প্রথমেই বলে রাখি, ঐতিহাসিক কোনো বই পড়া শুরু করলে আমি কখনোই সেই বইয়ের প্রতিটা লাইনকে মহাগ্রন্থের মতন বিশ্বাসযোগ্য মনে করিনা। কারণ নিজের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করতে পারি প্রতিটা মানুষই সহজাত প্রবৃত্তি থেকে পক্ষপাতদুষ্ট। Freedom at Midnight এর লেখকদ্বয় ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক ল্যাপিয়েরও আমার সেই সন্দেহের বাইরে নয়।
এই বইতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের অনেক মানুষের প্রচ্ছন্ন আলাপ থাকলেও প্রকট হিসেবে চিত্রায়িত হয়েছেন দুইজন মানুষ। একজন হলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং অন্যজন ল্যুই মাউন্টব্যাটেন।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত আরো ৩টি বই
বণিক হয়ে এসে ব্রিটেনের উপনিবেশ গড়ে তোলার কাহিনি তো সবার জানা। কিন্ত মাত্র এক পাউন্ড গোলমরিচের দাম পাঁচ সিলিং বাড়িয়ে দেওয়ার মত তুচ্ছ ঘটনার প্রেক্ষিতে যে ব্রিটেনের উপনিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো সেটা হয়তো আমার মতন অনেকেরই জানা ছিলো না।
গান্ধীজির অন্যতম শত্রু এবং ইংল্যান্ডের কমন্স সভার কুশলী বক্তা উইন্সটন চার্চিল গান্ধীজিকে "হাফ নেকেড ফকির" হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। হাতের লাঠির উপর ভর নেয়া জীর্ণশীর্ণ এই হাফ নেকেড শরীরটা যে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য কাঠিন্যের প্রতীক হয়ে যাবে এটা বুঝতে পারলে হয়তো চার্চিল এই কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করতেন না।
প্রায় ৫৫০ পৃষ্ঠার এই বইয়ের মলাটে বন্দী করা হয়েছে ইংরেজদের সাথে বিভিন্ন সময় ঘটে যাওয়া চুক্তি, সংঘর্ষ এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা। হিস্ট্রি জনরার বই যারা পছন্দ করেন তাদের মস্তিষ্কের জন্য Freedom at Midnight PDF একটা ভালো বই।
মুম্বাই উপসাগরের ছোট ছোট ঢেউগুলো যেন তাদের বুকের মধ্যে সযত্নে লালন করছে ছোট্ট উঁচু ভূখণ্ডটা। ভূখণ্ডের উপর গর্বোদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে রুক্ষ এবড়ো-খেবড়ো গাঢ় হলুদ পাথরের আকাশছোঁয়া গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার খিলান। উর্মিমালার মৃদু আঘাতে তিরতির করে কাঁপছে তীরের সবুজ শ্যাওলা আর উদ্ভিদ আবর্জনাস্তুপ। খিলান থেকে সাগরবেলা পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে সিমেন্ট বাঁধানো ঢালু গড়ানে পথ। তাকে বেড় দিয়ে রেখেছে এই শ্যাওলা আর অন্য জলজ আবর্জনা।
একটা বিচিত্র জীবনের জগৎ যেন জড়িয়ে আছে ওই বিশাল কংক্রীট খিলানের ছায়াছন্ন পরিবেশে। কত বিচিত্র জীবিকার মানুষ তারা। সাপুড়ে, জ্যোতিষী, ভিখারি আর ভবঘুরে। নেশায় বুঁদ হয়ে একপাশে পড়ে আছে উদ্ধৃঙ্খল হিপি কিংবা দরিদ্র মৃতপ্রায় কিছু লোক। এই বহুজাতিক ব্যস্ত শহরের প্রান্তিক মানুষ ওরা। শুয়ে বসে থাকা এই মানুষগুলোর মধ্যে একজনও অলস চোখে খিলানের মাথার দিকে চোখ তুলে তাকায় না। ওরা কেউ জানে না কী লেখা আছে ওই খিলানোর মাথায়।
