বনসাই : লেখক রেশমী রফিক | Bonsai : Author Reshmi Rafique

  • বই : বনসাই
  • লেখক : রেশমী রফিক
  • প্রকাশনায় : অন্যপ্রকাশ
  • মূদ্রিত মূল্য : ৬০০৳
  • লেখনীতে : তাসফিয়া নূর তাম্মি 

♦️ভূমিকা
এই উপন্যাসটি পড়ার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে ছিলাম অনেক আগে থেকেই। প্রি-অর্ডার চলাকালীন সময় থেকেই বইটা নেয়ার প্রচুর ইচ্ছে ছিল কিন্তু নিতে পারিনি। অবশেষে কয়েকদিন আগে সংগ্রহ করে ফেললাম। গত ২৪ সেপ্টেম্বর বইটা পড়া শেষ করি। আজ রিভিউ লেখলাম। 

♦প্রচ্ছদ ও নামকরণ
বইটার প্রচ্ছদটা ছবিতে যতটা না সুন্দর দেখা যায়, সামনাসামনি আরো বেশি নজরকাড়া। প্রচ্ছদটা আমার এত বেশি ভালো লেগেছে বলার মতো না। এই উপন্যাসের নামকরণ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। পুরো উপন্যাসটার সাথে নামকরণটা যথার্থ। 

♦ফ্ল্যাপ থেকে
একটা সময় ছিল, সে সৌভাগ্যবশত জীবনের সমস্ত উপজীব্যকে হাতের মুঠোয় পেয়েও অপূর্ণ বোধ করত । জীবন কানায়-কানায় পরিপূর্ণ হতে গিয়েও আটকে ছিল একটা বিন্দুতে, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে যার মান শূন্য । তাই নিজে এক শতে এক শ হয়েও শূন্যের দাপটে ছিল অসহায়, প্রকারান্তে বিপর্যস্ত । 

কেননা এক শকে শূন্য দিয়ে গুণ করলে কেবলই খালি হাতে ফিরতে হয় । সামান্য শূন্যের জোর এতটাই বেশি, সাফল্য কপালে চুমু খেলেও শূন্যের ভয়াল দাপটে তার জীবনের ঝুড়ি খালি রয়ে গেছে । অনেকটা তলাবিহীন ঝুড়ির মতো দশা! পরবর্তী সময়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যেতেই এই দাপটকে একহাত দেখে নেয়ার অভিসন্ধি মাথাচাড়া দেয় । আজীবন সুপথে চলা মানুষটি বেছে নেয় বিপথের গলি । ঘটিয়ে ফেলে সর্বসাধারণের দৃষ্টিতে একটি অন্যায়, যা কিনা তার চোখে কেবলই বুকের মধ্যে জমে থাকা আগ্নেয়গিরির বহিঃপ্রকাশ । বিপথের সেই গন্তব্য যখন চোখের সামনে চলে আসে, হাতে ধরা দেয় সাফল্য, তখনো সে বিপর্যস্ত!

♦কাহিনী সংক্ষেপ
মমতাজ আরার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই গল্পের শুরু। হুট করেই তার মোবাইল বন্ধ পাচ্ছে সুদূর প্রবাসে অবস্থানরত স্বামী-সন্তানরা। জিগাতলার দোতলা একটা বাড়ির মাঝে মমতাজ আরার সকল ভালোবাসা, প্রাণকেন্দ্র, শৈশব-স্মৃতি ও আবেগ মিশে রয়েছে। নিজের জন্মস্থান, শিকড়ের টান ভুলে ভীনদেশে পাড়ি জমানো সম্ভব হয় না তার পক্ষে। তাই বাংলাদেশে একাকী বসত গেঁড়েছেন। 

সবকিছু ঠিকই ছিলো কিন্তু একদিন হুট করেই মমতাজ আরা নিখোঁজ হয়ে যান। মোবাইল বন্ধ, বাড়িতে তালা দেয়া কিন্তু মমতাজ আরার কোনো খোঁজ নেই। তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে নাকি মেরে লাশ গুম করে ফেলেছে সেই সন্দেহে মমতাজ আরার মেয়ে রাইমা তদন্তে নামে। পুলিশের উপর ভরসা করতে পারেনা। তাই নিজেই তৎপর হয় মায়ের খোঁজে। একসময় মমতাজ আরার খোঁজ মিলে। আর তখনই বের হয়ে আসে মমতাজ আরার জীবনের গোপন রহস্য। কী সেই রহস্য জানতে হলে বনসাই জীবনে ঘুরে আসতে হবে। 

