শব্দের ধর্মপরিচয় সম্পর্কে জানুন ! - সাইফ সিরাজ | Shobder Dhormoporichoy

 
শব্দের ধর্মপরিচয়



আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মধ্যপন্থার চর্চা খুব কম। ইসলাম যে মধ্যপন্থাকে পছন্দ করে, তার উপস্থিতি আমাদের জীবনে নেই বললেই চলে। উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে দুইটি ধারা সমান্তরাল চলছে। একটা ধারা ইলম ও আমলের সমন্বিত ধারা। আরেকটি ধারা শুধুই অনুসরণকারী। অনুসরণকারীদের মধ্যে আবার দুই দল। একদল আমলের ক্ষেত্রে যথেষ্ট যত্নশীল। আরেকদল শুধুই ধর্মপরিচয় লেখার সময় নিজের মুসলমানিত্ব স্মরণ করে।

এই অঞ্চলের প্রান্তিকতার দুইটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। 
এক.
আমাদের শৈশবে আমরা জেলে পাড়ায় যেতাম চেঁপা বা শুঁটকি আনতে। কিন্তু কখনোই তাদের ঘরের বারান্দাতে পা রাখার সুযোগ পেতাম না। একদিন, চেঁপা আনতে গিয়ে বৃষ্টির মুখোমুখি হলাম। বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজেছি। কিন্তু তাদের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি। অথচ বাজারে তাদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে ঠিকই তাদের পাশের চেয়ারে বসার অনুমতি ছিল।

দুই.
সবে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের শুরু। মাদরাসাজীবনের চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছি। রেল স্টেশনে, লজিং বাড়ি যাওয়ার পথে, কোনো আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেলে অথবা বাজারে হাঁটতে-চলতে প্রায়ই কাউকে না কাউকে সালাম দিতে ভুলে যেতাম। বেরসিকের মতো কেউ কেউ প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন, ‘হুজুর, সালাম দিলেন না যে? আপনাদের হুজুররা কি সালাম দেওয়া শেখায়নি?’ এই ধরনের প্রশ্নকর্তার অধিকাংশই হতেন দাড়ি ছাড়া। তো একদিন এক বড় ভাই শিখিয়ে দিলেন, ‘এমন প্রশ্ন করলে বলবি, আপনি মুসলমান না হিন্দু সেইটা তো বুঝা যায় না। তাই সালাম দিই নাই।’ 

এক-দুই জায়গায় এই উত্তর দিয়েছি এবং প্রশ্নকর্তাও জব্দ হয়েছেন। লজ্জিত হয়েছেন। বিব্রত হয়েছেন। একদিন আব্বা জানলেন আমি এইরকম কথা বলেছি বাজারে কাউকে। এরপর রাতে প্রচণ্ড রাগে তিনি আমাকে দুই-তিনটা থাপ্পড় কষে দিলেন। বললেন, ‘তোর কাজ সালাম দেওয়া। কে কোন ধর্মের এইসব দেখা তোর কাজ না। এইরকম ফালতু কথা শিখানোর জন্য তো তোরে মাদরাসায় পড়াচ্ছি না।’ এরপর আর জীবনে কখনোই এই প্রান্তিকতাকে ধারণ করিনি।

ইলমি ধারায় আবার বহু ঘরানা। সেই ঘরানাগুলো নিজ নিজ চিন্তা ও আকিদায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত প্রান্তিক। কেউ উদারতায়, কেউ কঠোরতায়, কেউ ছাড়াছাড়িতে আবার কেউ বাড়াবাড়িতে। এইসব প্রান্তিকতার ভেতর দিয়ে চলছে এই অঞ্চলের মুসলমানদের জীবনযাপন। 

একসময় শিক্ষিত মুসলমানদের ভেতরে তাদের ঘরানাগত প্রান্তিকতার মতো বাংলা ভাষার শব্দ নিয়েও শুরু হয় প্রান্তিক আচরণ। কেউ গ্রহণে প্রান্তিক আবার কেউ বর্জনে প্রান্তিক। কারো মতে ভাষার আবার কীসের ধর্মপরিচয়? আবার কেউ বলেন ভাষা তো জীবনেরই অংশ। সুতরাং মুসলমানদের ভাষা হবে ফিকহের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ সম্পূর্ণ হালাল ভাষা। যেখানে কেবল ইসলাম অনুমোদিত শব্দের হাজিরা থাকবে। শব্দের নাম হয়ে গেছে শিরিকি শব্দ, অসৎ শব্দ অথবা হিন্দুয়ানি শব্দ।

