সিরাতের সৌরভ : আরাফাত শাহীন | Sirater Showrov

বই : সিরাতের সৌরভ
লেখক : আরাফাত শাহীন
প্রকাশনী : দারুল ইলম
বিষয় : সীরাতে রাসূল (সা.)
পৃষ্ঠা : 96, কভার : হার্ড কভার
ভাষা : বাংলা

শুরুর কথা
সকল প্রশংসা মহান প্রভুর সমীপে; যিনি হেদায়েতের প্রদীপ হাতে, সত্যদ্বীনের ধারকরূপে প্রিয় রাসূলকে পাঠিয়েছেন আমাদের মাঝে। ঘটিয়েছেন তাঁর পূর্ণিমাময় মর্যাদার আকাশে অপূর্ব সব নক্ষত্রের সমাহার। কী শিক্ষক! কী অভিভাবক! পথনির্দেশক কিংবা যুদ্ধের অধিনায়ক – পুরো সত্তাজুড়ে খোদাই করে দিয়েছেন পিতৃত্ব, নেতৃত্ব আর কর্তৃত্বের অনুপম সৌন্দর্য। আল্লাহ তাআলা বলেন –
لقد من الله على المؤمنين إذ بعث فيهم رسولا من أنفسهم يثلوا عليهم عايته ويزكيهم ويعلمهم الكتب والحكمة وإن كانوا من قبل لفي ضلي مبين

অর্থঃ নিশ্চয় আল্লাহ মু'মিনদের প্রতি অত্যন্ত অনুকম্পা প্রদর্শন করেছেন, যখন তাদের নিকট তাদের নিজস্ব একজনকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, সে তাদেরকে আল্লাহর আয়াত পড়ে শুনাচ্ছে, তাদেরকে পরিশোধন করছে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত (সুন্নাহ) শিক্ষা দিচ্ছে, যদিও তারা পূর্বে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল।

দুরুদ ও সালাম সেই মহামানবের তরে, যিনি ছিলেন জগতবাসীর অন্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয়ে আলোর ফল্গুধারা। অঝোর ধারায় বর্ষিত হোক তাঁর রওজায় রহমত ও প্রশান্তির শীতল শিশির। বর্ষিত হোক তাঁর নিষ্কলুষ ও পবিত্রআত্মা পরিবারের উপর। আরো বর্ষিত হোক সৌভাগ্যের প্রতীক তাঁর সাহাবীদের উপর। কেয়ামত পর্যন্ত সত্যনিষ্ঠ অনুসারীদের উপর।

পর কথা এই যে -
আমাদের সম্মুখে দৃশ্যমান বইটি প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যাপিত জীবন হতে আহরিত কিছু দোদীপ্যমান আলোর সমাহার। যার প্রতিটি তথ্যই সীরাতবিদদের কষ্ঠিপাথরে শুদ্ধতার যাচাইয়ে উৎকর্ষিত। আমি চেষ্টা করেছি সরল বাক্যে সহজ শব্দের সেই আলোকধারার চিত্রায়ন করতে। 
জীবন একনজরে চিত্রিত হয়ে ওঠে পাঠকের অন্তরে। যেন তাঁর মহাত্ম, তাঁর অনুপম চরিত্র আলোড়ন তুলে দেয় হৃদয়-অনুভবে। ফুটে ওঠে তাঁর নেতৃত্বের কর্মধারা, কানে কানে যেন অনুরণন হতে থাকে তাঁর সুসংসবাদ ও সতর্কতার বাণী-বার্তা।

বইটি সংক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আশা করি তাতে রয়েছে তৃষ্ণার্ত আত্মার কিছু খোরাক। সংশয়বাদী বিবেকে চিন্তার শুদ্ধতার যোগান। অশান্ত হৃদয়ে শীতল প্রশান্তি। চৈতী রোদ্দুরে ক্ষয়ে যাওয়া জীবনে বসন্তের সজীবতা।

তাই আসুন! প্রিয় নবীজির জীবনজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হিরে-মুক্তোর ছোঁয়ায় নির্মল হোক আমাদের পঙ্কিল আত্মা। খুলে যাক হৃদয়ের বদ্ধ দুয়ার। জাগ্রত হোক সত্তাজুড়ে শুদ্ধতার অনুভব। কারণ একটি পরিশীলিত সমাজ ও পরিশুদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে নববী কর্মপন্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের বিকল্প নেই। দাওয়াত ও দৃঢ়তায় রাসূলের দিকনির্দেশনাই আমাদের একমাত্র পাথেয়। এজন্য প্রতিটি কাজে কুরআন ও সুন্নাহর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করে নির্ধারণ করতে হবে নিরাপদ ও সাবলীল কর্মপন্থা! আল্লাহ তাআ'লা বলেছেন –
لقد كان لكم في رسول الله أسوة حسنة لمن كان يرجوا الله واليوم الاخر وذكر الله كثيرا
অর্থঃ তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি আশা রাখে আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে। 

