আমি কখনোই বউকে মার্কেটে নিয়ে যেতে পছন্দ করতাম না

বিয়ের পরপর  দুই তিনবার বোধহয় যাওয়া হয়েছিল। মার্কেটে এই দোকান থেকে ঐ দোকানে ঘোরাঘুরি ভালো লাগতো না। আমি টাকা দিতাম,সে কিনে আনতো। যখন বাচ্চারা হলো, তখনো আমি টাকা দিতাম,সে পছন্দ করে বাচ্চাদের জামা কাপড় কিনে আনতো।


বিয়ের বহু বছর পর, কাজ সেরে একবার বসুন্ধরা সিটি গেছি একটা জনপ্রিয় ইংরেজি মুভি দেখতে। মুভি আরম্ভ হতে কিছুটা দেরি হবে,আমি টিকিট কেটে ফুডকোর্টের এক কোনায়  এককাপ কফি নিয়ে বসলাম টাইম পাস করার জন্য। 
 
কফি খাচ্ছি, সামনের টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখি,আমার বন্ধু আরফান আর ওর বউ। আমি কফি হাতে নিয়ে ওদের টেবিলে গেলাম। আরফান আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। 

ওর বউকে বেশ উৎফুল্ল মনে হলো।

টেবিলের উপর অনেকগুলো ব্যাগ। বুঝা যাচ্ছে বেশ কেনাকাটা করেছে। আমি মজা করে  বললাম, ভাবী, আরফানকে আজ ফতুর করে ছেড়েছেন, দেখছি!

ভাবী বললেন, না ভাই, আমি এতোকিছু কিনতে চাইনি, আপনার বন্ধু পছন্দ করে জোর করে কিনে দিয়েছে।

ভাবী একটা একটা করে ব্যাগ খুলে আমাকে দেখাতে লাগলেন। ভাবী  একটা জিনিস দেখাচ্ছেন আর বর্ননা করছেন আরফান কীভাবে কোন জিনিসটা পছন্দ করেছে। তার খুশি উপচে উপচে পড়ছে!

আমি জিনিসপত্র দেখছি আর ভাবছি,আরফানের বউ  কতো আগ্রহ নিয়ে তার জামাইয়ের পছন্দ করে কেনা জিনিস দেখাচ্ছে। আচ্ছা,  আমার বউয়ের কী এমন ইচ্ছে করে ?

অনেকদিন পর আমার মনে হলো,আহা! কতদিন বউকে নিয়ে মার্কেটে আসা হয় না!

 তারও নিশ্চয় ইচ্ছে করে করে স্বামীর হাত ধরে মার্কেটে ঘুরে বেড়াতে। সেও চায় তার স্বামী তাকে পছন্দ করে কিছু কিনে দিক। মুখে হয়তো কিছু বলে না।

আরফান আর তার বউ চলে গেছে।

 আমি চুপচাপ খালি কফি মগ হাতে নিয়ে বসে আছি। নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করতে লাগলো। মানিব্যাগ খুলে দেখলাম, বেশি টাকা  নাই,তবে এটিএম কার্ড আছে। 

মুভি দেখার টাইম চলে যাচ্ছে। আমার উঠা দরকার, উঠতে পারছি না। 

আমি মোবাইলটা হাতে নিলাম, বউকে ফোন দিয়ে বললাম, তুমি বাচ্চাদের রেখে এক ঘন্টার মধ্যে আমার এখানে চলে আসতে পারবে? একটা সিএনজি নিয়ে চলে আসো।

বউ ভয় পাওয়া গলায় বললো,কী হয়েছে তোমার?  শরীর খারাপ করেনি তো?

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, মনে হচ্ছে শরীর কিছুটা খারাপই হয়েছে। তুমি কি আসতে পারবে?

বউ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুমি এখন কোথায়?

আমি বসুন্ধরা সিটির লেভেল এইটে আছি।

হায় আল্লাহ! তুমি ওখানেই বসে থাকো,আমি এক্ষুনি আসছি। আমি না আসা পর্যন্ত ওখান থেকে উঠবে না!

এক ঘন্টার কম সময়ে বউ এসে হাজির। সে এসেই আমার কপালে ঘাড়ে হাত বুলাতে লাগলো,জ্বর এসেছে কিনা যাচাই করার জন্য!

আমি হাসিমুখে  বললাম,  আমার কিছুই হয় নাই, আজ দুইজন মিলে একসাথে মুভি দেখবো,এজন্যই তোমাকে ফোন করে এনেছি। আগে এককাপ কফি খেয়ে ঠাণ্ডা হও।

তবুও তার উৎকন্ঠা যায় না, সে বারবার কপালে,বুকে হাত বুলাতে লাগল। ডাক্তার দেখাতে তাগাদা দিতে লাগল। লোকজন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। 

আমি দুটো কফি অর্ডার করলাম। 

বউ কফি খাচ্ছে আর আমার দিকে সন্দেহ নিয়ে  তাকাচ্ছে। সে পরিস্হিতি বুঝার চেষ্টা করছে।  এমন একজন মানুষকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে,যার সাথে সে পরিচিত নয়!

আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। 

লজ্জা গোপন করে  হাসতে হাসতে বললাম, ভয় পাওয়ার কিছু নাই,তোমাকে খুন করার জন্য এখানে আনা হয় নাই। আমি জানি,তোমার নামে তোমার বাবা একটা জমি আলাদা করে রেখেছেন বাড়ি করার জন্য,এখন খুন করলে সেই জমি আমি পাবো না। তোমাকে খুন করলে আমার লস হয়ে যাবে। কফিটা আরাম করে খাও।

কফি খাওয়া শেষ করে বললাম, চল, মুভি দেখবো।

বউ অবাক হয়ে বলল, মাথা খারাপ! বাচ্চাদের বাসায় রেখে এসেছি না? আগে বললে বাচ্চাদের নিয়ে আসতাম!

আমি রোমান্টিক মুড নিয়ে বললাম,  আরে দূর! বাচ্চাদের সামনে তোমার সাথে প্রেম করতে পারতাম নাকি!

বুড়ো বয়সে ভীমরতি কেন হলো, জানতে পারি?

জানি না,হঠাৎ প্রেম করতে ইচ্ছে হল,কাউকে না পেয়ে ভাবলাম,তোমাকেই ফোন করি!

আচ্ছা, তাহলে এই ঘটনা!

একটা শাড়ির দোকানে গিয়ে আমি নিজে একটা শাড়ি পছন্দ করলাম,যা আগে কখনোই করিনি। বউকে বললাম, দেখ তো শাড়িটা পছন্দ হয় কিনা!

বউ বলল, তুমি একটা জিনিস পছন্দ করে দিবে,আমার পছন্দ হবে না, তা কি হয়? কিন্তু তুমি আজকে এই দামী শাড়ি কিনছো কেন? বাসায় তো আমার প্রচুর শাড়ি আছে। ওগুলোই ঠিক মতো পরা হয় না। কোন অনুষ্ঠানে গেলে একটু আধটু পরি।

শাড়ি কিনে গেলাম কসমেটিক্সের দোকানে। তার পছন্দসই অনেক জিনিস কিনলাম। বাচ্চাদের  জন্যও কিছু কেনাকাটা হলো। আগে তাকে নিয়ে দোকানে ঘুরতে বিরক্তি বোধ করতাম,আজকে সারাক্ষণ তার হাতটা ধরে রাখলাম।

কেনাকাটা করে খেতে গেলাম। সে খাচ্ছে আর গল্প করছে। আমার মনে হলো,বউ অনেকদিন আমার সাথে এতো আনন্দ নিয়ে গল্প করেনি। তার প্রতিটি কথায়,  খুশি উপচে উপচে পড়ছে।

 আনন্দিত মানুষের মুখ দেখাও আনন্দের।

নিজের অজান্তেই  মন থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল,হায়! জীবন থেকে অনেককিছুই মিস করে ফেলেছি, যা আমার হাতের মুঠোয় ছিল! 

খাওয়াদাওয়া শেষ করে সে বাচ্চাদের জন্যও কিছু খাবার প্যাক করে নিলো।

 সিএনজিতে উঠে বসে আমার একটা হাত চেপে ধরে রাখলো, যা আগে কখনো করেনি। তক্ষুনি আমার মনে হলো,  আরে!বউয়ের ভালবাসা পাওয়া কতো সহজ! অথচ আমরা বেশিরভাগ পুরুষ তা নিতেই জানি না!!

এখন যে কোন অনুষ্ঠানে গেলে,বেশিরভাগ জায়গায় সে এই শাড়িটা পরে যায়,যদিও এরচেয়ে দামী শাড়ি তার আছে। শাড়ি নিয়ে কথা উঠলে সে গর্ব করে বলে,এটা আমার হাজবেন্ড পছন্দ করে কিনে দিয়েছে। আগ্রহ নিয়ে সে শাড়িটা অন্যকে দেখায়। আগে সে কখনোই এসব কথা বলতে পারতো না!

আগে বিভিন্ন অজুহাতে তাকে মার্কেটে নিয়ে যেতে চাইতাম না, এড়িয়ে যেতাম। এখন মন খারাপ হলেই বলি, চল মার্কেট থেকে ঘুরে আসি।, মন ভালো লাগবে। 

এখন সে আগের মতো যেতে চায় না। সেই মন আর নাই। 

 মনে মনে ভাবি, যদি আগের  জীবনটা ফিরে পেতাম, নিজেকে সংশোধন করে নিতাম।  

তা যে হওয়ার নয়!

আমার মনে হয়,বিয়ের পর একটা মেয়ের গর্বের একমাত্র  জায়গা হচ্ছে তার স্বামী। মা, বাবা, ভাইবোন বা অন্য আত্বীয় স্বজন নয়। - হানিফ ওয়াহিদ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