উদারপন্থিরা ‘ভাষার আবার ধর্ম কীসের?’ প্রশ্ন উত্থাপন করে দুইভাগে ভাগ হয়েছেন। একদল ইসলামের কিংবা আরবির ঘ্রাণযুক্ত শব্দকে বাংলা ভাষা থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে পারলে বাঁচেন। উদ্দিষ্ট শব্দটির বাংলা না থাকলেও জোরজবরদস্তি একটা বাংলা তারা তৈরি করে নেন। সম্প্রতি ‘আদমশুমারি’ শব্দটিকে অসাম্প্রদায়িক কিংবা আরবি অথবা ধর্মের ফ্লেভার থেকে মুক্ত করতে ‘জনশুমারি’ করা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন ‘আদম’ শব্দটি ইসলামি এবং মুসলিম ঐতিহ্যের অংশ; তাই আদমের পরিবর্তে ‘জন’ শব্দটিকে নেওয়া হয়েছে। অথচ বাংলা করতে গিয়ে ‘জন’ বাংলা নিলেও ফার্সি ‘শুমার’ থেকে শুমারি ঠিকই রয়ে গেছে!

কবি সোহেল হাসান গালিব ‘বাদ মাগরিব’ নামে বই লিখেছেন। সেই বইয়ের একটা উদ্দেশ্য হলো, আমাদের এই অঞ্চলের সেক্যুলার-প্রগতিশীল অনেকেই ‘বাদ মাগরিব’, ‘বাদ আসর’ ব্যবহার করতে নারাজ। তারা ইসলাম ধর্মীয় ও আরবীয় শব্দগুলো এভয়েড করতে চান। ওদিকে কলকাতার অবস্থা আরও ভিন্ন। তারা তাদের নিজেদের শব্দ, ধর্মীয় শব্দের বাইরে সাধারণ মুসলমানিত্বের গন্ধ আছে এমন শব্দ সচরাচর লিখতে চান না। কলকাতার লেখকদের শিকড় সংলগ্ন থাকার প্রচেষ্টাটা স্পষ্ট। আবার আমাদের বাংলাদেশের অধিকাংশ লেখকই নিজের লেখায় ধর্মপরিচয় লুকাতে পারলে বাঁচেন।

কবি হাসান রোবায়েত যখন ইসলাম ধর্মীয় অনুষঙ্গ অথবা কুরআনের আয়াত ও নবীজির নাম কবিতায় প্রয়োগ করেন, কবিতা লেখেন ইসলামের মিথ ও বিষয় নিয়ে; তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সেই কবিতার নিচে মন্তব্য করেন, ‘আমি ধর্মীয় কবিতা পড়বো না।’ কেউ মন্তব্য করেন, ‘বাংলায় এতো আরবি কেনো?’ ফলত দেখা যায় প্রান্তিকতার চর্চা সরবেই চালু থাকে বাংলা ভাষায়। বাংলা ভাষার চর্চায়। সাহিত্যে ও কবিতায়। মননে ও চিন্তায়। একটা অসুন্দর সর্বত্রই চলমান থাকে; ভাষার ইসলামিকরণ অথবা ভাষায় ইসলাম দূরীকরণের অন্যায্য ভাবনায়। ফলে, বাংলা ভাষার শব্দ নিয়ে চলতে থাকে একটা ঠান্ডা ও নীরব যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে এসে শামিল হয় একদল ইনফেরিয়রিটি ও সুপিরিয়রিটি সম্পন্ন মানুষ। তাদের প্রচেষ্টা ও এক্টিভিটি আরও জটিল।

বাংলা ভাষার শব্দ নিয়ে যখন সেক্যুলার ও প্রগতিশীলদের ভাবনাটা এমন; তখন বাংলাদেশের ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় চৈতন্যের মানুষের মধ্যে আছে আরেক ভাষা ও বাংলা শব্দ ভাবনা। এখানের অনেকেই ‘জল’ লিখতে ও বলতে চান না। কিন্তু সজল, জলাশয়, জলাতঙ্ক, জলাবদ্ধতা অহরহই ব্যবহার করছেন। ওদিকে এই অঞ্চলের হিন্দুরা ‘পানি’ বলতে কুণ্ঠিত। কিন্তু হিন্দিতে অনায়াসেই ‘পানি’ বলছেন তারা। 

