শ্রেণি-দ্বন্দ্ব ছাড়া এই অঞ্চলের পলিটিক্স খুব একটা জমে না। উপমহাদেশে সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু, আদিবাসী, উপজাতি, হিন্দু, মুসলিম, পুশইন, পুশব্যাক, অধুনা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু, শ্রীরাম, শিবসেনা ইত্যাদি বিভাজনের কি-ওয়ার্ডের অনেক কদর। এই কি-ওয়ার্ডগুলো একেকটা একেকসময় একেকজনের পুঁজি হয়ে ওঠে। একেক আদর্শের পলিটিশিয়ানরা একেকভাবে ব্যবহার করেন এই পরিভাষাগুলো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পলিটিক্যাল, দলীয় অথবা ব্যক্তিগত লাভ ছাড়া জনতার ও দেশের লাভ কিছুই হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই এই বিভাজন ভাষা ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভাষা ও সংস্কৃতি এই বিভাজনের মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ফলে, আমরা দেখি একজন বিসমিল্লাহর শপথ দিয়ে ভোট চান তো আরেকজন তসবিহ হাতে ও হিজাব মাথায় ভোট চান। কেউ গেরুয়া পরে ভোট চান। কেউ আবার সেকুলারিজমের মন্ত্র জপে ভোট চান। কেউ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূলা ঝুলান তো কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠের স্লোগান তোলেন। রাজনীতি হয়। উন্নয়ন হয়। বাণিজ্য হয়। শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ে। শিক্ষার হার বাড়ে। পোশাকি ভদ্রলোকের বিচরণে দেশ-সমাজের চিকনাই বাড়ে। কমে যায় শুধু সম্প্রীতি। এই সবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্বাস্থ্যবান হতে থাকে বিভাজন, পলিটিক্স, দমন আর শোষণ।
ধীরে ধীরে প্রতিটা বিভাজিত দল ও গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির বিভাজন স্পষ্ট হতে থাকে। মুখের ভাষা ও দেহের ভাষাও ভিন্নতর হতে থাকে। এতে করে আলাদা পেহচান ও আলাদা কমিউনিটি গড়ে ওঠে। শব্দ, ভাষা, সুর, সংগীত, পোস্টার, বক্তব্য, ধর্ম, চিন্তায় প্রত্যেকের আলাদা সিম্বলিক আইডিন্টিটি তৈরি হয়। এই সিম্বলগুলো বঞ্চনায় অথবা নিগ্রহে প্রত্যক্ষ ভূমিকা কম রাখলেও পরোক্ষ ভূমিকা থাকে অকল্পনীয়। শব্দ ও ভাষার সঙ্গে সঙ্গে পোষাক ও পোষাকের ধরন পর্যন্ত ব্যক্তির পরিচয় তো বটে, তার সঙ্গে অন্যদের আচরণেও ভূমিকা রাখে এই সমাজে। এই ভূখণ্ডে। এখানে কর্পোরেট পোষাক, পলিটিক্যাল পোষাক, ধর্মীয় পোষাক নামেও বিভাজন তৈরি হয়। সেই বিভাজন থেকে চৈন্তিক ক্ল্যাশ ও সারভাইবাল ক্ল্যাশ তৈরি হয়।
যেমন : কোনো ক্লাবে লুঙ্গি পরে প্রবেশ নিষেধ তো কোনো ক্লাবে কাবলি সেট পরে প্রবেশ নিষেধ। কোথাও বোরকার জন্য নিগ্রহ তো কোথাও দাড়ি-টুপির জন্য নিগ্রহ। ক্ষমতার পালাবদলে ‘জয় বাংলা’ ও ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ অথবা ‘আল্লাহু আকবার’ ও ‘আল্লাহ মহান’-এর ক্ল্যাশ জমে ওঠে। এসব শুনতে ও দেখতে যতটা গৌণ মনে হয়, বাস্তবে এর প্রভাব অনেক তীব্র ও ভয়ংকর।
বোরকা সংক্রান্ত সংকটগুলো আধুনিক কালে তীব্র হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহিংসতাকে ভাষা ও শব্দের চাতুর্যে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা চলে। বোরকা সংক্রান্ত সৈয়দ মুজতবা আলীর দুইটা উদ্ধৃতি সংযুক্ত করছি। বোরকাকে কেউ তাঁবু বলে কেউ বলে তাম্বু। সেই আলাপ থেকে সৈয়দ সাহেবের বইয়ে দুটি বক্তব্য—
‘তুমি ওই তাম্বু, মানে বোরকা পরো কেন?’
