- বাংলাদেশ রাজনীতির ৫০ বছর
- লেখক : ড. তারেক শামসুর রেহমান
- প্রকাশনী : শোভা প্রকাশ
- বিষয় : দেশীয় রাজনীতি
- কভার : হার্ড কভার, সংস্করণ : 1st Published, 2021
- আইএসবিএন : 9789849473176, ভাষা : বাংলা
বাংলাদেশ পঞ্চাশ বছরে পা দিয়েছে। একটি রাষ্ট্রের জন্য পঞ্চাশ বছর আশাব্যঞ্জক। এই পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি একেবারে কম নয়। বাংলাদেশ রাজনীতির পঞ্চাশ বছর গ্রন্থে আমরা বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছে, সে ব্যাপারে আলোকপাত করেছি। রাজনীতি, অর্থনীতি, উন্নয়ন, বাণিজ্য, কৃষি, নারী, বৈদেশিক নীতি, সংসদীয় রাজনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে যেসব অগ্রগতি হয়েছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিটি প্রবন্ধ বাংলাদেশের ৫০ বছরের অগ্রগতির আলোকে রচিত হয়েছে।
বাংলাদেশ রাজনীতির ৫০ বছর মূলত একটি সংকলিত গ্রন্থ এবং বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় একাডেমিশিয়ানরা প্রবন্ধগুলো লিখেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন। কোথাও কোথাও ভবিষ্যৎ রূপরেখাও তারা তুলে ধরেছেন। সামগ্রিক বিচার গ্রন্থটিতে বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র এতে পাওয়া যাবে। এটি একটি একাডেমিক গ্রন্থও বটে। যারা বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি তথা সমাজনীতি নিয়ে ভাবেন, তাদের চিন্তার খোরাক যোগাবে এই গ্রন্থটি। রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবেও এটি গবেষকদের অনেক সাহায্য করবে।
প্রবন্ধগুলো পাঠ করে বিগত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি সম্পর্কে যেমনি একটি ধারণা পাওয়া যাবে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের আগামি দিনগুলো কোনদিকে যাবে, সে সম্পর্কে একটি ধারণা পেতে আমাদের সাহায্য করবে। গ্রন্থটি পাঠ করে শিক্ষা, রাজনীতি ও নীতি প্রণায়নের সাথে যারা জড়িত, তারা সবাই উপকৃত হবেন।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট, ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি ও বিকাশমান মধ্যবিত্ত
বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে গত কয়েক বছরের সংঘটিত ঘটনাবলি ও প্রবণতা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে দুটি বড়ো ধরনের পরিবর্তন ঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ষ্ট বা গণতন্ত্রের উলটো যাত্রা আর অন্যটি হচ্ছে রাজনীতি ও সমাজে ধর্মের বৃদ্ধি। এই ঘটনাবলির প্রেক্ষাপট হচ্ছে বাংলাদেশের গত কয়েক দশকের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, যা দেশে একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশে সাহায্য করে থাকে। অতীতে একথা তত্ত্বগতভাবে এবং বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা হতো যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মধ্যবিত্তের বিকাশ একাদিক্রমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে ও সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের রাজনৈতিক আবেদন হ্রাস করে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কি তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের কটি দিক পর্যবেক্ষণ করে এই নিবন্ধে আগামী দিনের পথরেখার বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
এই বিষয়ে গবেষণা ও আলোচনার তাগিদ দেওয়া এই লেখার প্রধান লক্ষ্য, যা বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক চালচিত্র বোঝার জন্য জরুরি, নীতিনির্ধারকদের এবং সমাজ পরিবর্তনে আকাঙ্ক্ষীদের জন্যও এ ধরনের আলোচনা সহায়ক। এই আলোচনা একদিকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তে সাহায্য করবে বলে আশা করি, তেমনি এই সব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অমূহের জন্যও এগুলোর দ্যোতনা (ইমপ্লিকেশন) রয়েছে।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট নতুন নয় এই অর্থে যে স্বাধীনতার পর থেকেই দেশটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে স্থায়ী রূপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৯০ সালের পর এ অবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রেও প্রথম দেড় দশকে সাফল্যের মাত্রা আশাব্যঞ্জক ছিল না। ২০০৬ সালে রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে অপ্রত্যক্ষ সেনাশাসনের সূচনায় অনেকেই এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেন যে বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে ফিরে যাবে।