কাকা, মাসি, পিসি, দিদি ছাড়া কখনোই সনাতন ধর্মের লোকজন চাচা, ফুফু, খালা, আপা ব্যবহার করেন না। যদিও মুসলিমদের অনেকেই প্রয়োজন হলে এইসব সম্বোধন ব্যবহার করে থাকেন। আমরা এখনো আমাদের হিন্দু স্যার ও মুরুব্বিদের ‘আদাব’ বলে সম্মান দেখাই। কিছুদিন আগেও ওরা আমাদের ‘সালাম’ না দিয়ে ‘আদাব’ই বলত। খুব সম্প্রতি কাউকে কাউকে দেখছি ‘সালাম’ দিচ্ছেন।

বাসে বা ট্রেনে দেখা যায়; একজন ক্যানভাসার ধর্মের নাম নিয়ে নিয়ে সালাম, আদাব, নমস্কার ইত্যাদি বলে থাকে। ইদানীং রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলোতে কুরআন তিলাওয়াতের পর গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেল পাঠ করা হয়। আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নানা ধর্মের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। সাধারণত অন্যদেশের মানুষেরা অনুষ্ঠানের শুরুতে তাদের ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে না। শুধু মুসলিমগণই নিজেদের প্রোগ্রামের শুরুতে তিলাওয়াত করেন। বাংলাদেশীয় এই উদারতা মূলত একটা ভাষা-ধর্ম-পলিটিক্স। এই জিনিস যারা শুরু করেছেন, তাদের উদ্দেশ্য অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখানো। অথচ এই পলিটিক্সে কেবল পলিটিক্স চলবে। অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা থাকবে সুদূরপরাহত। কারণ, এইসবই একটা লৌকিক আইওয়াশ। এসবের প্রবক্তাদের ভেতরে স্পিরিচুয়ালি কোনো স্পিরিট নেই।

আসমানি গ্রন্থগুলোর সবগুলোই নাযিল হয়েছে আঞ্চলিক ভাষায়। অর্থাৎ যে অঞ্চলের নবী সেই অঞ্চলের ভাষা। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সকল রাসুলের উম্মতই আগে পথভ্রষ্ট ছিল। হয়তো পৌত্তলিক; নয়তো অগ্নিপূজারি; অথবা ভিন্ন কোনো রিচুয়ালের অনুসারী। ফলে সেই অঞ্চলের মানুষের চর্চিত যে ভাষা, সেই ভাষাতেই নাযিল হয়েছে আসমানি কিতাব। আরবে কুরআন নাযিল হয়েছে আরবিতে। কুরআন নাযিলের আগে আরবি ছিল সেই অঞ্চলের পৌত্তলিকদের ভাষা। ফলে, তাদের ভাষাকেই ইসলাম গ্রহণ করেছে। অবশ্যই ফিল্টার করে নেওয়া হয়েছে। আবার পৌত্তলিকদের শব্দকেই সরাসরি সদার্থে ইসলাম ব্যবহার করেছে। [যথাস্থানে উদাহরণ দেওয়া হবে]।

এই সাধারণ ভাবনা থেকে আমরা দেখি ভাষার ধর্মতাত্ত্বিক সিলসিলা খুব জরুরি কিছু না। আবার শব্দের ধর্মপরিচয়টাও ব্যাখ্যা ও আলোচনা সাপেক্ষ। নিরঙ্কুশ কিংবা অকাট্য কোনো প্রমাণও নয়। 

অন্যদিকে যেসব শব্দ কাফির-মুশরিকদের শিয়ার, পরিভাষা; অথবা একান্ত তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের বাহক, সেসব শব্দ যদি ইসলামি বোধ ও বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তবে ঈমানের দাবি সেগুলো এড়িয়ে চলা। এই এড়িয়ে চলার চিন্তা থেকে শব্দের উৎপত্তিগত যেই কদর্য অর্থ শব্দ নিজেই হারিয়ে সদার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে, তাকে তার উৎসে ফিরিয়ে নিয়ে; ব্যবহার-অনুপযোগী বানানোর সুযোগও ভাষাতাত্ত্বিকভাবে নেই। এই দেশের ধর্মীয় ইলমি পরম্পরায় যে ভাষানীতি ব্যবহার করা হয়, তা অত্যন্ত উদার, আধুনিক ও সরল। আরবি ভাষার নাহব, সরফ, বালাগাত ও মানতিকের যেই ভাষারীতি ও ভাষাচিন্তা, তাতে আত্মীকরণের অপার সম্ভাবনা থাকলেও আমরা অতি কঠোরতায় বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা মনে করে বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডারকে সংকুচিত করছি।