‘স্বচ্ছন্দে যেখানে খুশি আসা যাওয়া করা যায় বলে। আহাম্মুখ ইউরোপীয়ানরা ভাবে, ওটা পুরুষের সৃষ্টি, মেয়েদের লুকিয়ে রাখবার জন্য। আসলে ওটা মেয়েদেরই আবিষ্কার—আপন সুবিধের জন্য। এদেশের পুরুষ এখনও মেয়েদের দিকে তাকাতে শেখে নি বলে—হ্যাটের সামনে পর্দায় আর কতটুকু ঢাকা পড়ে?’ [শবনম, ২৮]
সে হাল্কাভাবে মন্তব্য করে, ‘বোরকার আড়ালে তুর্কি রমণীর সাম্রাজ্য চালাতে বাধা নেই।’… আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের সময় আরব নারীরা বোরকার আড়ালে লুকিয়ে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করত। বাম তাত্ত্বিক ফ্যাননের মতে, এভাবেই বিপ্লব আর নারীমুক্তি একাত্ম হয়ে উঠেছিল। [মজলিসী মুজতবা, ৩০]
শিল্প-সাহিত্যের মজলিশে কোনটা চলে, প্রমিত ভাষারীতি না মুখের (কথ্য) ভাষারীতি, এই আলোচনা জমজমাট নব্বই দশকের শেষের দিক থেকে। গদ্যভাষা আর কাব্যভাষার বিভাজিকা তো চলছেই। কেউ প্রমিতকে একহাত নেন তো কেউ মুখের ভাষাকে একচোট। প্রমিতকে আলগা বলেন একজন। তার বিপরীতজন বলেন, ‘মুখের ভাষা কোনটা নিবেন? নোয়াখালী, সিলেট, চট্টগ্রাম না বরিশালেরটা? নাকি ময়মনসিংহেরটা?’ উত্তর আসে প্রমিতও তো পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার! তাইলে ওটা কেমনে নিবেন? তর্ক চলছে তো চলছেই। এই তর্কের ভেতর দিয়ে কেউ কেউ লিখে ফেলছেন মুখের ভাষায়। সেই মুখের ভাষার পক্ষে আবার আছেন আরেক দল; তাদের কথা স্ল্যাং; মানে গালিও ভাষার অংশ। সুতরাং গালি ছাড়া ভাষা সহজাত ও সাবলীল হয় কেমন করে! এই প্রমিত আর কথ্যের ক্ল্যাশ গিয়ে সাহিত্য রাজনীতির নিয়ামক হয়ে যায়। যিনি যেই পক্ষের, তিনি সেই পক্ষের কবি ও লেখকদের প্রমোট করতে থাকেন। মধ্যপন্থিদের হয় যন্ত্রণা। না তারা পারেন দলে উঠতে না পারেন দল করতে। ফলে বহু প্রতিভাবান কথাসাহিত্যিক ও কবি থেকে যান পাদ-প্রদীপের আড়ালে।
ওদিকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জসীম উদ্দীন; হালের হাসান আজিজুল হক প্রমুখকে নিয়ে চলে নানান খেলা। কেউ রবীন্দ্রনাথকে বলেন মাঝারি কবি তো কেউ নজরুলকে শত বছরের বাংলা কবিতার সংকলন থেকে বাদ দেন। কেউ জসীম উদ্দীনের কবিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। হাসান আজিজুল হককে অস্বীকার করেন। কেউ কবিতায় ইসলামি অনুষঙ্গ এলে কবিকে এভয়েড করেন। কেউ আবার লেখকের ঘরানা দেখে মূল্যায়নের কথা বলেন। ভাষা ও সাহিত্যের এই পলিটিক্স এমন এক জগৎ, যেখানে পথের কোনো সীমানা নেই। নেই কোনো নির্দিষ্ট পথ।
একদিকে কবি গদ্যকারকে নিয়ে রঙ্গ করেন তো গদ্যকার কবিকে নিয়ে তামাশা জোড়েন। এই নিয়ে কবিদের একটি বিখ্যাত উক্তি বলতে শুনা যায়। ‘কবি যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবে; গদ্যকার তখন কবির জন্য রাস্তা ছেড়ে দেবে।’ কেউ সাহিত্যের সমালোচনাকে এপ্রিশিয়েট করেন তো কেউ সমালোচককে একহাত নেন। এসবের ভেতর দিয়ে চলতে থাকে বাংলা ভাষার শিল্প ও সাহিত্যচর্চা। শব্দ ও ভাষার পলিটিক্সের এ আরেক ডাইমেনশন। এই ডাইমেনশনে জেগে থাকে আরেক জগৎ।
দুই.
