।
বানান,সম্পাদনা, প্রচ্ছদ এবং অন্যান্যঃ
বাংলাদেশে যত প্রকাশনীই থাকুক বানান এবং সম্পাদনার দিক থেকে তাদের সমকক্ষ তো দূরের কথা, খুব কাছেও নেই এখনো কোনো প্রকাশনী। সেবার বইয়ে বানান ভুল খুঁজে পাওয়া আর অমাবস্যার চাঁদ দেখা প্রায় কাছাকাছি ব্যাপার। ছোটোবেলায় যদিও বানান নিয়ে এত মাথাব্যথা ছিলো না কিন্তু সেবার বইয়ের কথা উঠলে এই কথাটা প্রশংসার সাথেই বের হয়। রকিবদা নিঃসন্দেহে সেরা একজন লেখক তার সাথে সেবা প্রকাশনীর চমৎকার সম্পাদনা বইটিকে করেছে আরো অসাধারণ। একটা বই আপনাকে কতটুকু আকর্ষণ করে ধরে রাখতে পারবে এর পিছনে সম্পাদনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেবার বইয়ের যিনিই সম্পাদক থাকেন উনি নিশ্চিত করেন পাঠক যেন চমৎকার ঝরঝরে এক বসায় পড়ার মত আগ্রহ পায় বই পড়তে। জিনার সেই দ্বীপের প্রচ্ছদ বইয়ের নাম এবং গল্পের সাথে খাপ খেয়ে গেছে। বেশ চমৎকার প্রচ্ছদ। অভিযোগ করার কোনো জায়গা নেই।
নিউজপ্রিন্ট পেপারব্যাক বই হিসেবে বইয়ের গঠন বা অন্যান্য বাহ্যিক ব্যাপারগুলো ও চমৎকার। কম টাকায় একের ভেতরে এতকিছু থাকায় সেবা প্রকাশনী যে অনেক পাঠক তৈরীতে দেশে প্রথমদিকেই থাকবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
জিনার সেই দ্বীপ পড়ার আগেও আমি বই পড়তাম। কিন্তু আমাকে পুরোদমে পাঠক বানিয়েছে জিনার সেই দ্বীপ। এরপরে তিন গোয়েন্দা সব পড়ে ফেলেছিলাম। আমার কৈশোরের সবচেয়ে অসাধারণ সময় কেটেছে তিন গোয়েন্দার হাত ধরে। এই জন্য এই বইটার প্রতি আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। একসময় কিশোর ছিলাম, এখন যুবক, বেঁচে থাকলে প্রৌঢ়, বৃদ্ধ হবো। জগতের অনেক রকম বই পড়া হয়েছে হচ্ছে হবে। বই পড়ার কোনো শেষ নেই। প্রত্যেকদিনই অন্তত শ খানেক পেজ পড়ার চেষ্টা করি না পড়া বইয়ের। কিন্তু এর মাঝেও তিন গোয়েন্দার সেই পুরনো পড়া বইগুলিও নতুন করে পড়ি এবং আশ্চর্যের ব্যাপার প্রত্যেকবারই আগের মতই মজা পাই! যতদিন বেঁচে থাকবো নতুন বইয়ের পাশাপাশি এই পুরনো তিন গোয়েন্দাও চলবে আমার সাথেই। হয়ত দেখা যাবে নাতি নাতনিসহ সবাই পাশাপাশি বসে একই তিন গোয়েন্দা পড়ছি আর হাসাহাসি করছি ফগর্যাম্পারকটের সাথে ঝামেলা করে!
যাদের কিশোর বয়সী সন্তান আছে, তাদের হাতে এই বইটা তুলে দিন। দেখবেন আপনার সন্তান বই পড়ুয়া হয়ে যাবে। এই বই সকল কিশোর বয়সীদের জন্য রেকমেন্ডেশন থাকলো।
credit ; অন্বয় আকিব
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....