দই খেতে কে না ভালোবাসে বলুন? ভালো-মন্দ খাওয়ার পর দই না খেলে খাওয়াটা ঠিক জমে না। আর সেটা যদি হয় মিষ্টি দই তাহলে তো কথাই নেই।
বাড়িতে টক দই আমরা কমবেশি সকলেই তৈরি করতে পারি। কিন্তু যত সমস্যা বাধে মিষ্টি দই তৈরির সময়।
বেশিরভাগ নারী প্রায়শই অভিযোগ করেন যে অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও, বাড়িতে তৈরি মিষ্টি দই দোকানের মতো হয় না। আর কোনক্রমে জমাতে পারেলও তার স্বাদ ভালো হয় না ।
বাড়িতে দই তৈরির সময় সাধারণ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় যেমন: দই জমে না , জমলেও কেমন যেন পানি পানি হয় , দই থেকে গন্ধ আসে, খেতে অনেক টক হয় ইত্যাদি। ফলে অনেকেই বাড়িতে দই তৈরি করতে চান না। আর যখন কোন সমস্যার সমাধান খুঁজতে ইউটিউব বা গুগলে সার্চ করেন, তখন হতাশ হয়ে ফেরেন। আশা রাখি এই আর্টিকেলটা পড়ার পর দই তৈরি নিয়ে সকল সমস্যার সমাধান পেয়ে যাবেন।
■ দই কি ?
দুধকে বিশেষ ধরনের উপকারী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন খাদ্যসামগ্রী হল দই। দইয়ের পুষ্টিমান অনেক এবং এর সর্বাধিক উপকারী উপাদান হল লাইভ ব্যাকটেরিয়া বা প্রোবায়োটিক। এটি ‘ভালো ব্যাকটেরিয়া’ নামেও পরিচিত।
■ উপকরণ:
মাত্র তিনটি উপকরণ দিয়ে খুব সহজেই বাড়িতে বানিয়ে ফেলতে পারেন আপনার পছন্দের মিষ্টি দই।
১। খাঁটি দুধ ( ফুল ফ্যাট মিল্ক বা হোল মিল্ক) - ১ লিটার
২। চিনি ( মিষ্টি স্বাদের জন্য) - ১২০ গ্রাম
৩। দই বীজ ( স্টার্টার কালচার/Stater culture) - ২ চা চামচ
■ প্রস্তুত প্রণালীঃ
১। প্রথমে চুলায় একটি হাঁড়িতে এক লিটার দুধ নিয়ে ঘন ঘন নেড়ে বলক তুলে নিন। দুধ যেন পুড়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। কারণ এতে দইয়ে পোড়া স্বাদ পেতে পারেন।
২। এখন অন্য একটি হাঁড়িতে দুই টেবিল চামচ চিনি দিয়ে ক্যারামেল তৈরি করে নিন। এই ক্যারামেলটাই দইয়ে সুন্দর একটা রং দেবে। তবে ক্যারামেল তৈরিতে সাবধানতা অবলম্বন করবেন। নইলে ক্যারামেল পুড়ে দই তিতা হয়ে যেতে পারে।
৩। ক্যারামেলটা হয়ে গেলে অল্প পরিমাণে দুধ নিয়ে ক্যারামেলের সাথে ভালো করে মিশিয়ে নিন। এখন এইটা এক পাশে রেখে দিন।
৪। এইদিকে চুলায় থাকা দুধ, ভালোভাবে জ্বাল দিয়ে ঘন করে নিন। কতটুকু ঘন করবেন এটা অবশ্য নির্ভর করবে আপনি যে দুধটা ব্যবহার করছেন সেটা কতটুকু ঘন। আপনি চাইলে গুঁড়ো দুধ দিয়ে দুধের ঘনত্ব বৃদ্ধি করতে পারেন। তবে অবশ্যই পরিমাণ মতো ব্যবহার করবেন।