আহ! কী অনুপম আদর্শ ছিলেন তিনি। কী ছিল না তাঁর জীবনজুড়ে দুঃখ-কষ্ট, হাসি আনন্দ, ব্যথা-বিরহ, আশা-নিরাশা প্রতিটি গিরিপথ তাঁর পাড়ি দিতে হয়েছে। সীরাতের পাতা উল্টালে চোখে পড়বে ক্ষুধার তাড়নায় কোনদিন তিনি পেটে পাথর বেঁধেছেন। উমর ইবনুল খাত্তাব প্রিয় হাবিবের অন্দরমহলে প্রবেশ করে দেখতে পেলেন প্রিয় নবী চাটাইয়ের উপরে শুয়ে আছেন। পিঠজুড়ে দগদগে দাগ অভাবের জানান দিচ্ছে। আবার কোনদিন তিনি দান করে যাচ্ছেন হৃদয় উজাড় করে।

* সূরা আল আহযাব। আয়াত ২১।

কুরাইশ পাষাণ কাফেরদের হাতে নিষ্পেষিত হয়েছেন নির্মমভাবে। পেয়েছেন মাতৃভূমির লোকদের কাছ থেকে ঘৃণা আর অমানুষিক নির্যাতন। দাওয়াতের বাণী নিয়ে গিয়েছেন দুয়ারে দুয়ারে। তাদের সফলতা ও কল্যানকামনার তড়প নিয়ে যতবারই গিয়েছেন তারা ভেবে নিয়েছল যেন অবাধ্যতা আর দুর্ভাগ্যের পাহাড় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের উপরে। স্বার্থপরের মত তাড়িয়ে দিয়েছে মাতৃভূমির ভিটেমাটি হতে। এতকিছুর পরেও তিনি যখন বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন তখন দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা দেন –
قال لا تثريب عليكم اليوم يغفر الله لكم وهو أرحم الرحمين
অর্থাৎ, 'তিনি বললেন, 'আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনই অভিযোগ নেই, আল্লাহ তোমাদেরকে মাফ করুন! তিনি হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।”

কখনো বিষন্নতা, কখনো রাজ্যের সুখ। কখনো ধনীর উদারতা কখনো অনাহারের দু'খ।
রণাঙ্গনে মহাবীর তিনিই আবার নিরাপদ মিত্রও; অভিজ্ঞ কুটনৈতিক। তাঁর যুদ্ধজীবন পাঠে একজন সেনাপতি যেমন অর্জন করতে পারেন যুদ্ধের কলাকৌশল; জেনে নিতে পারেন কেমন ছিল রণাঙ্গনের বিক্রমতা সন্ধির বৈঠকে কূটনৈতিক প্রজ্ঞা। বিজয়ের আনন্দ - উচ্ছ্বাস। পরাজয়ে চরম দৃঢ়তা ও প্রার্থনায় ধৈর্যের খড়গ।

একজন বিচারকও পেতে পারেন অনুসরণীয় অসংখ্যা অধ্যায়। জেনে নিতে পারেন - কীভাবে তিনি ফয়সালা করতেন। অজস্র বিবাদ মিটিয়ে দিতেন চোখের ইশারায়।

একজন শিক্ষকের জন্য রয়েছে সে জীবনে অনুপম আদর্শ। মসজিদে নববীতে দ্বীন শেখানোর সেই মজলিসে বিনয়ের সে কী অনুমপম দৃষ্টান্ত। ছেয়ে যেত শীতল নিরবতা ও ভারত্বের গাম্ভীর্য।

একজন ছাত্রের রয়েছে সেখানে আদর্শের খোরাক। কী চমৎকার সেই দৃশ্য – যখন মহান রবের পাঠানো বানী জিবরীল আলাইহিসসালামের মুখ নিঃসৃত হয়ে টপ টপ করে গলে পড়ত প্রিয় নবিজীর হৃদয়-জমিনে।
• সূরা ইউসুফ। আয়াত ৯২।

একজন দুনিয়াবিমুখ সূফীর জন্যও তিনি একজন বড়পীর। যুহদ, তাকওয়ার বাস্তবতা ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য অর্জিত হতে পারে কেবল তার অনুসরণে। বিপদগ্রস্থ প্রতিটি মানুষের জন্য তিনি সান্ত্বনার পরশ। তাঁর ধৈর্য আর দৃঢ়তা শিক্ষা থেকে দা'ওয়াহর পথে অর্জিত হয় দৃঢ়প্রতিজ্ঞা। মহান প্রভুর প্রতি অগাধ বিশ্বাস। অন্তরে লালিত হতে থাকে মহাপ্রতিদান প্রাপ্তির স্বপ্ন।

সুতরাং একজন দায়ীর জন্য দাওয়ার পথে নবিজীর জীবনকর্ম এক অনন্য পাথেয়। একজন সেনাপতি, পরিবারের অভিভাবক; এমনকি প্রতিটি সাধারণ আর বিশেষ মানুষ সকলের জন্য প্রিয় হাবিবের সীরাত অনুপম আলোকবর্তিকা, প্রোজ্জ্বল দিক দিশারী।

আমার আশা – বইটি পড়া শেষ করার পরে আমাদের প্রতিটি কথার বাস্তবতা
অনুভব করতে পারবেন।

তাই আসুন শিখে নিই প্রিয় নবিজীর জীবন থেকে। সন্তানদেরকে শেখাই কীভাবে চলতে হবে প্রিয় রাসূলের দেখানো পথে।

