গোপনে কত ক্ষুদ্র বিষয় যে মানুষকে অস্থির করে, এই ব্যাপারটা মাঝে মাঝে ভাবি। যে মানুষটা বৈশ্বিক সংকট নিয়ে মাত্রই সারগর্ভ আলোচনা করছে, ঠিক একই সময়ে সে তারকাঁটায় লেগে সামান্য ছিঁড়ে যাওয়া জামাটি নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও বিষণ্ণ হচ্ছে। গুরুত্বের বিচারে বাহ্যত এ দুয়ের মধ্যে একটা বৈপরীত্য আছে। মানুষ নামক চিন্তাশীল সবাক প্রাণীটির বিশেষ একটি দিক এই যে, সে এমন বৈপরীত্য ও বৈচিত্র্যকে একই সঙ্গে সমান আগ্রহে ধারণ করতে পারে। এটা আমি নিজের ভিতরে যেমন টের পাই, অন্যদের মধ্যেও অবলোকন করি; এবং অবলোকন করে একধরনের মজাও অনুভব করি, কিছুটা আবিষ্কারের আনন্দের মতো।
এটা কি আমাদের ক্ষুদ্রতা? বা এই বিষয়গুলো আমাদের জীবনে কী আঙ্গিকে উপস্থিত থাকা উচিত, সেসব নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছি না; প্রসঙ্গটার অবতারণা করেছি মূলত আমি যেন আমার ক্ষুদ্র একটি বিষয়ের সূচনাটি করতে পারি। ক্ষুদ্র সে বিষয়টি হলো হাঁটা। মূল জায়গা থেকে হাঁটা বা হণ্টন বিষয়টা ক্ষুদ্র না আসলে। কিন্তু আমার মধ্যে এটি যে আঙ্গিকের সমস্যা আকারে হাজির হয়েছিল, সে আঙ্গিকটা ছিল ক্ষুদ্র।
জীবনের দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত আমি হাঁটার ধরন, বিন্যাস ও গতি নিয়ে হীনম্মন্যতার শিকার ছিলাম। বিব্রত ও বিষাদগ্রস্ত হয়েছিলাম। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না আমার কীভাবে হাঁটা উচিত। বিশেষ করে সে সময়টিতে, যখন আমি মানুষের দৃষ্টির সামনে থাকি। খুব সম্ভব ভিতরের এই অপূর্ণতাই আমার ভিতরে মানুষের হাঁটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের একটা অভ্যাস সৃষ্টি করে দিয়েছিল। অবশ্য ব্যাপারটি এমন ছিল না যে, অন্য কাজ থামিয়ে আমি মানুষের চলার পথে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতাম। এটা বরং ঘটত অনেকটা অলক্ষ্যেই, অবচেতনে। পথে চলাচলের সময় বা কোথাও বসে থাকলে মাঝে মাঝে—আমি চলন্ত মানুষের দিকে তাকিয়ে থেকে তার চলার ধরন ও ছন্দটা বুঝার চেষ্টা করতাম। এটা করতে গিয়ে আমি অত্যন্ত বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। মানুষের চেহারা যেমন এক নয়, তেমন প্রত্যেকের হাঁটার মধ্যেও রয়েছে বিশেষ একটি নিজস্বতা। এর মধ্যে কারোটা ভালো লাগে, কারোটা দেখলে মনে হয় হণ্টন বিষয়টি নিয়ে সে মনোযোগী নয়। খাপছাড়া, ঢংহীন এবং সৌন্দর্যবিবর্জিত। আমার মনে আছে খুব ছোটবেলায়, বয়স তখন পাঁচ কি ছয়, তখন হাঁটার ক্ষেত্রে অদ্ভুত একটি ভঙ্গি রপ্ত করেছিলাম। হাঁটতাম পা বাঁকা করে, ছোট ছোট পদক্ষেপে, দ্রুত গতিতে। খুবই দৃষ্টিকটু ভঙ্গি এটা। বড় ভাইয়া একদিন আমাকে ধরলেন, বুঝালেন এবং হাত ধরে ধরে দীর্ঘক্ষণ অনুশীলন করালেন। কয়েক দিনের ভিতরে আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। এরপর যত বড় হয়েছি, সবসময় চেষ্টা করেছি হাঁটার ক্ষেত্রে সুন্দর একটি বিন্যাসে যেন আমি অভ্যস্ত হতে পারি। কয়েক বছর আগে ভিতরে একটা ত্বরাপ্রবণতা শুরু হলো। ব্যাপারটা এমন যে, জীবন তো ফুরিয়ে যাচ্ছে। অনেক কাজ, সময় খুব কম, সব কিছু খুব দ্রুত করতে হবে।