৫। দুধটা যখন প্রায় ঘন হয়ে আসবে তখন চিনি দিয়ে দেবেন , সেইসাথে তুলে রাখা ক্যারামেল মিশ্রিত দুধটুকুও দিয়ে দেবেন। এবার আরো কিছুক্ষণ জ্বাল দিয়ে দই তৈরির উপযুক্ত ঘনত্বে নিয়ে আসুন। সাধারণ যতটুকু দুধ নিয়েছেন তার অর্ধেক কিংবা ৬০% করে নিবেন।
৬। এবার দুধটাকে ঠান্ডা হতে দিন। একটা বিষয় মাথায় রাখবেন, দই তৈরিতে অবশ্যই ফুল ফ্যাট যুক্ত দুধ ব্যবহার করবেন। আপনি চাইলে প্যাকেটজাত গুঁড়ো বা তরল দুধ দিয়েও দই তৈরি করতে পারবেন। এতে দইয়ের স্বাদে বা গন্ধে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। তবে শর্ত একটাই ফুল ফ্যাট যুক্ত দুধ ব্যবহার করতে হবে।
৭। এরপর একটি পাত্রে ২ চা চামচ পরিমাণে দই বীজ (আগের টক বা মিষ্ট দই ) নিয়ে ভালো করে ফেটে নিন। আর খেয়াল রাখবেন, কোনোভাবেই যেন দই বীজে কোনো পানি না থাকে। এবার অল্প পরিমাণে জ্বাল দেওয়া দুধ নিয়ে দই বীজের সাথে মিশিয়ে নিন। মনে রাখবেন জ্বাল দিয়ে রাখা দুধটুকু কুসুম গরম পর্যায়ে আসলে তখন দই বীজ মেশাতে হবে।
৮। এখন বাকি দুধটুকু ও দই বীজ মিশ্রিত দুুধ ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। ইউটিউবে এমন অনেক রেসিপি আছে যেখানে , দুধ গরম থাকা অবস্থাতেই দই বীজ দিয়ে দিচ্ছে, আবার অনেকেই দই বীজ দিয়ে তারপর দুধ জ্বাল দিচ্ছেন, এমনকি দই বীজ ভালো করে মিশিয়েও নিচ্ছেন না। ভুলেও এই কাজ করতে যাবেন না।
৯। দুধের সঙ্গে দই বীজ মেশানো হয়ে গেলে এই মিশ্রণটি একটি পরিস্কার শুকনো মাটির পাত্রে অথবা যেকোন পাত্রে ঢেলে নিন। এরপর পাত্রের মুখটাকে ঢাকনা অথবা ফয়েল পেপার দিয়ে ঢেকে দিন। এই পর্যন্ত প্রত্যেক ধাপ ভালোভাবে মেনে চলুন। এরপর আপনি চাইলে দই সনাতন পদ্ধতিতে, চুলায়, ওভেনে, রাইস কুকারে এবং প্রেশার কুকারেও তৈরি করতে পারবেন।
১০। তবে দই সবচেয়ে ভালো হয় ইয়োগার্ট মেকারে তৈরি করলে । ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৬-৭ ঘন্টা রাখলেই দই প্রস্তুত হয়ে যায়। এছাড়াও চুলায় দই তৈরি করা যায় । সেক্ষেত্রে হাড়ি বা প্রেশার কুকারের ভেতরে একটি কুকিং স্ট্যান্ড বসিয়ে, সামান্য পানি দিয়ে, একটু গরম হলেই দইয়ের সেই পাত্র দিয়ে , ঢাকা দিয়ে অল্প আঁচে রেখে দিন। ২-৩ ঘন্টা পর দেখুন দই জমেছে কিনা। ভালোভাবে না জমলে আরো কিছুক্ষণ চুলায় রেখে দিন। রাইস কুকারে দই তৈরির ক্ষেত্রেও একই ভাবে দইয়ের পাত্র বসিয়ে রাইসকুকারে ওয়ারমার তাপমাত্রায় দিয়ে রাখুন। ৩ ঘণ্টা পর দেখুন দই জমেছে কিনা।
১১। এখন সেই জমা দই ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে নিন। এতে দই আরো ভালোভাবে জমবে এবং খেতেও ভালো লাগবে। ফ্রিজে তিন থেকে চার ঘন্টা রাখতে পারেন।
■ দই নিয়ে সাধারণ কিছু প্রশ্নোত্তর
● কেন দই জমে না ?