যাঁরা ঘটনাবলিকে দীর্ঘ মেয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখেন, তাঁদের এই আশঙ্কার কারণ কেবল বাংলাদেশের ইতিহাসই ছিল না, ছিল বাংলাদেশের বাইরের অভিজ্ঞতাও। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন যে-কোনো দেশে ভঙ্গুর গণতন্ত্র থাকলে তা দীর্ঘ মেয়াদে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। 'ভঙ্গুর গণতন্ত্র' থেকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থানের আশঙ্কাই বেশি। সেই প্রেক্ষাপটে এবং বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই রকম মনে করা হতে থাকে যে সামরিক কর্তৃত্ববাদের পথেই দেশটি অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু অচিরেই এটা বোঝা যায় বাংলাদেশে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না।
২০০৮ সালের শেষে একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে বেসামরিক নির্বাচিত সরকার তৈরি হয়। ধরে নেওয়া হয় যে বাংলাদেশ কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু সংবিধানের পরিবর্তন এবং ক্ষমতাসীন দলের আচরণ ভিন্ন রকম ইঙ্গিত দিতে থাকে। ২০১৪ সালে প্রায় সব বিরোধী দলের বর্জন সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন দল এককভাবেই নির্বাচন সম্পন্ন করে, যার ফলে সংসদে বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্বই থাকেনি (নির্বাচনের আগের ও নির্বাচনের সময়কার রাজনৈতিক অবস্থার জন্য দেখুন, রীয়াজ, ২০১৪)। ওই নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দল এমন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বা মর্মবস্তুর দিক থেকে গণতান্ত্রিক বলে বিবেচিত হবার কারণ নেই। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা লাভ করে যাকে বলা যায় নির্বাচনি স্বৈরতন্ত্র বা ইলেকটোরাল অথরিটারিয়ানিজম, যা দৃশ্যত গণতান্ত্রিক কিন্তু কার্যত স্বৈরতন্ত্র। বাংলাদেশের ইতিহাস বিবেচনা করলে দেখা যায় যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল বাণীটি ছিল গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তিনটি ভিত্তি মানবিক মর্যাদা, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারতার সারবস্তু হচ্ছে সব নাগরিকের সমতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের নিশ্চয়তা। এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্র শুধু প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভেই ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, এখন প্রশ্ন উঠছে কয়েক দফা কর্তৃত্ববাদী শাসনের অভিজ্ঞতার পরও দেশটি আবার সেই পথেই যাত্রা শুরু করেছে কি না।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি গবেষকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এবং ২০২০ সালে এসে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিবিষয়ক আলোচনায়, তা গণমাধ্যমেই হোক কি নীতিনির্ধারক পর্যায়েই হোক, বারবার আলোচিত হচ্ছে তা হলো সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে 'সেক্যুলারিজম'কে (যাকে সংবিধানের বাংলা ভাষ্যে “ধর্মনিরপেক্ষতা” বলা হয়) রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে ঘোষণা এবং ধর্মভিত্তিক সংগঠন তৈরির ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে এই ধারণাই পাওয়া গিয়েছিল যে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে এবং সেই নিষ্পত্তি হচ্ছে: এই দুইয়ের মধ্যে দেওয়াল তুলে দেওয়া গেছে, রাজনীতি ও সমাজে ধর্মের প্রত্যক্ষ প্রভাবের অবসান করা গেছে। কিন্তু সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকে ক্রমান্বয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অপসারিত হয়, রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসাবে সেক্যুলারিজমের / ধর্মনিরপেক্ষতার অবসান হয়, রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলের আবির্ভাব ঘটে, রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ইসলাম সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং দল-নির্বিশেষে ধর্মীয় প্রতীক ও রেটরিক ব্যবহৃত হতে থাকে। নব্বইয়ের দশকে কেবল যে রাজনীতিতেই ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পায় তা নয়, সমাজে ও দৈনন্দিন জীবনাচরণে ধর্মের ব্যাপক এবং দৃষ্টিগ্রাহ্য উপস্থিতি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। ইসলামপন্থি দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন ধরনের ইসলামপন্থি দলের সংস্কারবাদী, রক্ষণশীল, উগ্রপন্থি, সহিংস চরমপন্থি—বিকাশ লাভ করে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী ‘ধর্মনিরপেক্ষতা'কে সংবিধানে পুনঃস্থাপন করা হলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থেকেছে এবং ধর্মের প্রশ্নে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার কোনো লক্ষণই আর উপস্থিত নেই। এর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ধরনের ইসলামপন্থি জঙ্গি সংগঠনের উপস্থিতি ঘটতে শুরু করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সমাজ জীবনে ইসলামের উপস্থিতি। বাংলাদেশের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে যে স্থানীয় ও সমন্বয়বাদী (সিনক্রেটিক) ইসলামের প্রাধান্য ও প্রভাব ছিল বলে ধারণা করা হতো, তার পরিবর্তে একটি আক্ষরিক (লিটারালিস্ট) ও বৈশ্বিক ব্যাখ্যার ইসলামেরই প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এবং তা ক্রমবর্ধমান।
এই দুই প্রপঞ্চের উপস্থিতির প্রেক্ষাপট হচ্ছে একটি পরিবর্তনশীল দেশ ও রাষ্ট্র। উনিশশ একাত্তর সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের উদ্ভবের পর প্রায় ৫০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজে পরিবর্তন ঘটেছে। রাষ্ট্র গঠন একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া, ফলে পরিবর্তন এখনো অব্যাহত আছে এবং তা অস্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশের গত কয়েক দশকের পরিবর্তনের কথা উঠলেই যেটি কমবেশি সবাই প্রথমেই বলেন তা হচ্ছে এর অর্থনীতির পরিবর্তন একসময় যে দেশটি 'তলাবিহীন ঝুড়ি'তে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল এটি একটি 'উন্নয়নের পরীক্ষাগার', সেই দেশটি গত কয়েক বছরে অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনার দেশ বলে বিবেচিত হয়। ২০২০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত এই সম্ভাবনার দিকটিই সরকারি ও বেসরকারিভাবে বলা হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপার বলেছিল ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ পৃথিবীর ২৮তম বৃহৎ এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হবে। মোট অর্থনীতির আকার দাঁড়াবে ৬২৮ বিলিয়ন ডলার থেকে যথাক্রমে ১৩২৪ বিলিয়ন ডলার এবং ৩০৬৪ বিলিয়ন ডলার (জামাল, ২০১৬)।
আমার আলোচনার পটভূমি হচ্ছে এই তিনটি দিক বড়ো আকারের বা সামষ্টিক অর্থনৈতিক সাফল্য, সামাজিক ক্ষেত্রে ধর্ম, অর্থাৎ ইসলামি ভাবধারার ব্যাপক বিস্তার এবং রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্রমাগত সংকোচন ও এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের উদ্ভব। এই প্রবন্ধে আমার লক্ষ্য হচ্ছে, এই তিন দিকের মধ্যকার সম্পর্কের কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা এবং প্রশ্ন উত্থাপন করা। এটি বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরের পথ পরিক্রমা বুঝতে সাহায্য করবে।
তত্ত্বগত কাঠামো
রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি নিশ্চল বা অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়; এসবের পরিবর্তনই স্বাভাবিক। উপরন্তু এগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, একটি অন্যটিকে প্রভাবিত করে। এর একটি পরিবর্তিত হবে কিন্তু অন্যগুলো স্থির থাকবে, এমন মনে করা সঠিক নয়। কোনটি কোনটিকে প্রভাবিত করে, এ নিয়ে সমাজবিজ্ঞানে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। যাঁরা অর্থনৈতিক নির্ণয়বাদ' বা ইকোনমিক ডিটারমিনিজমে আস্থা রাখেন; যাঁরা অর্থনীতিকে, বিশেষ করে কোনো সমাজের উৎপাদন-কাঠামো এবং উৎপাদন সম্পর্ককে ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করেন, তাঁরা অর্থনীতির পরিবর্তনকেই অন্যান্য পরিবর্তনের চালক বলে দাবি করেন। মার্কসবাদীদের একাংশ এ ধারণার অনুসারী। অর্থনৈতিক নির্ণয়বাদের অনুসারীদের বাইরেও সমাজবিজ্ঞানী আছেন, যাঁরা অর্থনীতির ওপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন যে এটা কেবল অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বিষয় নয়, যে-কোনো রাষ্ট্র কীভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তার কী ভূমিকা, সেটাও রাষ্ট্রের কাঠামো এবং সমাজের বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করে, ক্ষেত্রবিশেষে নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে। বিশ্ব অর্থনীতির কাঠামোর পরিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা আলোচনা করেছেন, তাঁরা দেখান যে বৈশ্বিক ব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদের বিস্তৃতি এবং সেই কাঠামোয় কোন রাষ্ট্র কী ভূমিকা পালন করবে, তার ওপরে রাষ্ট্রের চরিত্র, প্রকৃতি, সক্ষমতা নির্ভরশীল। ইমানুয়েল ওয়ালেরস্টিন, আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক এবং তাঁর অনুসারী যাঁরা বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্ব (ওয়ার্ল্ড সিস্টেমস থিওরি) এবং নির্ভরশীলতার তত্ত্বের (ডিপেনডেন্সি থিওরি) আলোকে সমাজ-রাজনীতি বিশ্লেষণে উৎসাহী, তাঁদের বক্তব্যের সহজ সারাংশ এই রকম (ফ্রাঙ্ক, ১৯৬৬, ১৯৬৭, ১৯৬৯; ওয়ালেরস্টিন, ১৯৭৪, ১৯৮০, ১৯৮৯)।
অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন যে সমাজে বিরাজমান শক্তিগুলো কেবল অর্থনৈতিক সম্পর্কের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, মূল্যবোধ, আচার আচরণ অনেকাংশেই নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে। তাঁদের বিবেচনায় সংস্কৃতির মধ্যে ধর্ম, বিশ্বাস, শিক্ষাও অন্তর্ভুক্ত; কেউ কেউ এর মধ্যে বর্ণ এবং এথনিসিটি বা জাতীয়তাকেও অন্তর্ভুক্ত করেন। এঁদের আমরা ‘সাংস্কৃতিক নির্ণয়বাদী বলতে পারি। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভেবারের আলোচিত গ্রন্থ দ্য প্রটেস্ট্যান্ট এথিক অ্যান্ড দ্য স্পিরিট অব ক্যাপিটালিজম (১৯০৪-৫)-এর একটা বড়ো যুক্তি হচ্ছে এই যে, উত্তর ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশ ও সাফল্যের কারণ হচ্ছে পিউরিটান এথিকস । ভেবার ধর্মের সঙ্গে সমাজ ও অর্থনীতির প্রসঙ্গ, অর্থাৎ ধর্মের সমাজতত্ত্ব, আরো তিনটি বইয়ে আলোচনা করেছেন। ধর্মকে আমরা যদি সংস্কৃতি বলে মানি, তাহলে ভেবারের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট-সংস্কৃতির প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ।
(স্যামুয়েল হান্টিংটন তাঁর বহুল আলোচিত থার্ড ওয়েভ অব ডেমোক্রেসি তত্ত্বে বলেন যে প্রটেস্ট্যান্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিকাংশ দেশেই ১৯৭০-এর আগেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, হান্টিংটন, ১৯৯১)। একই ধরনের কথা ইউরোপের বাইরের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্র বিশ্লেষণে ব্যবহার করেছেন অনেক সমাজতত্ত্ববিদ। যেমন গোটা পূর্ব এশিয়া, বিশেষত চীনা সমাজে পদসোপানের বা হায়ারার্কির গ্রহণযোগ্যতা এবং রাষ্ট্র গঠনে তাঁর ভূমিকা বিশদভাবে আলোচিত। বলা হয়ে থাকে যে এর পেছনে আছে কনফুসিয়ানিজমের প্রভাব (শি, ২০০৮; চেন, ২০১৩)। অর্থাৎ সমাজে বিরাজমান মূল্যবোধ বিশেষ ধরনের রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রেখেছে। ১৯৯০-এর দশকে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার কর্তৃত্ববাদী শাসনের ধারণা প্রতিষ্ঠা এবং তাদের অর্থনৈতিক সাফল্যের ব্যাখ্যা হিসাবে ‘এশিয়ান ভ্যালুজ' বা 'এশীয় মূল্যবোধের' ধারণা প্রচার করা হয়েছিল (ইনুগুচি ও নিউম্যান, ১৯৯৭)। সাংস্কৃতিক নির্ণয়বাদের ওপরে এককভাবে নির্ভর করার বিপদ হচ্ছে এই যে তা ভুলভাবেও ব্যবহৃত হতে পারে। এটি আমরা এশীয় মূল্যবোধের তত্ত্বে যেমন দেখি, তেমনি