অপরদিকে বাংলা ভাষার পরম্পরা আর ঐতিহ্যে শব্দ আত্মীকরণের যে ধারাবাহিকতা চলে আসছে, তাতে এই ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে আরবি, ফার্সি, ইংরেজি, ওলন্দাজ, তুর্কি, বার্মিজ, জাপানিজ, হিন্দি ও উর্দু ভাষার শব্দ আত্মীকরণের মাধ্যমে। ফলে বাংলা ভাষার ছোট্ট একটা শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যে পূর্ণ হয়ে বিকশিত হয়েছে। এখন কেউ যদি আরবি, ফার্সি শব্দগুলোকে ইসলাম ধর্মীয় ভাষা-ঐতিহ্য ভেবে এড়িয়ে চলেন; তাহলে তিনি মূলত বাংলা ভাষারই সংকোচন ও সর্বনাশ করবেন। অন্যদিকে কেউ যদি বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত কতিপয় শব্দকে দুষ্ট, শিরিকি, অসৎ আখ্যা দিয়ে এভয়েড করেন, তিনিও বাংলাকে সংকুচিত, অবগুণ্ঠিত ও আড়ষ্ট করবেন।

যদিও সমৃদ্ধ বাংলা ভাষার ইতিহাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের নাম আগে আসে। তবুও ইতিহাস বলে মুসলিম শাসকেরাও বাংলাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। সেই ইতিহাস ও উদাহরণ অন্য নিবন্ধে আলোচনার আশা রাখি। 

একটা ঘটনা বলে লেখার শেষ করছি। সামহোয়্যার ইন ব্লগে আমি ব্লগিং করতাম ‘সুপান্থ সুরাহী’ নিকনেমে। এই নামের কারণে ব্লগারদের বড় একটা অংশ আমাকে হিন্দু মনে করতেন। একদিন একটা লেখায় একজন আমার নামের অর্থ জানতে চাইলেন। আমি লিখলাম, ‘সু’ মানে ভালো। ‘পান্থ’ মানে পথিক। ওদিকে ‘সু’ মানে ভালো। ‘রাহী’ মানে ‘পথিক’। মূলত আমি সুপান্থ ইবনে সুরাহী। কারণ, আমার বাবার ডায়রিতে তার প্রতিটি কবিতায় নিজের নাম লিখতে দেখেছি ‘সুরাহী’। কয়েকটা রিপ্লাই এল। একজন লিখলেন, ‘আমি ভাবছিলাম সুরাহী মানে পানপাত্র।’ অন্যজন বললেন, ‘আপনি তাইলে মুসলমান!’ ঢাকার শাহবাগে একদিন কয়েকজন ব্লগারের সঙ্গে দেখা হলে তারা সবিস্ময়ে বলেছিলেন, ‘সুপান্থ ভাই, এমন একটা সুন্দর নিকের আড়ালে এমন একজন জবরদস্ত হুজুর আছেন! কোনোদিনই ভাবতে পারিনি।’ এই হলো আমাদের শব্দ বিষয়ক চিন্তা ও চৈতন্য! সম্প্রতি নাম বিষয়ক জটিলতা আরও তীব্র হচ্ছে। কেউ কেউ আরবি নাম কেন রাখব! এই ধরনের আসাবিয়্যাতপূর্ণ প্রশ্নও তুলছেন। আবার কেউ বাংলা নাম রাখলেই বাঁকা চোখে দেখছেন। এই ঠেলাঠেলি, বাড়াবাড়ি আর ছাড়াছাড়ির খামখেয়ালিতে মধ্যপন্থিদের উত্থান হওয়া খুব জরুরি এখন।

মধ্যপন্থার আহ্বান রেখে আজকের কিস্তি শেষ করছি।

সাইফ সিরাজ
কবি ও বিশ্লেষক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