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দই না জমার কারণ হল দুধ ভালোভাবে গাঁজন না হওয়া। এটি অনেক কারণে হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ: দই বীজ ভালো না হলে, দূষিত দুধ বা সরঞ্জাম ব্যবহার করলে , সঠিক ইনকিউবেসন টেমপারেচারে না রাখলে এবং ভালো মানের দুধ ব্যবহার না করলে।
● কেন দইয়ের ঘনত্ব তরল দুধের মত হয়?
অনেক সময় দই জমলেও দইয়ের ঘনত্ব তরল দুধের মত পাতলা হয়। এটা মূলত হয়ে থাকে দুধে চর্বি এবং মিল্ক সলিড কম থাকার কারণে। দুধে যত বেশি চর্বি থাকবে সেই দইটা তত বেশি কোমল ও মসৃণ হবে। এইজন্যই দই তৈরিতে চর্বিযুক্ত দুধ ব্যবহার করবেন এবং দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে নেবেন।
● দই থেকে দুর্গন্ধ কেন আসে?
দুধ যদি কোনভাবে বাইরের ব্যাকটেরিয়া বা ইস্ট এর সংর্স্পশে আসে সেক্ষেত্রে দই থেকে দুর্গন্ধ আসতে পারে। সেজন্য দই তৈরিতে ব্যবহৃত প্রতিটা সরঞ্জাম ভালোভাবে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নেবেন। আর যে দই বীজ ব্যাবহার করবেন সেটা অবশ্যই যেন ভালো মানের হয়।
● দই খেতে টক কেন হয়?
দই র্দীঘ সময় ধরে গাঁজন বা ফার্মেন্ট করার ফলে দইয়ের স্বাদ টক হয়। সময় বাড়ার সাথে সাথে দইয়ের টক স্বাদটাও বাড়তে থাকবে। তাই দই হওয়ার সাথে সাথে ফ্রিজে ঠান্ডা করতে রেখে দেবেন। এতে গাঁজন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে এবং দই খেতে মিষ্টিও হবে।
■ দই তৈরির সময় এই দুইটি বিষয় খেয়াল রাখবেন:
১। যে দই বীজ ব্যাবহার করবেন সেটা যেন টাটকা হয়। পুরানো দই বীজ দিয়ে দই নাও জমতে পারে। আর ভুলেও গরম দুধের সাথে দই বীজ মিশ্রিত করবেন না।
২। দই তৈরির জন্য চুলা, রাইস কুকার বা ওভেন যেটাই ব্যবহার করেন না কেন, অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা যেন সমানভাবে দইয়ের বাটিতে প্রবাহিত হয় সেটা খেয়াল রাখবেন।
দই তৈরি করা একটু কঠিনই বটে, আবার অনেক সময় জমতেও চায় না। এর থেকে কিনে খাওয়া ভালো কোন ঝামেলা নেই। আপাত দৃষ্টিতে কেনা দই ভালো মনে হতে পারে । তবে কেনা দইয়ে প্রচুর পরিমাণে চিনি এবং আর্টিফিশিয়াল সুইটনার ব্যবহৃত হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভাল নয়। তাই প্রিয় মানুষদের সুস্থ রাখতে বাড়িতে তৈরি করুন মিষ্টি দই। আর যারা একটু স্বাস্থ্য সচেতন তারা ডাবল টোনড মিল্ক দিয়ে দই তৈরি করতে পারেন এতে চর্বি একটু কম আছে। আর আপনি চাইলে আপনার পছন্দ অনুযায়ী চিনি কম বা বেশি করে দিতে পারেন।
দইয়ের গুণাগুণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই আর্টিকেলটি পড়ে আসতে পারেন,
Article Credit : মরিয়ম সুলতানা সায়মা
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....