অথচ কী স্পষ্ট ওই খোদাই করা লেখাগুলো! ‘১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের দোসরা ডিসেম্বর তারিখে মহানুভব সম্রাট পঞ্চম জর্জ এবং সম্রাজ্ঞী মেরীর ভারতভূমিতে পদার্পণের স্মারকরূপে প্রতিষ্ঠিত হলো এই স্মারক খিলান।‘ তবে বলা যায় যে, গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার এই স্মারক খিলানটিই একদা ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম সাম্রাজ্যের বিজয়প্রতীক। তখন বংশানুক্রমে ব্রিটেনবাসীরা সগৌরবে এই বিজয়স্তম্ভের আকাশছোঁয়া শীর্ষদেশের দিকে তাকিয়ে থাকত।
জাহাজের ডেক-এ দাঁড়িয়ে এই সুমহান কীর্তিস্তম্ভের দিকে চেয়ে থাকার সময় স্কটল্যান্ড ও মিডল্যান্ডের গ্রামগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসা এইসব যুবকদের চোখ ধাধিয়ে যেত। তাদের মনে হতো বুঝি সার্থক হলো এই কিংবদন্তীর দেশে আসা। তখন বিজয়তোরণ পেরিয়ে দলে দলে মানুষ এই উপমহাদেশে এসেছে।
"ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট" বই সম্পর্কে কিছু কথাঃ
প্রত্যাশিতভাবেই এই গ্রন্থের মুখ্য চরিত্র দুটি। রিয়্যার অ্যাডমিরাল লুই মাউন্টব্যাটেন এবং মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। অন্যরা পার্শ্বচরিত্র। তবে যেমন দাপটের সঙ্গে লুই মাউন্টব্যাটেন বিরাজমান তেমনটি গান্ধীজী নন।
মাউন্টব্যাটেনের চোখে তিনি যেমন ‘ছােট্ট বিষন্ন পাখি’, আমাদের চোখেও তাই-ই। বলাবাহুল্য, এ কোনাে স্বেচ্ছাচারী চরিত্রায়ন নয়। তৎকালীন রাজনৈতিক আকাশে মােহনদাস গান্ধীর ভূমিকা বাস্তবিকই অসহায় এবং বিষন্ন। দেশভাগ যখন ‘সেট ফ্যাক্ট”, দ্বি-জাতিতত্ত্ব যখন সাধারণ মানুষের কাছে পরিত্রাণ পাবার একমাত্র বাস্তব সত্য পথ, তখন গান্ধীজীর ভূমিকা নীরব অসহায় দর্শক ছাড়া আর কী হতে পারে? তাঁর বেদনা যে এই অনিবার্যতা তিনি ঠেকাতে পারেননি। কিন্তু তার চেয়েও বড় বেদনা যে, দেশের মানুষ তাঁর ইচ্ছামতাে চলেনি। সবাই এসে একে একে সরে গেছে তার আদর্শ থেকে। বেঁচে থাকতেই তিনি একলা থেকে গেলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
চৌদ্দই আগস্ট মধ্যরাতে জওহরলাল যখন "ট্রাইস্ট উইথ ডেসটিনি"র কথা বললেন তখন দেশের সাধারণ এবং ছিন্নমূল মানুষ অনেক সান্ত্বনা পেয়েছিলেন। কিন্তু আগামীদিনে সে সান্ত্বনা টেকেনি। অনেক মত ও পথ, সামাজিক, রাজনৈতিক অনেক টানাপড়েনের সংঘাতে বিবর্ণ হয়ে গেছে সেই সান্ত্বনা।
চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক মুদ্রণপ্রমাদ ঘটে গেছে। সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। গান্ধীজীর জীবনাবসান হয়েছিল ৩০শে জানুয়ারি, ১৯৪৮ সনে। রােগশয্যায় শুয়ে দেহ রাখেননি তিনি। গান্ধীজী নিহত হয়েছিলেন। প্রায় ইচ্ছামৃত্যুই বলা যায় কারণ তিনি কোনাে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেননি। কিন্তু এই আত্মত্যাগ সত্ত্বেও গান্ধীজী দধীচি হলেন না। তাঁর অস্থি দিয়ে কোনাে বত্র আজও নির্মিত হলাে না। এ আমাদেরই পাপ। তাঁর পুণ্যস্মৃতিতে নিবেদিত হলাে এই অনুবাদগ্রন্থটি।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....