বয়স যখন বারো থেকে কুড়ি !

সদ্য জন্ম নেয়া শিশুদের আমরা প্রচন্ড যত্ন করি... কখন হাচি দিলো, কতবার হিসু করলো, ২ ঘন্টা পর পর খাওয়ানো - আরো কত্ত কি...



প্রতিটা কাজ করি পরম যত্নে... প্রতিটা কাজের জন্য জবাবদিহি ও করতে হয় অন্যদের কাছে মা বাবাকে... এমনকি মা বাবার একে অপরের কাছেও... একটু উনিশ বিষ হলে ঘর মাথায় উঠে, নিজেদের মন ও প্রচন্ড অপরাধী ফিল হয়!!
কিন্তু এই বাচ্চাটা যখন ক্রমশ বড় হতে শুরু করে এই কেয়ার, জবাবদিহিতা, অপরাধবোধ অনেক ফ্যামিলিরই কর্পূর হয়ে উড়ে যায় ট্রাস্ট মি... একটা ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে দিয়ে শুধু পড়াশোনার খবর নেই... আর বাচ্চা যদি টিন এইজ হয় কথাই নেই বাপ মায়ের চিন্তাই শেষ সব কাজ তো নিজেই পারে, এখন বাপু তোমার শান্তি আর শান্তি- এটাই আমাদের সামাজিক ভাষ্য!
কিন্তু চিন্তার শুরু তো এখান থেকেই.....
১২-২০ বছরের বাচ্চার চিন্তাই বেশি... এখন বলবেন ২০ কি বাচ্চা নাকি?
আমার মনে হয় ২০ খুব বড় বয়স না এ যুগে। কারন ১৯-২০ এই সাধারণত বাচ্চারা কলেজ ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষে যায়... এই বয়সগুলোতেই সে দুনিয়াতে চোখ খুলে প্রকৃত অর্থে.... পরিবারের গন্ডির বাহিরে বের হয়। ১২-২০ একটা এডভেঞ্চারাস বয়স। শরীরে পরিবর্তন আসে, মনে পরিবর্তন আসে। বাচ্চা থেকে বড় হয়েছে ভাবটা আসে।
এই সময়ের কিছু করনীয় দিক নিয়ে আসুন আলোচনা করিঃ
১/ আদবঃ
আচরণগত প্রচুর নতুন বিষয় দেখা যায়। এগুলোকে আমি এখনি সমস্যা বলবো না। কারন বয়স আর পরিবেশের সাথে আচরন পরিবর্তন হবেই। তাই খুব কেয়ারফুলি হ্যান্ডেল করতে হবে। যেমনঃ অনেকের কমপ্লেইন যে বেয়াদব হয়ে গিয়েছে, অনেকে বলে কথা শুনে না, অনেকে বলে বাচ্চা বেশি কথা বলে না, কারো সাথে মিশে না, শুধু ফ্রেন্ডস দের সাথেই মিশে৷ আত্মীয়দের লাইক করে না। এই সমস্যা গুলো খুব কেয়ারফুলি হ্যান্ডেল করতে হবে। আদর বা মারামারি কোনোটাই সমাধান নয়। বাচ্চা আপনার কথায় ভুলবে না, তাকে এ্যাকশন দিয়ে ভুলাতে হবে। মা বাবার মধ্যে আদবের চর্চা থাকতে হবে। আপনি যদি সারাদিন আত্মীয়দের গীবত গান, কিংবা বলে ওরা তোর বাপের টাকা খেয়ে ফেলে তাহলে বাচ্চা স্বাভাবিক সেই আত্মীয়দের এ্যাভোয়েড করবে। তাই কথা বলতে হবে সাবধানে। আপনার বাচ্চা যদি দেখে আপনিই হিংস্র, বেয়াদব তাহলে বাচ্চাও তেমন হবে। আপনার আচরন হতে হবে বিনয়ী, নম্র এবং আল্লহভীরু। আর বাচ্চার আরো পরিবর্তন এর জন্য আপনাকে তার পিছনে মেহনত করতে হবে ছেলে বাচ্চাকে মসজিদে নিয়ে যাবেন বাবা, তালিমে বসবেন। মেয়ে বাচ্চাকে মায়েরা তালিমে নিয়ে যাবেন। নিজেরা বাসায় সব সময় দ্বীনি আলাপ করবেন, তালিম করবেন, ঘুরতে যাবেন, অন্যদের প্রসংশা করবেন, বাচ্চাকে এপ্রেশিয়েট করবেন ভালো কাজে ইন শা আল্লহ। আর আপনার বাচ্চা কোচিং এ যেতে পারে তালিম বা মসজিদে নয় এসব কথা বলে নিজেকেই নিজে প্রতারিত করবেন না।