প্রিয় পাঠক, আসুন শিরোনামের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা মুক্তোগুলো কুড়িয়ে
নিই। চলুন তবে শুরু করা যাক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার নামে৷

ভালোবাসা কাকে বলে?
ভালোবাসা অন্তহীন একটি শব্দ। চার বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত এই শব্দটির ব্যপ্তি বিশাল। পুরো জীবনজুড়ে বিস্তৃত। মানুষের জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা। ঠিক এই সূত্র ধরেই যেন মুমিনদের হৃদে অনুরণিত হয় কেবল একটাই নাম, "মুহাম্মাদ, মুহাম্মাদ"। ভালোবাসার অনুভবে আবেশিত হয়ে উচ্চারিত হয়, "তোমাকে ভালোবাসি হে নবী, তোমাকে ভালোবাসি হে রাসূল!" সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

ভালোবাসার সংঙ্গা অনেক। একেকজনের অভিধানে ভালোবাসার সূত্র একেকরকম। কেউ একটা প্রাণকে সীমাহীন ভালোবেসেও পিপাসার্ত থেকে যায়! কেউ কেউ ভালোবেসে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উৎসর্গ করে দেয় প্রেমাষ্পদের নামে। কেউ কেউ ভালোবাসাকেই জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ মনে করেন। তাই ভালোবাসার বিরাট অভিধানের পরতে লুকানো এমন সহস্র অব্যক্ত অনুভূতি বুঝতে না পেরে এর সংঙ্গা দিতে এসেও আমি ভুগছি শব্দ শূন্যতায়!

প্রিয় বন্ধু! অভিধান জ্ঞানহীন এই আমি তবুও তোমাকে বলে যাই ভালোবাসার সংঙ্গা। এসো চিনিয়ে দিই প্রকৃত ভালোবাসার পরিচয়। যে ভালোবাসা কেবল ভালোবাসতেই শেখাই! যে ভালোবাসার নেই মৃত্যু; মরণের পরেও যা অক্ষয়!

প্রিয় বন্ধু!
ভালোবাসা কাকে বলে জানো?
যে মানুষটি আমাকে না দেখেই আমার জন্য দুআ করেছেন
সে মানুষটির প্রার্থনার বিশাল আন্তরিকতাকে ভালোবাসা বলে। ঈমানহীন আমি জাহান্নামে দগ্ধ হব সে আশংকায়, আপনজনদের টিটকারি, বেদনার্ত দিল
দাওয়াতের বাণী নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন যিনি; অজস্র আঘাতের ব্যথা, রক্তঝরা শরীর
তবুও আমার কী হবে ভেবে বদদুআ না দেওয়ার মতো মহানুভব তিনি! সেই মানুষটির নিঃস্বার্থ এমন চাওয়াগুলোকে ভালোবাসা বলে।
রাত গভীরে ঘুমকে রেখে ফেলে, জায়নামাজে তপ্ত অশ্রু ঢেলে,

আমার উম্মতের কী হবে সে ভাবনায় যিনি কেঁদেছেন, অনবরত দুআ করেছেন
সেই মানুষটির প্রার্থনার অশেষ নির্মলতাকে ভালোবাসা বলে।
বন্ধু শোনো, আমাদের ব্যাপারেই আমাদের রব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলছেন,
والذين جاءو من بعدهم يقولون ربنا اغفر لنا ولإخواننا الذين سبقونا بالإيمن ولا تجعل في قلوبنا لا يتذين ءامنوا
ربنا إنك رءوف رحيم

“যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে, 'হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোনো বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু।”

হ্যাঁ বন্ধু। ঠিক যেন এই আয়াতের সাথেই একাত্ম হয়ে আমার নবী আমাদের জন্মের পূর্ব থেকেই আমাদের জন্য দুআ' করে গেছেন। উম্মতের কথা ভেবে কেঁদেছেন। তিনি যেভাবে আমাদের ভালোবেসে আমাদের জন্য আল্লাহ পাকের কাছে কেঁদেছেন; তাঁর সেই অনুভব-অনুভূতিকে যদি আমি ভালোবাসার সংঙ্গায় সঙ্গায়িত না করি,
তবে ভালোবাসা আর কাকে বলে? তিনি যে আমাদের কত ভালোবাসতেন এর প্রমাণ মেলে হযরত আনাস রাযিআল্লাহু
আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীস দ্বারা।

একদিন সাহাবাদের উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, "আমার ভাইদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছা করছে।"
সাহাবিরা বলল, "ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমরা কি আপনার ভাই নই?"
* সূরা আল-হাশর, আয়াত: ১০

আমার নবী উত্তরে বললেন, "তোমরা তো আমার সঙ্গী। আমার ভাই হলো তারা, যারা আমার ওপর ঈমান আনবে; কিন্তু আমাকে দেখবে না।"

যেই মানুষটি না দেখেই আমাদেরকে নিজের ভাই বলে সম্বোধন করেছেন, যে মানুষটি অচেনা আমাদের জন্য দুআ করে গেছেন, সেই মানুষটির অন্তরের এই বিশাল আন্তরিকতাকেই তো ভালোবাসা বলে!
তাই এসো অব্যক্ত অনুভূতির অনলে দগ্ধ যে হৃদয় সেই হৃদয়ের অনুভবটুকুকে এই ভালোবাসার ছাঁচে ঢেলে এগিয়ে যাই ভালোবাসার মানযিলে। শুধু তাঁর জন্যই ভালোবাসা এবং তাঁকেই ভালোবাসার নামই হোক - 'ভালোবাসা'!

* মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১২৭১৮

প্রেমের বহিঃপ্রকাশ

আমি কাউকে ভালোবাসি সেটা তখনই প্রমাণিত হবে, যখন আমার আচার আচরণ, আমার কাজকর্মে তার প্রতিক্রিয়া প্রস্ফুটিত হবে। মানুষের ব্যবহার তার অন্তরের প্রতিচ্ছবি। হৃদয়ের আয়না। আঁতশ কাচে মেপে যদি আমাদেরকে আমরাই জাস্টিফাই করি, তবে দেখতে পাব আমরা যে রাসূলকে ভালোবাসার দাবী করি, তা কতখানি ভিত্তিহীন! যেখানে ভালোবাসার কোনো কলিই প্রস্ফুটিত হয় না তা কী ভালোবাসা হয় কখনো?

রাসূল আমাদেরকে ভালোবেসেছেন। তাই তো আমাদের জন্য অশ্রু ফেলে কেঁদেছেন। মুনাজাতে তাঁর একমাত্র চাওয়া ছিল উম্মতের মুক্তি। তাঁর আফসোস ছিল ইয়া উম্মাতি, ইয়া উম্মাতি!
প্রিয় রাসূলকে আমরা তো তখনই সঠিকভাবে ভালোবাসতে পারব, যখন আমরা তাঁর ব্যাপারে সঠিকভাবে জানতে পারব। তাঁকে জানার জন্য সিরাত পাঠের বিকল্প নেই। সিরাত হচ্ছে নবী জীবনী। নবীজির আচার-ব্যবহার, চাল-চলন, ওঠা-বসা। রাসূলের দৈনন্দিন আমল, কথাবার্তা। সিরাত হচ্ছে সেই পদরেখা; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পথে হেঁটে গেছেন তাঁর জীবনভর।

আমরা নবিজীকে ভালোবাসার দাবী করি, অথচ অনেকেই তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিত জানি না। আমাদের সমাজে এমন অনেক ভালোবাসার দাবীদারও আছে, যারা তাদের পুরো জীবনে নবিজীর কোনো সংক্ষিপ্ত জীবনী পড়ারও সৌভাগ্য লাভ করেননি। এটি খুবই দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় !

আপনি যদি এই দলের একজন হয়ে থাকেন, তাহলে এই লেখা আপনার জন্যেই। আজ দম ধরে নিয়ে বসুন। নিজেকে ফুরসত দিন প্রিয় রাসূলকে জানার জন্য। হৃদয়ের বদ্ধ দুয়ার আজ খুলে দিন। চলুন আমরা লেখক-পাঠক এক হয়ে এই ছোট্ট বইটি পাঠ করেই না হয় ভিজে আসি প্রিয় রাসূলের নূরানী জীবনের এক পশলা বর্ষায় !

সিরাতের বইপত্র পাঠ করা কেবলমাত্র আত্মার খোরাকীই নয়; তা তো অসীম সাওয়াব লাভেরও এক বিশেষ মাধ্যম। সিরাত পাঠের মাধ্যমে সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের জীবন পরতে হেঁটে-হেঁটে চলে যাওয়া যায় আরশে মুআল্লায়! নতজানু হয়ে মেখে নেওয়া যায় ইবাদতের অনাবিল প্রশান্তি! এক জীবনে এর চেয়ে বেশি আর কি কিছু লাগে?

হ্যাঁ বন্ধু! সিরাত অধ্যায়নের আরও অনেক গুরুত্ব ও উপকারীতা রয়েছে। এসো, তন্মধ্যে কয়েকটি তোমাকে জানাই
১. ইসলামের ইতিহাস জানা যাবে।
২) রাসূলের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। ৩) সর্বোত্তম আদর্শের অনুকরণ করা যাবে।
৪) কুরআনকে অনুধাবন করা সম্ভব হবে।
৫) নবীজির জীবনই ইসলামী আন্দোলনের সর্বত্তম দৃষ্টান্ত সে
সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন হবে।
৬) সিরাত অধ্যায়নও একটি ইবাদত, সে হিসেবে সিরাত পাঠে নিছক বই-পুস্তক পাঠের মতো সময় অপচয় না হয়ে সাওয়াব হবে। ৭) সর্বপরি মুসলিম হিসেবে নিজেদের পরিচয় গঠন করতে নিজেরা উদ্বুদ্ধ হবে।

প্রিয় রাসূলের জীবনকে ঘিরেই ইসলামের ইতিহাস। তাঁর পূর্ণ জীবনটাই হচ্ছে ইসলামের ইতিহাস জানার একমাত্র উপযুক্ত মাধ্যম। তাঁর হাত ধরেই ইসলাম হাঁটি হাঁটি পা-পা করে বড় হয়েছে। ছড়িয়েছে দিক দিগন্তে। তাঁর হাত ধরে অজস্র মানুষ এসেছে রবের দিকে। পেয়েছে আলোর সন্ধান। তাইতো তাঁর জীবনীগ্রন্থ পাঠ করাটা নিছক কোনো আলোচনা নয়, কোনো খামখেয়ালীতে রচিত সাধারণ ইতিহাসও নয়; তা হচ্ছে মুসলিম জাতির ইতিহাস। দ্বীন ইসলামের ইতিহাস।

হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাযিআল্লাহু আনহুর পুত্র মুহাম্মাদ বলেন, "আমাদের পিতা সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাযিআল্লাহু আনহু আমাদেরকে রাসূলের পরিচালিত যুদ্ধ সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন। তিনি আমাদেরকে রাসূলের সিরাত পড়ানোর সময় বলতেন, এগুলো হচ্ছে তোমাদের বাপ-দাদাদের ঐতিহ্য; কাজেই এগুলো নিয়ে পড়ালেখা করো।"

আলী ইবনে হুসাইন রাযিআল্লাহু আনহু বলেছেন, "আমাদেরকে যেভাবে কুরআন শেখানো হয়েছিল ঠিক সেভাবেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীও পড়ানো হয়েছিল।"

অন্যান্য নবী-রাসূলদের জীবনকে কুরআন পাঠেই আমরা আয়ত্ব করতে পারি। কিন্তু আমাদের রাসূলের জীবনের যাপিত উপাদানগুলো অন্তঃস্থ করতে হলে আমাদেরকে ফিরে আসতে হবে সিরাত পাঠের দিকে। এ থেকেই প্রতিয়মান হয়; সিরাত পাঠ ঠিক কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যক!

তবে হ্যাঁ বন্ধু, আরেকটা কথা। শুধুমাত্র জানার নাম ভালোবাসা নয়, জানার সাথে সাথে মানতেও হবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বাঁকে বাঁকে অজস্র সুন্নাত রয়েছে। আমরা তাকে ভালোবাসি এই কথার প্রমাণ স্বরূপ আমাদের জন্য আবশ্যক হচ্ছে রাসূলের সুন্নাতগুলোকে ভালোবাসা। সেগুলোকে নিজেদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা।

আসুন দেখে নিই, আমাদের রব কী বলছেন –
قل إن كنتم تحبون الله فاتبعوني يحببكم الله
তিনি বলছেন, "(হে নবী, আপনি) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ পাক ও তোমাদেরকে ভালোবাসেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন,
"যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে ভালোবাসে সে আমাকেই ভালোবাসে, আর যে আমাকে ভালোবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।

প্রিয় বন্ধু, এসো একটি গল্প বলি। ঘটনাটির মধ্যমা স্বাক্ষী আমি। সীরাতুন্নবী ক্লাসের এক ছাত্রী একবার আমাকে বললেন, "উস্তাজা, আমি স্বপ্নে একটা ছায়াকে আসতে দেখি। মনে হয় ইনি নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কিন্তু ছায়াটা দরজা থেকেই চলে যায়। আমি দেখতে পারি না.." ।

ঘটনাটি শোনার পরে বেশ দীর্ঘ সময় চিন্তাভাবনা করে সেই ছাত্রীকে তাঁর দৈনন্দিন আমলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি। আমলসমূহ পর্যালোচনা করে তাকে বলি সুন্নাতের প্রতি যত্নশীল হতে। এরপর তিনি সুন্নাতের পাবন্দ হয়ে যান। এবং আমাকে ওয়াদা দেন অবশ্যই তিনি যথাসাধ্য সব সুন্নাত পালন করবেন।
* সূরা আলে ইমরান। আয়াতঃ ৩১
" তিরমিযী ২৬৭৮, য'ঈফুৎ তারগীব ১৭২৮।

যাইহোক। জীবনের ব্যস্ততায় আমার মগজখাতায় এই ঘটনাটির পাতায় খুব দ্রুতই পর্দা পড়ে যায়। কেটে যায় কয়েক মাস। হঠাৎ একদিন তিনি আমাকে জানালেন তিনি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখেছেন! সুবহানাল্লাহ! আল্লাহু আকবার।

এই কথা শোনার পরে আমার বুকের কোথাও একটা সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হয়েছিল। তবে সেটা ঈর্ষা নাকি রাসূলকে দেখতে না পারার আক্ষেপে; তা ঠিক বুঝতে পারিনি।

প্রিয় বন্ধু এসো, এখন থেকেই সুন্নাতের উপর যত্নবান হই। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের ভালোবাসার পথকে আঁকড়ে ধরি দৃঢ় ও মজবুত ভাবে।

হযরত ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মধ্যে খুতবা দিতে গিয়ে বলেনঃ হে লোক সকল! কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে উলঙ্গ মাথা, উলঙ্গ দেহ এবং উলঙ্গ পা অবস্থায় উঠানো হবে, যেমন তোমরা তোমাদের জন্মের দিন ছিলে। সর্বপ্রথম হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে পোশাক পরানো হবে। এরপর আমার উম্মতের মধ্য হতে কতক লোককে আনয়ন করা হবে যাদেরকে জাহান্নামের নিদর্শন হিসেবে বাম দিকে রাখা হবে। তখন আমি বলবো- এরা তো আমারই উম্মত। সেই সময় বলা হবে- তুমি জান না যে, এরা তোমার (ইন্তেকালের) পরে তোমার সুন্নাতকে পরিত্যাগ করেছিল এবং বিদআত চালু করে দিয়েছিল।

