‘রাইসা’য়, জীবন খুব একটা শান্তির না। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে লোকজন হাত মোচড়ায়; কানতে থাকা ছোটো পোলাপানরে অভিশাপ দেয়; নদীর ধারে রেলিং-এ ভর দিয়া ঝুঁইকা, দুইহাতে কপালের রগ চেপে ধরে। সকালবেলা ঘুম ভাঙে দুঃস্বপ্নে, জাগার সাথেসাথে আরেক দুঃস্বপ্ন শুরু হয়। ওয়ার্কবেঞ্চে—যেখানে প্রতি মুহূর্তে নিজের আঙুলের উপর হাতুড়ি চালানো বা সুঁই ফুটানো ছাড়া আর কোনো কাজ নাই আপনার—, বানিয়া বা ব্যাংকারের হিশাবের খাতায় লেখা সারি সারি তেরছা সংখ্যার উপর, অথবা মদের দোকানে জিঙ্ক কাউন্টারে সাজানো খালি গ্লাশগুলার উপর নোয়ানো মাথাগুলা, অন্তত নিজেদের স্বাভাবিক লাল টকটকা চোখ ঢাইকা রাখতে পারে৷ বাড়ির ভিতরে অবস্থা আরো খারাপ হয়; কত খারাপ তা জানতে ঘরে ঢোকা লাগবে না আপনার: গরমকালে বাড়িঘরের জানালায়ই শুনবেন চরম হাউকাউ আর থালাবাসন ভাঙ্গাভাঙ্গির আওয়াজ।
কিন্তু তবুও, ‘রাইসা‘য় প্রতি মুহূর্তে কোনো না কোনো বাচ্চারে দেখা যায় জানালায় দাঁড়াইয়া একটা কুকুর দেইখা হাসতেছে; কুকুরটা লাফ দিয়া একটা চালে উঠছে, এক টুকরা ‘পলেন্তা‘ [ঘন এক ধরনের পুডিংজাতীয় খাবার; ইতালিতে বানায়] খাওয়ার জন্য; পলেন্তার টুকরাটা ফালাইছে এক রাজমিস্ত্রী, বিল্ডিংয়ের গায়ে ঝুলানো ভারার উপর বসে সে চিৎকার করে এক যুবতী কাজের মেয়েরে বলতেছে— ‘ডার্লিং, আমারে ওইটার মধ্যে একটা ডুব দিতে দ্যাও‘; কাজের মেয়েটা ঘন মশলায় কসানো ছোটো ছোটো গোশতের টুকরা আর সবজি দিয়া বানানো একটা খাবারের ডিশ নিয়া, লতাপাতায় ছাওয়া এক গেটের নিচে দাঁড়ানো, খাবারটা এক ছাতার কারিগররে দেবে ভাইবা সুখ লাগে তার; সেই ছাতার কারিগর মাত্রই একটা সফল লেনদেন কইরা মহাখুশি; তার দোকান থেকে ঘোড়দৌড়ের মাঠে পইরা যাওয়ার জন্য, শাদা লেসফিতায় আটকানো একটা প্যারাসোল [মাথায় আটকানো যায় এমন ছোটো ছাতা] কিনছে সুন্দরী এক মহিলা; সেই নারী প্রেমে পড়ছে এক অফিসারের, ভদ্রলোক রেসের শেষ লাফটা দিয়া মিটিমিটি হাসতেছে ওই সুন্দরীর দিকে চেয়ে, একজন সুখী মানুশ; আর তারচেয়েও সুখী তার ঘোড়াটা: অবস্ট্যাকলগুলার [রেসের মাঠে কাঠ দিয়া বানানো যে বেড়াগুলা থাকে] উপর দিয়া উড়ে উড়ে যাইতেছে যেন, তাকায়ে আছে একটা তিতির পাখির দিকে; পাখিটা খোলা আকাশে উড়তেছে, সুখী সুখী একটা পাখি, খাঁচা থেকে ছাড়া পাইছে আজই; তার খাঁচা খুইলা দিছে এক পেইন্টার, প্রত্যেকটা পালক ধরে ধরে পাখিটা আঁকতে পারায় চরম খুশি সেও; লাল-হলুদ ফুটকিতে ভরা পালকসহ পাখিটা সে আঁকছে একটা বইয়ের নির্দিষ্ট একটা পেজের নকশা করতে, যেখানে দার্শনিক বলছেন: ‘বেদনার শহর ‘রাইসা‘য়, এক অদৃশ্য সুতার খেলা চলে : গোপন সেই সুতলির প্যাঁচে, মুহূর্তের জন্য এক জীব বান্ধা পড়ে আরেক জীবের সাথে, এরপর প্যাঁচ খুইলা যায়; আর তারপর, এই দুইটা চলন্ত বিন্দুর মধ্যে যোগাযোগের নতুন নতুন, হুটহাট নকশা আঁইকা ছড়াইতে থাকে সেই সুতলি; যাতে প্রত্যেক সেকেন্ডে, অসুখী এই শহরের মধ্যে ধরা পড়ে খুব হাসিখুশি আরেকটা শহর, যার অস্তিত্ব সে নিজেই জানে না।‘
Tuhin Khan এর অনুবাদে ইতালো ক্যালভিনোর 'গায়েবি শহর' আসছে বৈভব থেকে...
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....