ভাষারাজনীতির অধুনা প্রেক্ষাপটে বাংলার দুইটি রূপ সামনে এসে হাজির হয়। একটা হলো, ইংরেজি প্রধান বাংলা। আরেকটা প্রমিত বাংলা। প্রমিতের মধ্যে আরও কিছু ভাগ আছে। যেমন : স্ল্যাং নির্ভর বাংলা। আরবি-উর্দু-ফার্সি শব্দসমেত বাংলা। সর্বময় বাংলা শব্দজাত বাংলা।
ইংরেজি নির্ভর বাংলা এফএম রেডিও আর কর্পোরেট হাউজে চলছে। একে কেউ খিচুড়ি বাংলা বলছেন। কেউ আবার ডিজুস প্রজন্মের ভাষা বলছেন। কেউ কেউ বলছেন, চৈতন্যহীন জেনারেশনের ভাষা।
প্রমিত বাংলা বইয়ের বাইরে খবরে আর আবৃত্তিতে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। ওদিকে উচ্চশিক্ষারত একটা ভার্সিটি প্রজন্ম নিজেদের সঙ্গে কথা বলার সময় দেদার গালি ও অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করছে।
অন্য দিকে মাদরাসা-শিক্ষিত ও নজরুল ফররুখ প্রভাবিত কেউ কেউ আরবি-ফার্সি-উর্দু শব্দসমেত বাংলা ব্যবহার করছেন। এটাকে আবার কেউ এভয়েড করছেন। অপছন্দ করছেন। তাদের চেষ্টা থাকে যেন বাংলা থেকে আরবি-উর্দু-ফারসি শব্দ ঝেটিয়ে বিদায় করা যায়। এই বিদায় বিষয়ে একটা কোটেশন কোট করছি—
“আজ থেকে দুশো বছর আগে ‘পণ্ডিত’ ‘মুন্সি’ দুটি পদ তৈরি করেছিল ইংরেজরা। সংস্কৃত-জানা ও ফারসি-জানা লোক যথাক্রমে এই দুই পদের অধিকারী। ইতিহাসের দেরাজ খুললে বাংলা গদ্যের দলিলপত্র যা পাওয়া যায় তাতে ইনাদেরই হাতে লেখা বাংলা ভাষার সাফ-কবলা। সেই থেকে বাংলার দখল নিয়েছে সংস্কৃত আর ফারসি। পরবর্তীকালে দেখা গেল, পণ্ডিতদের অনুচর একদিকে ফারসিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে উদ্যত, অন্যদিকে মুন্সিদের গুপ্তচর সংস্কৃতকে হটিয়ে দিতে মশগুল। প্রথম পক্ষের উৎপাত পুরো উনিশ শতক জুড়েই। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ১৮৩৮ সালে ‘পারসীক অভিধান’ নামে যে সংকলনটি করেন জয়গোপাল তর্ক্কালঙ্কার, তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষায় যে সব বিদেশি (ফারসি) শব্দ ব্যবহৃত হয় তা চিহ্নিত করা। যাতে এসব শব্দ পরিহার করে শুদ্ধ বাংলা চর্চায় লেখকরা সচেতন হয়ে ওঠেন।” [মোহম্মদ আজম, বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও রবীন্দ্রনাথ]
সর্বময় বাংলা শব্দজাত বাংলা হলো আরেক মজার জিনিস। এই পক্ষের ব্যক্তিরা প্রতিটা বিদেশী শব্দকে বাংলায়ন করে ব্যবহারের প্রচেষ্টায় রত। দুই হরফের ‘ফোন’ এর বাংলা ‘দূরালাপনী’, ‘এক্স-রে’কে ‘রঞ্জনরশ্মি’, ‘ফটোকপি’কে ‘ছায়াকপি’ ইত্যাদি বলতে আগ্রহবোধ করেন। এইরকম বাংলায়ন অনেক ক্ষেত্রেই আওয়ামের জন্য জুলুমের নামান্তর হয়ে যায়।
তিন.