২/ আমলঃ
আওয়াল ওয়াক্তে নামাজ পড়তে অভ্যস্ত করা ছোট থেকেই। মাসনুন আমল গুলো করানো নিজে সাথে নিয়ে। জান্নাতের গল্প করা, জাহান্নামের ভয় দেখানো। পড়াশুনার আগে আমল। এটা নিজেও মাথায় রাখবেন আর সন্তানের ও অন্তরে গেথে দিবেন। যেমন একটা জুতার ফিতা হারিয়ে গেলেও যেনো আপনার কাছে খোঁজার আগে আল্লহ এর কাছে চায়। আর এসবের রোল মডেল আপনাকেই হতে হবে। প্রতিদিন কোরআন পড়বে তেলাওয়াত এবং অর্থসহ হোক আধা পাতাই। রুটিন থাকবে, সময় নির্ধারিত থাকবে সব কাজের। পরীক্ষা তাই আমল করবে না, রোজা রাখবে না এমন চিন্তা যদি তাহলে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছেন মনে রাখবেন। আল্লহ এর অবাধ্যতা ভালো কিছু বয়ে আনে না।
৩/ হায়াঃ
বাচ্চাকে হায়া কি তা জানান। হায়া শিখান। একটা ছোট্র গল্প বলি, এক নিকটাত্মীয় এর বিয়ের পর তার নতুন স্পাউজের আগের আপত্তিকর ছবি অনেক আত্মীয়ের মেসেঞ্জারে আসতে শুরু করলো ফেইক আইডি দিয়ে। আপত্তিকর বলতে নুড কিছু নয়, কাপল ছবি। কিন্তু ইন লসের কাছে আসাটা তো আপত্তিকরই। বিব্রতকর আর জীবন বিধ্বংসীই। এখন ভাবুন ছেলে মেয়েকে বেহায়া বানাবেন নাকি বাহায়া...
তাই ছেলে মেয়েকে হায়া শিখান। ইজ্জতের চেয়ে দামী কিছুই নয়। নন মাহরামদের সাথে মেলামেশা কত বড় গুনাহ এবং ভবিষ্যতে তার জন্য কতটা ভয়ংকর হতে পারে বুঝান।
এই হাতেখড়ি আজই শুরু করুন। কাজিন কখনোই ভাই বা বোন নয়৷ কয়েকজন কাজিন এক জায়গা হলেই ঘুমাতে দিয়ে দেন এসব বন্ধ করুন বয়স যতই হোক। ছেলে মেয়েই না, এমনকি আখলাকে ১৯-২০ মনে হলে, বাসা বা স্কুলের পরিবেশ ভিন্ন হলে এক লিংগ হলেও সন্তানকে নিজের উপস্থিতি ছাড়া মিশতে দিবেন না৷
তবে সন্তানের হায়া তৈরীর জন্য নিজের হায়া তৈরী করুন। মা দেবর ভাসুর দুলাভাই এর সাথে কথা বললে আর বাপ যদি শালার বউ কিংবা শালী আর ভাবিদের সাথে মশকরা করে তাহলে বাচ্চার হায়া ভুলে যান প্লিজ।
তার উপর যদি ছেলে মেয়ে নিয়ে টিভিতে বিনদাস নাটক সিনেমা দেখার অভ্যাস থাকে তাহলে হায়া শব্দই ভুলে যান।
৪/ ডিভাইসঃ
ডিভাইস এখন একটা বড় সমস্যা সবাই বলে। অবশ্যই। তবে এখন না, ১৫-২০ বছর আগে থেকেই ডিভাইস বড় সমস্যা....