সেই ত্বরাপ্রবণতা প্রভাবিত করল আমার হাঁটাকেও। তখন পা ফেলি সোজা করেই, দেহকে ঋজু রেখে, কিন্তু অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে। আমার এক সহপাঠী একদিন বললেন, আপনি এত দ্রুত হাঁটেন, দেখতে কেমন যেন লাগে! তার ছোট্ট এই মন্তব্যটি আমার হাঁটার মধ্যে স্থায়ীভাবে একটি সুন্দর ধীরতা এনে দিলো। ফলে, জীবন নিয়ে সেই ত্বরাপ্রবণতাটা এখনো বিদ্যমান থাকলেও বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া আমি অত্যধিক জোরে হাঁটি না।
একটু করে যখন বড় হতে শুরু করলাম, ধীরে টের পেলাম হণ্টন বিষয়টি অত ছোটও নয় আসলে। আমাদের জীবনে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে, ইতিহাস ও মনস্তত্ত্বে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত একটি বিষয়। কুরআনুল কারিমে হাঁটা বিষয়ে বেশ কিছু মৌলিক নির্দেশনা আছে। হাদিসে একে আলোচনা করা হয়েছে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে। সুন্দরভাবে হাঁটা নিয়ে বৈশ্বিকভাবে আছে নানা গবেষণা, আলোচনা ও বইপত্র। বর্তমান প্রচলিত বিশ্ব সংস্কৃতিতে ক্যাটওয়াক, র্যাম্প নিয়ে আছে সাড়ম্বর আয়োজন। হাঁটার ধরন থেকে একজন মানুষের চরিত্র ও মানসিক অবস্থার বিশ্লেষণ আছে মনস্তত্ত্ব বিদ্যায়। বিনোদন জগতের নায়ক-নায়িকাদের হাঁটা বিপুলভাবে প্রভাবিত করছে সমাজের তরুণ প্রজন্মকে। হাঁটার আছে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে নানা সঙ্গতি ও অসঙ্গতি। ফলে, হাঁটা বা হণ্টন ব্যাপারটা বিষয় হিসেবে আমাদের জীবনে বলা যায় বেশ বড় আকারেই উপস্থিত।
বড় ভাইয়ার সাথে আমার বিভিন্ন গল্পসল্প নানান সময়েই হয়ে থাকে। দুয়েক বছর আগে কথাপ্রসঙ্গে তিনি হাঁটা ও বসা বিষয়ে বেশ লম্বা কথা বললেন। শুরুতে একটা গল্পও বলেছিলেন। অল্প শব্দে বললে গল্পটা ছিল এমন—বড় এক কোম্পানিতে একজনকে চিফ হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সকল প্রাকপ্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর শুধু এ কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে যে, তার হাঁটাটা নেতাসুলভ নয়। এই লোক পরে ব্যক্তিগত জেদ থেকে বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করেন এবং হাঁটা বিষয়ক তার দীর্ঘ অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে একসময় তিনি বিভিন্ন জায়গায় লেকচার দিতে শুরু করেন। শিরোনাম ছিল—হাউ টু ওয়াক এ লিডার?
