১৭৫৭ সালে অপরিনামদর্শী সিরাজউদ্দৌলার পতনের আগ পর্যন্ত সুবা বাংলা ছিল গোটা দুনিয়ার মধ্যে ঐশ্বর্যশালী একটি দেশ। তখনকার অনেক ইউরোপিয়রা বলেছেন, বাংলার মানুষের প্লেটে কম করেও তিন ধরনের পদ বা খাবার থাকত। ঘি, মাখন খাওয়া তাদের জন্য সাধারণ বিষয় ছিল। তাদের গায়ে যে পোষাক ছিল তা ইউরোপিয়ানদের কাছে ভাবনারও অতীত। বাংলার পন্য নিয়ে বাংলার বণিকরা তখন পূর্বদেশ মানে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত পৌছে যেতো।
নবাবের পতনের পর তিন দফা নতুন নবাব প্রতিস্থাপনের পর মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও ওড়িশার খাজনা উঠানোর বিষয়টি মাত্র লাখ দেড়েক রূপিতে কিনে নেন রবার্ট ক্লাইভ। এরপর রবার্ট ক্লাইভ হিসাব করে দেখান, দেড় লাখ রূপি দেবার পরও কোম্পানির প্রায় ১৬ লাখ রূপি। বাস্তবে সেটি কোটি রূপিতে ছাড়িয়ে যায়।
তো, এরপর থেকে ফসলে, পন্য উদ্বৃত্ত একটি জনপদ স্রেফ শশ্মান হয়ে যায়। সব থেকে বেশি সংকটে পড়ে ঢাকা। একটা বাণিজ্যিক শহর গোরস্তানে পরিণত হয় ব্রিটিশ অত্যাচারে। কোম্পানির হাতে রাজস্ব উত্তোলনের দায়িত্ব থাকায় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব উত্তোলন শুরু হয়। বাংলা ১১৭৬ সাল আর ১৭৭০ ইংরেজি। সিরাজের পতনের মাত্র ১৩ বছরের মাথায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। সোনার বাংলা গোরস্থানে পরিণত হয়। এই দুর্ভিক্ষে ১ কোটি লোক মারা যায়। এটা দুনিয়ার নিকৃষ্টতম দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের কারণ ফসল উৎপাদন কম নয়, দুর্ভিক্ষের কারণ সে বছর মাত্রাতিরিক্ত খাজনা আদায়। যে বছর দুর্ভিক্ষ হলো তার আগের বছর আদায়কৃত রাজস্ব ছিল দেড় কোটি রূপি। আর যে বছর দুর্ভিক্ষ হলো সে বছর আগের বছরের তুলনায় ৫ লাখ ২২ হাজার রূপি বেশি আদায় হয়েছিল।
ঢাকার মসলিনের কদর ছিল আকাশ ছোঁয়া। ব্রিটেন থেকে কোম্পানি কলের তৈরি কাপড় আনলেও সেটা এখানে চলত না। তারপর তারা আমাদের তাঁতীতের হাতের আঙ্গুল পর্যন্ত কেটে দেয় যাতে তারা মসলিন বুনতে না পারে।
গোটা মুঘল আমলে সুবা বাংলা ১৯টি, পরে ৩৪টি ছোট ছোট নবাব ও রাজাদের অধীনে শাসন হয়েছে। সেই শাসনের বেশিরভাগ সময় মুঘল শাসনের বিষয়টি অনেক আলগা ছিল। বাংলা মুঘল শাসনের অধীনে ছিল ২৩০ বছর। এই ২৩০ বছরে বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়নি। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশিম হেরে যাবার পর দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানী কিনে নেয় কোম্পানি। এরপর মাত্র ৬ বছরের মাথায় ১৭৭০ সালে বা বাংলা ১১৭৬ সনে দুর্ভিক্ষ হয় যাতে মারা যায় ১ কোটি মানুষ। এটা নির্মম, ভয়াবহ উপনিবেশিক শোষনের ফল।
কোম্পানির শাসন ও ব্রিটেনের শাসনের মধ্যে কত লোককে তারা জোরপূর্ব দাস বানিয়েছে সেই হিসাব নতুন করে আমাদের নেয়া দরকার।
১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়ের দিকে যে দুর্ভিক্ষ হয় তাতে বাংলার ৩০ লক্ষ লোক না খেয়ে মারা যায়। এই দুর্ভিক্ষ কিন্তু ফসল উৎপাদন কম হয়েছিল সে কারণে না,বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলা থেকে সব খাদ্য শস্য ব্রিটেনে নিয়ে মজুদ করা হচ্ছিল। যুদ্ধে যেখানে মাত্র ৪০ হাজার ব্রিটিশ সৈন্য লড়ছিল সেখানে ভারতীয় সৈন্য ছিল প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার। ভারতীয়রা মরেছেও যুদ্ধের ময়দানে অকাতরে।
দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত বেজে উঠার আগে বিষয়টি তৎকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে জানানো হয়েছিল, তখন রাজা ছিলেন ষষ্ট জর্জ, মানে দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাবা। চার্চিল নিকৃষ্ট উত্তর দিয়েছিল।
একটা সোনার দেশকে মৃতপুরি বানালো যে ব্রিটেন, ব্রিটেন উপনিবেশবাদ, তারই প্রতিকী চিহ্ন বহন করতেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
দ্বিতীয় এলিজাবেথ মারা গেছেন। পরিণত বয়সেই মারা গেছেন। যে কোনো মৃত্যুই বেদনাদায়ক। কিন্তু রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে পূর্ববঙ্গের মানুষের শোকটা তার রক্তের সাথে বেঈমানি। বাহাদুর শাহ পার্ক নামে ঢাকায় একটা পার্ক আছে। ওখানে ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতাকার্মী বিপ্লবীদের লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।সিরাজউদ্দৌলার লাশ শহরে টেনে হিঁচড়ে নেয়া হয়েছিল।
আমি ইতিহাসের ছাত্র। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ডকুমেন্ট নাড়াচাড়া করলে অপ্রকৃস্থ হয়ে যাই। ব্রিটিশ শোষণ থেকে মুক্তির জন্য অকাতরে জীবন দিয়েছেন তরুন যুব শ্রমিক কৃষক। সেই বিপ্লবীদের বড় অংশ বাংলাদেশের। আমাদের পূর্বপুরুষ তাদের জীবন বাজি রেখে,ভয়াবহ ইন্টারোগেশনের সামনে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। আর আমরা আজ সেই ঔপনিবেশিক শোষনের চিহ্নের জন্য কাঁদছি। কী ভয়াবহ! কি বিশ্বাসঘাতকতা।
আন্দামানের জেলগুলোতে থাকা আমাদের বিপ্লবীদের দীর্ঘশ্বাস বাংলাদেশের আকাশে মেঘ হয়ে আসুক। এই কেতাদুরস্ত ফ্যাশনাবেল প্রজন্ম তার রক্ত দিয়ে পান করুক স্কচ।
তুমি বিদায় নিলেও ইতিহাস রয়ে যায় ।
(একজন ইতিহাসবিদের বিশ্লেষণ থেকে সংগৃহিত )
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....