আজ বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের জন্য খুবই বিশেষ একটা দিন। আজ অপুর জন্মদিন। অপুকে চেনেন তো? অপূর্ব রায়। পথের পাঁচালী,অপরাজিতের সেই ছেলেটা। প্রকৃতির সৌন্দর্যকে যে খুঁটিয়ে দেখতে পারতো,গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারতো সামান্য একটা বিষাক্ত ফুলের সৌন্দর্য্যও। দারিদ্র্য যাকে অমলিন করতে পারেনি হাজার কষাঘাতেও।
অনেকেই হয়তো জানেন না, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় স্বয়ং ছিলেন অপূর্ব রায়। বিভূতি প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে পথের পাঁচালী আর অপরাজিত লিখেছেন যা ছিলো তার নিজের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। সেখানে অপু ছিলেন তিনি নিজেই। অপর্ণা হয়েছিলো তার ক্ষনজন্মা স্ত্রী গৌরী। তাদের একবছরের ছোট্ট সংসারের সবটাই অপরাজিত উপন্যাসে তুলে ধরেছিলেন তিনি।
শুধু এই দুইটাই কেন? ওনার সিংহভাগ উপন্যাসই ওনার বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার হুবহু কপি পেস্ট। জীবনের ছোটবড় কোন অভিজ্ঞতাকেই তিনি হারিয়ে যেতে দেননি, হারিয়ে দিতে দেননি তার সাথে পরিচয় হওয়া অদ্ভুত চরিত্রদেরও। ওনার আরেকটা বিখ্যাত উপন্যাস আদর্শ হিন্দু হোটেলের হাজারি ঠাকুরও ছিলেন একই নামে একজন বাস্তব চরিত্র। তারানাথ তান্ত্রিক নামক তার সৃষ্টি জনপ্রিয় চরিত্রটি খোদ তার দ্বিতীয়পক্ষের শ্বশুরমশাই।
বিভূতি আমার জানা সবচেয়ে নরম হৃদয় লেখক ছিলেন। এতটা নরম হৃদয় খুব কম মানুষেরই হতে পারে। দয়ালু মানুষ মাত্রই নরম তা কিন্তু নয়,ওরা জোর গলায় কথা বলতে পারে। কিন্তু বিভূতিভূষণ তা পারতেন না। যখন তার উপন্যাসের কেউ সমালোচনা করতো উনি মাথা নিচু করে গ্রহন করতেন আবার যখন কেউ প্রশংসা করতো শিশুদের মতো খুশী হয়ে যেতেন,দিনলিপিতে লিখে রাখতেন। যেমনটা করতো অপুও।
পত্রিকায় যখন তার উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে বের হচ্ছে জাতপাত তখন তুঙ্গে। অনেকে অনেক ব্যাপারে প্রতিবাদ করে চিঠি দিয়েছে,উনি সাথে সাথে সেই অংশ বাদ দিয়ে বিনয়ের সাথে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন লিখিতভাবে। যেখানে তার দোষ নেই সেখানেও করেছেন। কখনো কোনো ঝামেলায় যাননি।
রবীন্দ্রনাথ ছিলো বিভূতির কল্পলোকের দেবতা। রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা ছাড়া নিজের লেখা অসম্পূর্ণ মনে হতো তাই তার উপন্যাসের কপি রবীন্দ্রনাথকে নিজেই পাঠিয়েছিলেন চিঠিসমেত। রবীন্দ্রনাথ তার লেখার প্রশংসা করেছেন,তাকে ডেকে পাঠিয়ে আলাপও করেছেন,নিজের নতুন নাটক পড়ে শুনিয়ে বিভূতিভূষণের মতামতও নিয়েছেন তিনি।
প্রশংসা আরো অনেকেই করেছেন। নীরদ চৌধুরী বলেছেন, "বাংলা ভাষায় দশটি সেরা উপন্যাসের তালিকা করতে দিলে একটি হবে পথের পাঁচালী,এমনকি যদি পাঁচটি সেরা উপন্যাসের তালিকা করতে বলা হয় সেখানেও পথের পাঁচালীকে বাদ দেবার উপায় নেই।"
মজার ব্যাপার,সেই সময় থেকে প্রায় একশ বছর পার হয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে যুক্ত হয়েছে অগণিত সেরা সেরা উপন্যাস, কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেরা পাঁচটি উপন্যাসের তালিকা করতে দিলে পথের পাঁচালী অবশ্যই তার মধ্যে থাকবে। পথের পাঁচালীর মত উপন্যাস কেউ দ্বিতীয়টি লিখতে পারেনি,পারবেও না।
