মায়াবনবিহারিণী হরিণী লেখক : কিশোর পাশা ইমন | mayabon biharini

  • মায়াবনবিহারিণী হরিণী
  • লেখক : কিশোর পাশা ইমন
  • প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২১
  • প্রকাশনা : অবসর প্রকাশনা সংস্থা
  • প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ
  • জঁরা : রহস্যরোমাঞ্চ, সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার
  • রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ


মেঘনা নদীর তীর। ছোট্ট একটি হাউজিং সোসাইটি। মেঘনার ঢেউয়ের মত অকৃত্রিম নয় ওখানকার মানুষজন। বাঙালি মধ্যবিত্ত মানসিকতার অভিশাপে পুষ্ট অগনিত কলোনির একটি মাত্র ওটি। একধরণের মিথ্যা বিশুদ্ধতায় যথারীতি জীবনযাপন করতে চায় ঐ জায়গার প্রায় সবাই।
নাদিয়া, চৈতি এবং মিথিলা। রক্ষণশীল এলাকার আলোচিত তিনজন সুন্দরী। আকস্মিকভাবে হারিয়ে যায় চৈতি। কারো ধারণা প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে সে। আবার কারো ধারণা কলোনি থেকেই বের হয়নি এবারের ইন্টার পরীক্ষার্থী মেয়েটি।

প্রিয় বান্ধবীকে খুঁজে বের করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে মিথিলা ও নাদিয়া। পুলিশ তদন্তে নেমেছে। তবে বদ্ধ ঐ সমাজের অনেক কিছুই পুলিশ জানে না। তাই ডাক্তার মিথুন গোয়েন্দা তৎপরতায় নেমে যান। ডায়াগনসিসের প্রবীন ডাক্তার শাহনেওয়াজ মিথুনের সিনিয়র। শিষ্যকে এই তদন্তে সহযোগিতা করতে চান তিনিও। শেষ রক্ষা কি হবে?
 
একটি পশ্চাৎপদ সমাজব্যবস্থায় বেশিরভাগ মানুষের মননশীলতা লোপ পায়, মগজ পরিণত হয় ঘুনের স্বর্গে। নিজেকে মিথ্যা মিথ্যা বিশুদ্ধ দেখানোর চক্রে পড়ে সৃষ্টি হয় ভয়ানক সব দানবের। মানুষরূপী দানব। গল্পে সন্দেহের তালিকায় চলে আসেন জাতীয় দলের ব্যর্থ ক্রিকেটার রাহাত, একজন লম্পট দোকানী, চৈতির প্রেমিক এবং আরো অনেকে। কলোনি থেকে নিরাপত্তারক্ষীরা কেউ চৈতিকে বের হতে দেখেনি। তাহলে সে গেল কোথায়?
 
কলোনিতে আছেন মিড লাইফ ক্রাইসিসে ভুগা বুড়োদের দল। বাংলাদেশের যেকোন গতানুগতিক নাগরিকের মত দৃষ্টিভঙ্গি তাদের প্রত্যেকের। আছেন 'পাশের বাসার আন্টি' রা। নিজ জীবনের চেয়ে অন্যের চলাচলে যাদের সতর্ক দৃষ্টি, যেন এক একজন এসপিওনাজ এজেন্ট। আছে বিভিন্ন রকমের বাতিল হয়ে যাওয়া ধ্যান-ধারণা এবং কর্মকান্ডের সমাহার। এর মাঝে পুলিশের তদন্তে নাক গলানোর অপরাধ থেকে গা বাঁচিয়ে ডাক্তার মিথুন কতদূর যেতে পারবেন? যেখানে প্রাণ রক্ষা করাটাই কঠিন হয়ে পড়ছে তাঁর এবং আরো অনেকের।
 
কিশোর পাশা ইমনের উপন্যাসিকাটি আমার মনে হয় আন্ডাররেটেড। লেখক যথারীতি রহস্যরোমাঞ্চের যাত্রার মধ্য দিয়ে সমাজের আরেকটি স্তরের সাথে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমি এখন পর্যন্ত কেপির চারটি ব‌ই পড়েছি। তাকে কখনো খারাপ লিখতে দেখিনি। তাঁর জাদুঘর সিরিজ অথবা ডিসটোপিয়ার সাথে এই গল্পের প্লটে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। হিরো এখানে প্রায় অপ্রতিরোধ্য নয়। এই বিষয়টি আমার খুব ভালো লেগেছে। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা হয়তো এই আখ্যান পড়ে আরো বেশি পছন্দ করতে পারেন। কারণ বর্তমান প্রজন্মের মনস্তত্ত্বের অনেক নির্ভেজাল এবং প্রাঞ্জল উপস্থাপনা আছে এই গ্রন্থে।
 
সমাজের স্তরে স্তরে ঠিক চোখের সামনে লুকিয়ে থাকা অপরাধী এবং অপরাধ সনাক্তকরণ করেছেন লেখক মিনিমালিস্ট এপ্রোচে। ক্রিমিনোলজির বেসিক কিছু বিষয় জানা হয়ে যাবে পাঠকের ব‌ইটি পড়া শেষ করতে করতে। গল্পকথনে কেপি বর্তমানে সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে সেরাদের একজন। উপন্যাসিকাতে অনেকসময় লেখকরা বিভিন্ন গ্যাপ নিজ ব্যক্তিত্ব অথবা পছন্দ-অপছন্দ দিয়ে জেনে বা না জেনে পূর্ণ করেন। 'মায়াবনবিহারিনী হরিনী' এই দোষ থেকে মনে হয় মুক্ত।

আমাদের সমাজব্যবস্থা ভন্ডামির বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে লুকিয়ে থাকা ভয়ানক সাইকোদের থেকে মুক্ত নয়। এই বিষয় অনেকসময় মনটা বিষন্ন‌ই করে দেয়। কারণ গড়পড়তা চিন্তাভাবনার মানুষের মন এক অন্ধকার গুহা। রবীন্দ্রনাথ রচিত এই সুন্দর গানটিও মনকে বিষন্ন করে দেয়।

মায়াবনবিহারিণী হরিণী,
গহনস্বপনসঞ্চারিণী,
কেন তারে ধরিবারে করি পণ, অকারণ।
থাক্ থাক্ নিঝুম নিধুরেতে,
আমি শুধু বাঁশরীর সুরেতে
পরশ করিব ওর প্রাণমন, অকারণ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