এ প্রশ্নটা অবচেতনে আমার ভিতরে আগে থেকেই ছিল; কিন্তু ভাইয়ার গল্পের এই একটি সরল বাক্য সেই প্রশ্নটাকে নতুন করে স্পষ্ট করে তুলেছিল। একজন নেতার কীভাবে হাঁটা উচিত আসলে? আমি পরে যেটা বুঝেছি: হাঁটার ক্ষেত্রে নেতা ও সাধারণের মাঝে মৌলিকভাবে কোনো তফাত নেই। সবার জন্য দরকার যেটা, তা হলো সঙ্গতি ও সৌন্দর্য।
কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা বলছেন: তুমি হাঁটার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থি হও, অন্য এক আয়াতে অহংকার ও দম্ভভরে হাঁটতে নিষেধ করে বলেছেন: তুমি জমিনে দম্ভভরে হাঁটবে না। তুমি তো জমিন ফাটিয়ে ফেলতে পারবে না, পাহাড়ের মতো উচ্চও হতে পারবে না। কিন্তু একই বিষয় জি*হা-দের ময়দানে বৈধ। মাগাযির বেশকিছু হাদিসে দেখা যায়, যু-দ্ধের ময়দানে শ-ত্রুসারির সম্মুখে বীর সাহাবিরা দাম্ভিকতা প্রদর্শনের ভঙ্গিতে হেঁটেছেন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বারণ করেননি। তিনি বলেছেন, যু-দ্ধের ময়দান ছাড়া এই রকম দম্ভ প্রদর্শন বৈধ নয়।
হাঁটার ক্ষেত্রে অহংকার প্রকাশ হওয়া না হওয়া একটা বড় ব্যাপার। এই জায়গা থেকে আমি ভাবি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাঁটাটি নিয়ে। তিনি একই সময়ে বিনয়ের সঙ্গে আবার বীরপুরুষের ভঙ্গিতে হাঁটতেন। খুব সূক্ষ্ম এবং জটিল সমন্বয় এটা। তিনি হাঁটতেন, যেন উপর থেকে নিচে নামছেন, তাঁর হাঁটায় ছিল সাবলীলতা এবং গতিময়তা। ইসলামের আরেকটি মৌলিক নির্দেশনা হলো হাঁটার সময় নজরকে অবনত রাখা। যেন পর নর বা নারীর প্রতি, অশ্লীল দৃশ্য বা গুনাহের প্রতি দৃষ্টি না যায়, যেন হাঁটতে গিয়ে চর্চা না হয় অনধিকারের। এমন আরও কিছু মৌলিক নির্দেশনা মান্য করার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে আমি হাঁটব কীভাবে? কীভাবে হাঁটলে তা আরও সুন্দর ও সঙ্গতিপূর্ণ হবে? এ জায়গাটা আসলে উন্মুক্ত। আমরা সচেতনতার সাথে আমাদের জীবনাভিজ্ঞতা থেকে সে সৌন্দর্যকে তালাশ করতে পারি।
মানুষের নানাবিধ হাঁটা পর্যবেক্ষণ করে কিছু দৃষ্টিকটু বিষয় আমি পেয়েছি। যেমন, কেউ আছেন খুব ছোট ছোট পা ফেলেন, কেউ অত্যধিক দ্রুত হাঁটেন, কেউ আবার খুব বেশি ধীর। অনেকে হাঁটার সময় উপরে ও আশপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে চলেন। দু হাতের নড়ার মধ্যেও আছে শিল্প ও সৌন্দর্য। এমন অনেককে দেখেছি, হাত দুটো আড়াআড়িভাবে আন্দোলিত করেন, শূন্যে থাপ্পড় দিয়ে, পুরো শরীরে একধরনের খলবলে ছন্দ তৈরি করে, ঘাড় বাঁকা করে, কুঁজো হয়ে, হেলেদুলে আরও কত বিচিত্র ভঙ্গিতে যে হাঁটে মানুষ। এ কি মানুষের দোষ তালাশ হলো? আমার এমন মনে হয় না। এ আসলে আমার অলক্ষ্য অভিজ্ঞতার বিবরণ শুধু।