প্রিয় বন্ধু এসো, আরেকটি হাদীস শরীফ বলি। হযরত আনাস রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার সুন্নাহের প্রতি বিমুখ, সে আমার উম্মতভুক্ত নয়।

এখানে দু'টি বিষয়। একটি হলো – যে ব্যক্তি সুন্নতের ওপর আমল করতে পারে না, কিন্তু নিজেকে এ জন্য অপরাধী মনে করে। ফলে সে মনে মনে লজ্জিত থাকে। আলোচ্য হাদিসে এমন ব্যক্তির কথা বলা হয়নি।

বরং যারা নবীজির সুন্নাহ দেখতে পারে না এবং সুন্নাহের নাম শুনলে, সুন্নতি কাজ দেখলে সে খুব বাজে প্রতিক্রিয়া দেখায়, আলোচ্য হাদীস সেসব মানুষের জন্য প্রযোজ্য।
* বুখারি, হাদিস : ৪৭76

আমি এমন অনেক মানুষকেও দেখেছি যাদেরকে প্রাত্যহিক জীবনের বাঁকে বাঁকে সুন্নাতের আমলের গুরুত্ব বোঝাতে গেলেই তারা রেগে যান। ভাবখানা এমন, যেন আমি তাদেরকে নাজায়েজ এবং হারাম কোনো কাজের প্রতি দাওয়াত দিয়েছি। অথচ এই মানুষগুলোই নাট্যমঞ্চে, টিভির অনুষ্ঠানে, বিভিন্ন হারাম এবং শিরকী আয়োজনের অংশ নিতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যশীল মনে করে। 

তারা কিন্তু মুখে ঠিকই রাসূলের ভালোবাসার দাবীদার। আমরা যদি এমন মানুষ হয়ে থাকি, তবে আমাদের জন্য বড়ই আফসোস! নিজেদের আমলের দিকে তাকালে কি মনে হয় যে আমরা রাসূলকে আসলেই ভালোবাসি?

প্রিয় বন্ধু, আপনি কি বুঝতে পারছেন সুন্নাত পালন না করার ভয়াবহ পরিণতি? আপনি কি এখনো বুঝবেন না, সুন্নাত পালন করা আমাদের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ?

সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার মর্যাদা সুউচ্চ। যখন মানুষ প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহান সুন্নাতকে ছেড়ে দেবে। বিদাআতকে আপন করে নিবে, বিদাআতের উদ্ভাবনকারীদের সম্মান প্রদর্শন করবে। এমনকি আল্লাহ ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ ও নিষেধ মেনে চলা থেকে বিরত থাকবে এবং গোমরাহ লোকদের সম্মান করতে দ্বিধাবোধ করবে না। তখন মুসলিম জাতি চতুর্দিক থেকে দুর্যোগের, ফেতনা-ফাসাদ, অশান্তি ও অকল্যাণে সম্মুখীন হবে৷ এমন কঠিন মুহূর্তে বিশ্বনবীর আদর্শকে সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরার মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ তথা একশত শহীদের সাওয়াব লাভের মর্যাদা।

হাদিসে এসেছে, প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'আমার উম্মাতের মধ্যে যখন ফেতনা-ফাসাদ হবে, তখন যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে রাখবে, তাকে একশত শহীদের সাওয়াব প্রদান করা হবে।

এসো জেনে নিই সুন্নাতে যত্নশীল হলে আরও কী কী উপকার অর্জিত হবে। সুন্নাতের অনুসরণকারীদের বিশেষ যা কিছু লাভ হবে, তা হচ্ছে
১। ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ পাকের ভালোবাসা লাভের স্তরে পৌঁছে দিবে, যেই স্তরে পৌঁছলে ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার ভালোবাসা লাভ করতে সক্ষম হবে।
২। ফরজ আমলের ঘাটতি সুন্নাত দ্বারা পূরণ হবে।

৩। সুন্নাতের উপর আমল করলে বিদআত হতে রক্ষা পাওয়া যাবে। ৪। সুন্নাতের উপর আমল মানেই আল্লাহ তাআলার নিদর্শনকে সম্মান করা।

বন্ধু আমার... আমরা চাইলেই কিন্তু অনায়াসে ছোট্ট ছোট্ট সুন্নাত পালনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে সুন্নাতের আমলদ্বারা নিজের জীবনকে সাজিয়ে নিতে পারি। প্রতিদিন যদি একটা করে সুন্নাতের টাস্ক তৈরি করে সেটাকে আমলে পরিণত করতে পারি, তাহলে মাস শেষে আমাদের ঝুলিতে কি ত্রিশটি সুন্নাত যুক্ত হবে না? এসো, এই কাজটি না হয় আজ থেকে, এখন থেকেই শুরু করি। ইনশাআল্লাহ, বিইযনিল্লাহ।
আমি একটু ইচ্ছা করলেই দস্তরখানা বিছিয়ে খাবার খেতে পারি, খাবারের আগে পানি পান করে নিতে পারি, দুআ পড়ে নিতে পারি কিংবা কোনো কাজের পূর্বে দুআ পড়তে ভুলে গেলে ভুলে যাওয়ার দুআ পড়তে পারি।

আমরা চাইলেই বাথরুমে প্রবেশের সময় বাম পা আগে দিয়ে, দুআ সহ প্রবেশ কিংবা বের হতে ডান পা আগে দিয়ে দুআ পড়ে বের হতে পারি। ইস্তেঞ্জায় বেজোড় কুলুপ ব্যবহার করতে পারি।
জনৈক শায়খকে জিজ্ঞেস করা হলো - "শায়েখ, আমি ভালো কাজ কীভাবে
করব?"