দেখতে পাই মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক আলোচনায়ও; হান্টিংটনের বহুল আলোচিত-সমালোচিত সভ্যতাসমূহের সংঘাত (ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস) তত্ত্ব এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ (হান্টিংটন, ১৯৯৬)। কোনো কোনো বিশ্লেষক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিকে ইসলাম ধর্মের বৈশিষ্ট্য বলেই দেখানোর চেষ্টা করেছেন। ফলে এটা স্পষ্ট করে বলা আবশ্যক যে সমাজ পরিবর্তনে সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ বলার অর্থ এই নয় যে তা এককভাবে নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে।
অর্থনৈতিক নির্ণয়বাদ এবং সাংস্কৃতিক নির্ণয়বাদের সমর্থকেরা একার্থে এক জায়গায় একমত বলেই প্রতীয়মান: তাঁরা মনে করেন যে রাষ্ট্র নির্ণায়ক নয়, বরং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ফসল।
পরিবর্তনের নির্ণায়ক হিসাবে রাষ্ট্রকে একেবারে খারিজ করে দেওয়ার ধারণাকে তত্ত্বগতভাবে চ্যালেঞ্জ করেন মার্কসবাদীদেরই একাংশ; তাঁরা দেখান যে সাধারণভাবে রাষ্ট্র শ্রেণিস্বার্থের প্রতিভূ হলেও, অর্থাৎ অর্থনীতি নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করলেও, ব্যতিক্রম হিসাবে এমন পরিস্থিতি সম্ভব যেখানে রাষ্ট্র নিজেই আপেক্ষিকভাবে স্বাধীন (বা স্বায়ত্তশাসিত) ভূমিকা পালন করতে পারে। রাষ্ট্রের অপেক্ষিক স্বাধীনতার এই ধারণার উৎস কার্ল মার্কস হলেও ইতালীয় মার্কসবাদী সমাজবিজ্ঞানী আন্তোনিও গ্রামসি তাঁর বিশদ ব্যাখ্যা দেন (গ্রামসি, ১৯৭১)। অন্যান্য নিয়ো-মার্কসবাদীরাও (যেমন, পুলানসাস ও মিলিবান্ড, ১৯৭২) এই বিতর্কে অংশ নেন। এই আলোচনার পাশাপাশি ১৯৮০-এর দশকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে নতুন করে 'রাষ্ট্র' বিষয়ে উৎসাহ পরিলক্ষিত হয় (ইভান্স, রুয়েশমায়ার ও স্কচপল, ১৯৮৫), যার একটি কারণ হচ্ছে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে যে এসব দেশে রাষ্ট্রের ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে অন্যান্য তত্ত্ব এসব দেশের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে পারে না। পূর্ব ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার (যেমন : চিলির) অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে রাষ্ট্র কেবল শাসনের উপকরণ নয়, রাষ্ট্র সমাজের শ্রেণি-কাঠামো বদলে দিতে পারে, এমনকি নতুন শ্রেণি তৈরি করতে পারে। এটা উল্লেখ্য যে রাষ্ট্র শ্রেণি তৈরি করতে পারে, এই ধারণা আগে শুধু ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আলোচিত হয়েছে। কোনো কোনো গবেষক (যেমন : হামজা আলাভি, ১৯৭২) বলেছিলেন যে ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র নতুন শ্রেণি তৈরি করতে পারে এবং করে। এসব আলোচনায় একটা বিষয় অনুপস্থিত থেকেছে তা হলো রাষ্ট্রের আদর্শিক ভূমিকা, অর্থাৎ রাষ্ট্র নিজেই ভাবাদর্শ বা আইডিওলজি তৈরির হাতিয়ার হতে পারে। রাষ্ট্র নতুন আদর্শের জন্ম দিতে এবং তার মাধ্যমে রাষ্ট্রের গৃহীত পদক্ষেপের বৈধতা দিতে সক্ষম (রীয়াজ, ২০০৫)। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ‘জাতীয় উন্নয়নের’ আদর্শের নামে এবং লাতিন আমেরিকায় ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ আদর্শের নামে রাষ্ট্রগুলো অপ্রতিনিধিত্বশীল ও অগণতান্ত্রিক, এমনকি কর্তৃত্ববাদী শাসনকে বৈধতা প্রদান করেছে।
এককভাবে রাষ্ট্র, সমাজ বা অর্থনীতিকে পরিবর্তনের নির্ণায়কের ভূমিকায় স্থাপন করলে রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহকে একটিমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার সুযোগ হয় এবং তাতে করে একধরনের সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। দুটি উদাহরণ আমার বক্তব্য বুঝতে সাহায্য করবে। আমি এই দুটো উদাহরণ ব্যবহার করছি এসবের তাত্ত্বিক গুরুত্বের জন্য যেমন তেমনি বাংলাদেশের জন্য এগুলোর প্রাসঙ্গিকতার জন্যও ।
প্রথমটি হচ্ছে সমাজ-রাষ্ট্র ধর্মের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘সেক্যুলারিজমের' একটি ধারণা বিস্তার লাভ করে যে সেক্যুলারিজম।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....