♦️চরিত্র বিশ্লেষণ
উপন্যাস মানেই অনেক অনেক চরিত্র থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেখান থেকে গুটিকয়েক চরিত্র প্রধান হিসেবে থাকে।তার মধ্যে মমতাজ আরা কেন্দ্রীয় চরিত্র। জীবনযুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকা সাহসী ও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন এক নারী তিনি। জীবনের বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন রকমভাবে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়েছেন। সবার মাঝে ডুবে থেকে নিজের পছন্দ-অপছন্দকে এক পাশে ছাপিয়ে জীবন পাড় করে দিয়েছেন। নিজের ভালোলাগা, স্বপ্ন, ইচ্ছেগুলো মনের ভেতরেই চেপে রেখেছেন। চুপচাপ নিজের জগতে ডুবে থেকে জীবনের শেষ সময়ে পৌঁছেছেন। এক রহস্যময়ী নারী মমতাজ আরা। 

জীবনযুদ্ধে চলাচল করতে গিয়ে মায়ের অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারে নিজেদের মাঝে। মমতাজ আরার সন্তান মাশুক ও রাইমা।

রাাইমা জাবিরের জাদুবলে হারিয়ে গিয়ে তাকে নিজের জীবনসঙ্গী করেছিল। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে জাবিরকে বিয়ে করতে এক মুহূর্ত ভাবেনি। একসময় রাইমা নিজের অস্তিত্বকে বিলীন হয়ে যেতে দেখে। দমবন্ধ হয়ে আসা পরিবেশ থেকে বাঁচতে মায়ের কাছে নিজেকে সপে দেয়। 
অন্যদিকে মমতাজ আরার একমাত্র ছেলে মাশুক। সব পরিস্থিতি সামলে নিতে জানে নিপুণ দক্ষতার সাথে। নিজের কষ্টকে বিলীন করে পরিবারের সবার জন্য উৎসাহস্থল। সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার হাজারও চেষ্টা করে যায়। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ভালো থাকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। একসময় সেও নিজের জীবনে মায়ের উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারে। তখন নিজ আগ্রহেই মায়ের আশ্রয়ে ফিরে আসে। 

রইসুল ইসলাম, মমতাজ আরার স্বামী। নিজের পছন্দ অপছন্দ ব্যতীত অন্য কিছুর পরোয়া করে না। সবসময় জীবনে কীভাবে উন্নতি করতে পারবে সেদিকেই নজর। এককথায় ব্যাংকভর্তি টাকা কীভাবে উপার্জন করবে সেই চিন্তায় মগ্ন। এছাড়াও এই চরিত্রের আরো অনেক গুণাবলি আছে যেগুলো আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটছে। কিন্তু সকলের কাছে সেগুলো ঘৃণিত। 

এই উপন্যাসে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রয়েছে নূর আহসান। নূর জীবনে একাকী বেঁচে থাকার লড়াইয়ে একসময় হেরে যায়। মায়ের আদর-ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অন্ধ হয়ে যায়। তখন মাকে খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠে। পেয়েও যায় মাকে। এভাবেই সে জীবন পথে এগিয়ে চলে। 
 
উপন্যাসে অনেক অনেক চরিত্র থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এখানেও সেম। সুজান, জাবির, সালিম ও তার পরিবার, রাজনসহ আরো অনেক চরিত্র ছিল। যেগুলো পড়তে গেলেই খুঁজে পাবে পাঠক। তাদের সম্পর্কে আলাদা করে কিছু বলার নেই। তবে সালিম ও তার পরিবারের কথা সবার মনে গেথে থাকবে। বন্ধুর পরিবারের জন্য অনেক কিছু করেছে৷ যেটা আপনজনেরাও করতে রাজি হয়নি। 

♦প্রিয় চরিত্র~
আমার সব চরিত্রগুলোই ভালো লাগে। এখন কোনটা ফেলে কোনটা নিয়ে কথা বলব সেটা বুঝতেছি না। তবে রাইমা চরিত্রটা আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। 

♦পাঠপ্রতিক্রিয়া
এই বইটা অন্যান্য বইগুলোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। লেখকের অন্য বইগুলোতে রোমান্টিকতায় ভরপুর থাকলেও এই বইটাতে আছে বনসাই জীবনের গল্প। ভীনদেশী আবহে মোড়ানো জীবনকে বেশ সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। শিকড়ের টান, ভালোবাসা কীভাবে একটা মানুষকে আঁকড়ে ধরে রাখে সেটা জানতে পেরেছি। বয়সের সাথে সাথে মানুষের মাঝে মানিয়ে নেয়ার একটা অনুভূতি চলে আসে। 