এই অঞ্চলে বিশেষত ইসলাম ধর্মীয় পরিমণ্ডলে বাংলা ভাষা ব্যবহারের একাধিক ডাইমেনশন ও শব্দ-বৈচিত্র্য আছে। অন্যান্য ধর্মীয় পরিমণ্ডলে ব্যাপারটা এত তীব্র না হলেও তাদের মধ্যে শব্দ ব্যবহারের বৈচিত্র্য রয়েছে। (যথাস্থানে উদাহরণ আসবে।) এই আলোচনায় শুধু ইসলাম ধর্মীয় বৈচিত্র্যের সংক্ষিপ্ত ইশারা দিয়ে রাখছি।
আমাদের বাংলাদেশে ধর্মীয় বিভাজনের প্রধানত তিনটা ধারা। কওমি, আলিয়া ও খানকা। কওমি ও আলিয়া কেন্দ্রিক শব্দ-বৈচিত্র্য অতটা স্পষ্ট না। তবুও দুই অংশের দৈনন্দিন আলাপে, সংলাপে একটা বিভাজন থেকে যায়। কথায় ও উদাহরণে কারও আরবি প্রবাদ-প্রবচন চলতে থাকে। কারও আবার নিরেট আটপৌরে ভাষা।
তবে আলিয়া ঘরানায় দেওবন্দি সিলসিলার বাইরে রয়েছে আরও বেশ কিছু ঘরানা। ওখানে মাজারপন্থি, আহলে হাদিস, জামাতপন্থি, তাবলিগ বিরোধী কিয়ামপন্থি। প্রত্যেকের আলাদা ভাষাভঙ্গি আছে। প্রত্যেকের বলার ধরনে থাকে ব্যতিক্রমতা। মাজারপন্থিদের পোস্টার লিফলেটে ‘ওরশ মোবারক’, ‘উরসে কুল’, ‘শাহ সূফী’, ‘সূফী সম্রাট’ শব্দগুলোর আবশ্যিক ব্যবহার থাকবে। আহলে হাদিসপন্থিদের লিফলেট পোস্টারে ‘শায়খ’, ‘মাদানী’, ‘বিন’ শব্দের আধিক্য চলছে এই সময়ে। জামাতপন্থিদের পোস্টার লিফলেটের ভাষা আবার ভিন্নরকম। কিয়ামপন্থিদের লিফলেট পোস্টারে, ‘মাওলানা’, ‘ডক্টর’, ‘সাইয়েদ’, ‘ইসালে সাওয়াব’, ‘এগারো শরীফ’, ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ কি-ওয়ার্ডগুলো দেখা যায় অধিক হারে। তাদের পির ও মুরুব্বিদের নামের শেষে সাধারণত কু. ছে. আ. লেখা থাকে। যার এলাবরেশন সম্ভবত ‘কুদ্দা সিররুহুল আলিয়া’।
কওমি ঘরানায় আবার থানভি, মাদানি, তাবলিগিসহ বেশ কিছু ঘরানা দেখা যায়। তাদের মধ্যে কেউ ‘হজরতওয়ালা’, কেউ ‘হজরতজ্জী’, ‘পীরে কামেল’, ‘মুফতী’, ‘মাওলানা’, ‘আল্লামা’ , ‘হজরাতুল আল্লাম’, ‘মুর্শিদে কামেল’; এবং নামের পরে ‘দা. বা.’ মানে ‘দামাত বারাকাতুহুম’, ‘হাফি:’, মানে ‘হাফিজাহুল্লাহ’ ইত্যাদি শব্দের আধিক্য দেখা যায়। কেউ ‘বড় সভা’, কেউ ‘ইসলাহী মজলিস’, কেউ, ‘ইসলামী মহাসম্মেলন’, কেউ ‘ইসলাহী জোড়’, কেউ ‘তালিমী জলসা’ লিখে থাকেন।
এইভাবে শব্দ ও শব্দ ব্যবহার দিয়ে ক্রমশ ঘরানা ও স্বাতন্ত্র্য প্রকাশিত হতে থাকে। সেই সঙ্গে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির দূরত্ব বাড়তে থাকে। এই দূরত্ব আর পলিটিক্সের বিস্তারিত আলাপ আরেক কিস্তিতে ইন শা আল্লাহ।
•
সাইফ সিরাজ
কবি ও বিশ্লেষক
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....