আমি এখন যেভাবে হাঁটতে চাই: ঋজু হয়ে, ঘাড় ও মাথা সোজা রেখে, মধ্যম পরিমাণে পা ফেলে, দু হাত পরিমিত নাড়িয়ে এবং মধ্যম গতিতে, যাকে ধীর বলা যায় না। গতিশীলই; কিন্তু পরিমিত। চোখ দুটো একদম কাছে নয়। স্বাভাবিক দূরত্বে। দুই কাঁধ সামান্য একটু আন্দোলিত হবে এবং পা দুটো পূর্ণ রূপে মাটি থেকে উঠে আসবে। পদক্ষেপের সূচনাটি হবে গোড়ালি থেকে, যা ক্রমশ বিস্তারিত হবে পুরো পায়ের পাতায়। এবং হাঁটার সময় শরীরের পুরো অভিব্যক্তির মধ্যে একটি স্বাচ্ছন্দ্য, স্বতঃস্ফূর্ততা, উন্মুক্ততা, জড়হীনতা এবং আনন্দের আভাস থাকবে।
কারো মনে হতে পারে, হাঁটা মানুষের জীবনের শুরু থেকেই অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত একটি বিষয়। একে এত সব নিয়মের নিগড়ে বেঁধে ফেললে তো সে স্বাচ্ছন্দ্য থাকবে না। তা হবে আরোপিত এবং মেকিপূর্ণ। এটা আমাদের হাঁটার স্বাভাবিক আনন্দকে ব্যাহত করবে৷
কিন্তু আমি যেটা দেখেছি, এখানে অভ্যাস ও অনুশীলন সব সমস্যাকে মিটিয়ে দেয়। সচেতন মনোযোগিতা ও অনুশীলনের ভিতর দিয়ে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেলে সেখানে নতুন করে স্বাচ্ছন্দ্য তৈরি হয়। আমি মূলত সেই চেষ্টাটিই করি এবং আমি দেখেছি ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট না হয়ে সেখানে বরং নতুন একটি অনাবিল আনন্দের সৃষ্টি হচ্ছে।
গঠনগত এই বিষয়গুলোর বাইরে হাঁটার সাথে আমার অন্য আরেকটি সম্পর্ক আছে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে হাঁটা বিষয়টি আমাকে সবসময় অসম্ভব সঙ্গ ও সহযোগিতা দিয়েছে। আমি বিষাদগ্রস্ত হলে আনমনে হাঁটি, লেখার ভাবনাকে সুগঠিত ও বিন্যস্ত করার জন্য হাঁটি, হৃদয়ের গহিন অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা শব্দ ও বাক্যকে খুঁজে বের করবার জন্য হাঁটি, হাঁটি কোনো সমস্যা নিয়ে ভাবতে হলে, আমার চারপাশের জগত ও জীবনকে গভীরভাবে তাকিয়ে দেখার লোভে। পৃথিবীর অসংখ্য ধুলোমলিন পথে আমি আমার পদচিহ্ন ফেলে এসেছি, অজস্র বিকেল ও দুপুরে, রাতের অন্ধকারে। ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতো একা আনমনে হাঁটতে থাকার মধ্যে যে বিমল আনন্দ ও ভালোলাগার সন্ধান আমি পেয়েছি, এতে আমি সবসময় নিজেই অভিভূত।
আমি চাই আমার সন্তান ও ছাত্রগণ সুগঠিতভাবে, স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে এবং মার্জিতভাবে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ভঙ্গিতে হাঁটুক। আমার বন্ধুগণ হাঁটুক এমনভাবে, যেন মানুষ এর দিকে তাকিয়ে থাকার আনন্দ পায়।
•
সাবের চৌধুরী
আলেম, সাহিত্যিক
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....