আবার একটা গল্প বলি। ১৫-১৬ বছর আগের গল্প। আমি তখন স্কুলে পড়ি। একদিন দেখলাম ফ্রেন্ডসরা বলতেছে আজকে অমুক ফ্রেন্ডের বাসায় যাবো। কিন্তু তারা যাবে আমাকে জানায়নি এমনকি যেতেও বলছে না। কিছুক্ষন পর সরল মনেই বললাম আমাকে কেনো নিবা না। বলতেছে আমরা বিশেষ কাজে যাবো তোকে নিবো না, তুই বোকা। কিছুক্ষন কথা বলার পর বুঝলাম তারা সেই ফ্রেন্ডের বাসায় পর্ন দেখতে যাচ্ছে। ওই বাসায় কেনো? কারন আন্টি জব করে বাসায় থাকে না। অথচ আন্টি পর্দা করেন আর তার মেয়েদের খুবই ভদ্র মনে করেন। কারন ওরা পড়াশুনাতেও খুবই ভালো। কিন্তু এখন প্রশ্ন এই পর্ন ভিডিও পেলো কোথায়?
এই সিডি বা ডিভিডি পেয়েছে আরেক ফ্রেন্ডের বয় ফ্রেন্ডের কাছ থাকে।
আমার এই গল্পটা বলার উদ্দেশ্য সচেতনতা, গভীরতা বুঝানো।
তাহলে বুঝেন এখন তো বাচ্চাদের টেবিলে টেবিলে ল্যাপটপ, হাতে মোবাইল, ট্যাবলেট....
তাই আপনাকে কয়েক কাঠি সরস হতে হবে...
ডিভাইস না দেয়ার চেষ্টা করুন সর্বাত্মক। পার্সোনাল ডিভাইস দিবেন না। দিলে ঐযে বললাম সরস হতে হবে। ওয়াইফাই দিয়ে সাইটগুলো রেস্ট্রিকটেড করুন, বিভিন্ন সফটওয়্যার দিয়ে আপনি নিজের ডিভাইস দিয়ে বাচ্চা কি করছে, কি দেখছে তা আপনি দেখতে পাবেন এমনকি মেসেঞ্জার চ্যাট ও।
তবে সবচে উত্তম হলো আল্লহভীরু বানান। যেনো নিজে তো দেখবেই না, বরং অন্যকেও বাধা দিবে। ভালো মন্দ চুজ করতে শিখবে। নিজেকে কন্ট্রোল করতে শিখবে।
ওয়াইফাই ব্লক যেভাবে করবেন তার লিংক কমেন্টে দিবো।
৫/ পারসোনাল হাইজিনঃ
জরুরি বিষয়। হাইজিন মেইন্টেন করা শিখান। কিভাবে গোসল করবে, কিভাবে প্রাইভেট পার্টের যত্ন নিবে। ভালো ফুড হ্যাবিট শিখান। চিপস আর কোল্ড ড্রিংকস আর জাংক ফুড কে নো বলতে শিখান।
এসময় ছেলেমেয়েদের কমন সমস্যা ব্রন। তাদেরকে স্কিন কেয়ার শিখান, স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট কিনে দেন বা বাসায় হাতে বানিয়ে দেন। ব্রনের জন্য হিজামা করাতে পারে ন্যাচারাল চিকিৎসা। প্রায়ই বদনজরের রুকইয়াহ করান বাসায়।
মেয়েদের পিরিয়ড রেগুলার কিনা লক্ষ রাখুন। চিকিৎসা নেন প্রয়োজনে। বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে এসব ধারনা থেকে বের হয়ে আসুন। ছেলেদের হাইজিনের বিষয়টি বাবারা লক্ষ রাখুন, আলাপ করুন।
আর অনেককে দেখা যায় দীর্ঘসময় বাথরুমে থাকে। এটা লক্ষ রাখুন। দীর্ঘক্ষন গোসল করা কোনো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার লক্ষন নয়। এটা ওয়াসওয়াসা বা অন্য কিছু হতে পারে। তাই এরকম হলে এক্সপার্টদের হেল্প নিন।
পরিষ্কার ভদ্র পোষাক পড়ান। ট্রেন্ড এ গা ভাসিয়েন না। হায়ার একটা অংশ পোষাক।
হাইট আর ওয়েটের বিষয়টা চেক করুন। ব্যায়ামের অভ্যাস করান। সকালে বিকালে হাটতে নিয়ে যান পার্কে।
আমার টিন এইজ বাচ্চা নেই। কিন্তু চিকিৎসক আর লাইফ স্টাইল এক্সপার্ট হিসেবে এতোকথা বলে গেলাম.... আশা করি উপকৃত হবেন। পয়েন্টের শেষ নেই। আবার একদিন আলোচনা করবো ইন শা আল্লহ।
কপিরাইটঃ Dr. Effat Saifullah

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