শায়েখ উত্তর দিলেন, "ইচ্ছার মাধ্যমে।"
হ্যাঁ বন্ধু! যদি তোমার ইচ্ছা থাকে তুমি ভালো কাজ করবে, তুমি সুন্নাত পালন করবে, নিজের জীবনের বাঁকে বাঁকে সুন্নাতে রাসূলের বীজ বপণ করবে; নিঃসন্দেহে তার প্রথম ধাপ হবে এই কাজের নিয়্যত।
এইজন্যই তো হাদীসের ভেতর নিয়্যতকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন,
إنما الأعمال بالنيات
“সমস্ত কাজের ফলাফল নির্ভর করে নিয়্যতের উপর।
* বুখারী: ১, মুসলিম: ১৯০৭।

হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাযিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘তুমি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে (নিয়তে) যা-ই ব্যয় কর না কেন, তোমাকে তার প্রতিদান নিশ্চিতরূপে প্রদান করা হবে।

সত্যিকার অর্থে বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোন আমল গ্রহণযোগ হবে না। বুখারীতে স্পষ্ট করে বর্ণিত হয়েছে যে, নিয়তে গোলমাল থাকার কারনেই শহীদ ও আলেমদেরকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। যতই লোক দেখানো আমল সম্পন্ন হোক না কেন, নিয়তের পরিশুদ্ধি না থাকলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। প্রতিটি আমলকে খালেসভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করতে হবে।

কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে এই বিষয়ে নির্দেশনা আছে। মূলত ইবাদতে একনিষ্ঠতা আনয়ন করাই নিয়ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার মূল কারণ। যেমন পবিত্র কুরআনের ভেতরই আল্লাহ পাক বলছেন
وما أمروا إلا ليعبدوا الله مخلصين له الدين حنفاء
আর তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে
একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে। 

নিয়তের গুরুত্ব সম্পর্কে আরো একটি প্রাসঙ্গিক হাদীস রয়েছে। আবু হুরায়রা রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল বলেছেন, "নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তোমাদের চেহারার রূপ-সৌন্দর্য ও ধন-সম্পদের প্রাচুর্যের দিকে লক্ষ্য করবেন না। বরং তিনি তোমাদের অন্তরের নিয়ত ও আমল দেখবেন। ১২
বর্তমান সময়ে আমরা মুসলমানরা নিয়ত শব্দটিকে একেবারে নগন্য বিষয় বানিয়ে নিয়েছি। অথচ নিয়তের পরিশুদ্ধতা এবং সুন্নাতের পাবন্দী গোটা জাগতিক আমলগুলোকে বিশুদ্ধ ইবাদতে রূপান্তরিত করে দেবে। কোন মানুষই নিয়ত ব্যতীত কোন কর্ম করতে পারে না। 

যে কোন একটি নিয়তকে ধারণ করে তাকে প্রত্যেকটি কাজ সম্পন্ন করতে হয়। তাই এসো বন্ধু.. আজ থেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে,
মুসলিম ২৫/১ হাঃ ১৬২৮, আহমাদ ১৫৪৬, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৫৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৫৪
* সূরা বায়্যিনাহ: ৫
১২ মুসলিম : ৪৬৫৭

রাসূলের ভালোবাসাকে পুঁজি করে নিয়ে নিজেদের নিয়্যতের প্রতি যত্নশীল হই। এই মুহূর্তেই নিয়ত করে ফেলি "আজীবন সুন্নাতের উপর আমল করে যাব ইনশাআল্লাহ।"

শোনো বন্ধু, জীবনে চলতে-ফিরতে আমরা কত কিছুই বলে থাকি। ভালো-মন্দ সব কিছুই উচ্চারিত হয় আমাদের মুখে। অথচ আমরা একটু সচেতন হয়ে কাজ করলেই অর্জিত হয় হাজারো সওয়াব। স্থান-কাল বুঝে কয়েকটি শব্দ উচ্চারণেই হাসিল হয় অমূল্য সম্পদ। নিচে এমন কিছু সুন্নাতের কথা তোমায় বলছি, যা দু' একটি শব্দ বলেই আদায় করা যায়।

১. ভালো কিছু খাওয়া বা পান করা শেষে, কোনো শুভ সংবাদ শোনা হলে, কেউ
‘কেমন আছো' জিজ্ঞেস করলে- তার জবাবে ‘আলহামদুলিল্লাহ' বলা সুন্নাত।”
২. ভালো কিছু খাওয়া বা পান করার সময়, কোনো কিছু লেখা বা পড়ার সময়, কোনো কাজ শুরু করার সময় 'বিসমিল্লাহ' বলে শুরু করা সুন্নাত। 