বিভূতি এক ভিন্ন রুপে পৃথিবীকে দেখেছেন। তিনি অভাব জিনিসটাকে রীতিমত নগ্ন করে উপন্যাসে তুলে ধরেছেন কিন্তু গ্রামবাংলার মানুষের আতিথেয়তা,যত্নের ক্রুটি সম্পর্কে কোথাও আভাস রাখেননি। তার গল্পের চরিত্ররা সাতদিন না খেয়েও থেকেছে কিন্তু কোন প্রতিবেশীর কাছে ধার চাইতে গেলে সেই প্রতিবেশী তাকে ফেরায়নি, কোন বাড়ির দরজায় অচেনা আগুন্তক এসে দাঁড়ালে গৃহলক্ষ্মী তাকে না খাইয়ে তাড়িয়ে দেননি। কালকের নিশ্চয়তা যার নেই সেও তার পকেটের দুটি পয়সার একটি দিয়েছে কোন অভাবী বন্ধুকে। মানুষের নিষ্ঠুর দিক গোপন রেখে মানবতার প্রচার করে গেছেন বিভূতিভূষন।
জনপ্রিয় হবার পরেও এবং মনের চোখ দিয়ে প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য নিংড়ে নেবার এত ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও তিনি আফ্রিকায় বা জাহাজে জাহাজে শুধু ঘুরতে যেতেই চেয়েছেন কিন্তু স্থায়ী হতে চেয়েছেন নিজ গন্ডগ্রাম পিতৃভূমিতেই,কারণ ওখানকার প্রকৃতি তার নিজস্ব,ঐ তার শিকড়। এতটাই সাধারণ ছিলেন তিনি সারাজীবন।
নারীদেরকে এক অন্যরকম সম্মান দিয়ে গেছেন বিভূতি তার উপন্যাসে। তার চোখে সব নারীই মা। নারীর এই মাতৃরুপ উনি এমনকি নিজের স্ত্রীর মধ্যেও দেখেছেন, ভালোবাসার মানুষের মধ্যেও দেখেছেন। যাদের কাছেই মমতা পেয়েছেন তারাই তার মাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। প্রথম জীবনে গৌরীকে বিয়ে করেছিলেন বিভূতি। মাত্র এক বছরের সংসারে পড়াশোনার জন্য অর্ধেকের বেশী সময় থেকেছেন কলকাতায়। শ্বাশুড়ির অসুখের খবর পেয়ে শ্বশুরবাড়িতে ছুটে গিয়ে দেখেন পাশাপাশি তার স্ত্রীর চিতা জ্বলছে। এই ঘটনায় অনেক বড় আঘাত তিনি পেয়েছিলেন তা বলাই বাহুল্য। গৌরী দেবী মারা যান ১৯১৮ সালে। ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ে বিভূতি দ্বিতীয় বিয়ে করেননি।
প্রেম এসেছিলো,তাও ১৯৩৪ সালের পর। সুপ্রভা ও খুকু নামের দুই অনুরাগীর সংস্পর্শে এলেও তাদের হারিয়েছেন দ্রুতই। সুপ্রভা স্বল্প সময়ের জন্য খুব ভালো বন্ধু ও ভক্ত হয়েছিলো তার ঠিক যেমন অপুর ছিলো লীলা, কিন্তু খুকুর প্রতি তিনি সত্যিকার দুর্বল ছিলেন, তার বিয়ে দিয়েছেন নিজ খরচে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে।
তারপর দ্বিতীয় বিয়ে করেন ১৯৪০ সালে। সেই সংসার করেছেন মাত্র দশ বছর, তারপর মারা যান। যে মানুষ জীবনের এতটা সময় একা কাটিয়েছেন, কোন নারীর স্পর্শ না পেয়েও কি পরম মমতায় তার উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলোর মনে ঢেলে দিয়েছেন দয়া,আবেগ, ভালোবাসা ভাবতেই অবাক লাগে।
বিভূতির প্রতিটা উপন্যাস আমার মনে আলাদা ভালোলাগার সৃষ্টি করে। আরণ্যকের মতো এত প্রকৃতিপ্রেম, অনুবর্তন,অশনি সংকেতের মতো দারিদ্র্যতার এমন নিষ্ঠুর বাস্তব রুপ, আদর্শ হিন্দু হোটেলের মত চমৎকার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প যেমন লিখেছেন ঠিক তেমনই লিখেছেন বিপিনের সংসার,দম্পতি,অথৈ জলের মতো মানব মনের জটিল খেলার গল্প। শুধুমাত্র বই পড়ে আর তথ্য সংগ্রহ করে আফ্রিকা না গিয়েও সেখানকার খুঁটিনাটি বর্ণনাসহ লিখেছেন চাঁদের পাহাড়। দুঃখ একটাই,যে মানুষটা প্রশংসা শুনতে এত ভালোবাসতেন,প্রশংসায় উৎসাহ পেতেন লেখার সেই মানুষটা দুই বাংলায় তার এই বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে যেতে পারেননি। প্রশংসা জীবদ্দশাতে অবশ্যই পেয়েছেন, কিন্তু আরো যা পেয়েছেন সবটাই জেনে যাওয়া তার প্রাপ্য ছিলো।
শুভ জন্মদিন বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়।
Credit : Jannatul Firdous
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....