নিজের ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা একসময় ফুরিয়ে আসে। বয়সের সাথে সাথে ভালোলাগা,পছন্দ-অপছন্দ গুলো কোথায় যেন উবে যায়। এর বেশকিছু কারণও থাকে। হয়তো জীবনে জড়িয়ে যাওয়া পাশে থাকা সেই মানুষটাও উবে যাওয়ার কারণ হতে পারে। লেখক খুব সূক্ষ্মভাবে বর্ণনা দিয়েছেন। আমার মনে হয় এই বইটা যতজনই পড়েছে সবার কাছেই উপন্যাসের শেষ অংশটুকু ভালো লেগেছে। কারণ উপন্যাসের শেষটাতে এসে নতুন মোড় নিয়েছে। পুরো উপন্যাসের এই অংশটুকু যে লেখক খুব যত্ন করে সাজিয়েছেন এটা পড়লেই বোঝা যায়। বনসাই জীবনের গল্প বলার জন্য যে আবহ এবং সংলাপ প্রয়োজন হয়, তা লেখক বেশ সুন্দরভাবেই সাজিয়েছেন। 

আরেকটা ব্যাপার হলো এই বইটাতে দেশী-বিদেশী দুই সংস্কৃতির বর্ণনাই গোছালো ভাবে দেয়া আছে। উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে চরিত্র গঠন ও উপস্থিতির ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা লাগে। যেটা রেশমী রফিকের লেখায় কখনো অসুন্দর হয়েছে সেটা আমি পাইনি। প্রত্যেকটা চরিত্রের গভীরতা ও সৌন্দর্য মনোরমভাবে সাজিয়েছে। চরিত্রের উপস্থিতি বর্ণনা বেশ সুন্দর ও সাবলীল। অন্যান্য বইগুলোতে একটু বড়দের স্ক্রিপ্ট থাকলেও এই বইটা নির্দ্বিধায় যেকোনো বয়সের মানুষ পড়তে পারবে। ছোট-বড় সকলের মাঝেই বইটা ছড়িয়ে দেয়া যাবে। 

এবার আসি অন্যদিকগুলোতে, রেশমী রফিকের অন্য বইগুলোর সম্পাদনা যতটা সুন্দর ও গোছালো ছিল। এই বইটাতে মনে হয় বিন্দু পরিমানও যত্ন নেয়া হয়নি। অন্যপ্রকাশের মতো প্রকাশনী থেকে এরকম অমনোযোগীতা আশা করিনি। প্রচুর টাইপিং মিস্টেক ও শব্দ মিস্টেক ছিল। যেটা পড়ার সময় ভালো লাগে নাই। আরেকটা বিষয় হলো এই বইয়ের প্রতি লেখকের আরেকটু মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। 

লেখক উপন্যাসের শেষটুকুতে যতটা মনোযোগ দিয়েছেন প্রথম অংশটুকুতে মনে হয় একটুও মনোযোগ দেয়নি। যার কারণে এত সুন্দর উপন্যাসটা নষ্ট হয়ে গেছে। প্রথম দুই তৃতীয়াংশে শুধু একই বিষয় নিয়ে বারবার করে বলা হয়ছে। যেটাকে বলে টেনে টেনে বড় করা। যাই হোক লেখকই ভালো বুঝেন তার লেখা সম্পর্কে। আমার কথায় কষ্ট পেলে ক্ষমা করবেন। এতটুকু বাদ দিলে উপন্যাসটি নির্দ্বিধায় বেশ সুন্দর। উপন্যাসের প্রথম অংশটুকু পড়তে যতটা একঘেয়েমি লেগেছে শেষটুকু একটানে পড়ে সব মনখারাপ, একঘেয়েমি চলে গেছে। 

এই বইটার বাইন্ডিং এবং পেজ কোয়ালিটি অনেক অনেক ভালো। কর্ণফুলী কাগজের নরম,মোলায়েম পৃষ্ঠাগুলোতে হাত বুলাতেই মনটা ভরে আসে। মন খারাপ হলেও বইয়ের কোয়ালিটি দেখে মন খারাপ উবে গেছে। 

♦️রেটিং~ ৩.৯/৫

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