৩. কারো হাঁচি আসলে 'আলহামদুলিল্লাহি আলা কুল্লি হাল' বলা সুন্নাত। ১২
৪. আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ব বা বড়ত্বের কোনো কৃতিত্ব দেখলে কিংবা শুনলে
‘আল্লাহু আকবার' বলা সুন্নাত।

৫. স্বাভাবিকের মধ্যে কোনো ব্যতিক্রম দেখলে কিংবা আশ্চর্য ধরনের কোনো কথা শুনলে 'সুবহানাল্লাহ' বলা সুন্নাত।”
৬. কোনো হাঁচি দাতা ‘আলহামদুলিল্লাহ' বলতে শুনলে- ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ' বলা সুন্নাত।১৮
১০ ইবনে মাজাহ : ৩৮০৫
* বুখারি : ৫৩৭৬
১৫ তিরমিজি : ২৭৪১ ১৬ বুখারি : ৬২১৮
১৭ বুখারি : ৬২১৮
১৮ বুখারি : ৬২২৪

৭. ভালো যে কোনো কিছু বেশি বা ব্যতিক্রম দেখলে ‘মাশাআল্লাহ' বলা সুন্নাত।১৯
৮. ভবিষ্যতে কোনো কিছু করার ইচ্ছা করলে ‘ইনশাআল্লাহ' বলা সুন্নাত।২০
৯. কোনো বিজয় লাভ করলে কিংবা বিজয় লাভের আশায় শ্লোগান দিলে ‘আল্লাহু আকবার' বলা সুন্নাত।”
১০. কোনো বাজে কথা শুনলে ‘নাউজুবিল্লাহ' বলা সুন্নাত।২
১১. কোনো বিপদের কথা শুনলে কিংবা কোনো খারাপ বা অশুভ সংবাদ শুনলে, কোনো কিছু হারিয়ে গেলে, কোনো কিছু চুরি হয়ে গেলে, কোনো কষ্ট পেলে “ইন্নালিল্লাহ' বলা সুন্নাত। ২৩
১২. কেউ কিছু দিলে কিংবা কারো মাধ্যমে কোনো কাজ হলে তার বদলে ‘জাযাকাল্লাহু খাইরান' বলা সুন্নাত।
১৩. নিশ্চিতভাবে না জেনে কোনো বিষয়ে কিছু বললে, কথা শেষে “ওয়াল্লাহু
আ'লাম' বলা সুন্নাত।
আমার প্রিয় বন্ধু, কাল কিয়ামতের কঠিন দিনে তুমি কি চাও আরশের নিচে স্থান পেতে? তুমি কি চাও রোদেলা দিনে ধূপে না পুড়ে এক টুকরো নির্মল আশ্রয়? তবে শোনো; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিন ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আল্লাহ পাকের আরশের নিচে স্থান পাবে।
১. যে ব্যক্তি বিপদগ্রস্থের বিপদ দূর করবে। ২. যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে জীবিত করবে।
১৯ মুসলিম : ৩৫০৮
২০ আল কাহাফ : ২৩-২৪
২১ বুখারি : ৬১০
২২ বুখারি : ৬৩৬২ ২৩ মুসলিম : ২১২৬
২৪ বুখারি : ৩৩৬
২৫ বুখারি : ৫৫৭০

৩. যে অধিকহারে আমার উপর দুরূদ পাঠ করবে। ২৬
আমরা চাইলেই নিয়মিত অজস্র এমন কাজ করতে পারি, যা সুন্নাত। যা আমাদের জন্য নবিজীকে দেখার পথ সুগম করে দেবে। শুধু মুখে মুখে নবী তোমায় ভালোবাসি না বলে, কাজেও কিছুটা সুন্নাত আমরা কি পালন করে নিজের ভালোবাসার প্রকাশ করতে পারি না?

মানুষ বলে, ভালোবাসা লুকানো যায় না; আচরণের ফাঁকফোকর দিয়ে সেটা ঠিকই প্রকাশিত হয়ে যায়। এছাড়াও ভালোবাসা শুধু মুখে মুখে প্রকাশ করার নাম নয়, ভালোবাসার এক নামই হচ্ছে বাস্তবে এর প্রমাণ দেওয়া। আমার কাজকর্ম যদি ভালোবাসা প্রকাশই না করে তবে আমি কেমন ভালোবাসি?
বিরহবিধুর অন্তর মোর পুড়ে পুড়ে ছারখার; কতজন পেল ঠিকই তাঁর দেখা, আমার ইন্তেজার! তবু আশা রাখি একদিন আমি দেখব যে তাঁর মুখ; মুহাম্মাদের প্রেমগাঁথা জপে খুঁজে ফিরি আমি সুখ।

শোনো বন্ধু, প্রেমের অপর নাম নাকি অপেক্ষা। তাই সুন্নাতের প্রতি যত্নশীল হবার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশও ঘটাতে পারি, আর তাঁকে দেখার আশায়, অপেক্ষায় বুক বেধে বেধে আমল দীর্ঘদিন চালু রেখে অপেক্ষা করে যেতে পারি! বলা তো যায় না, আম্মিজান আমিনার চাঁন্দ করে আমাদের ঘরেও রৌশ্মী ছড়িয়ে যায়!
২৬ আল কাওলুল বাদী লিস সাখাভী: ২৬৩৷

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