- বই : ঘিরে থাকা অন্ধকার | বাপ্পী খান
- জনরা : সুপারন্যাচারাল হরর ফিকশন
- প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২০
- প্রচ্ছদ : রাজু
- অলঙ্করণ : ওয়াসিফ নূর
- প্রকাশনা : বাতিঘর প্রকাশনী
- মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা মাত্র
- Review Credit : Peal Roy Partha
⚈ স্পয়লার-ফ্রি রিভিউ—
❝আমরা কাঁদাই, আমরাও কাঁদি, সেখানে…
রক্তমাখা ধূসর অতীত ভুলে থাকি, বর্তমানে।❞
বর্তমানে দেশিয় প্রেক্ষাপটে আধিভৌতিক কল্পকাহিনি নিয়ে গল্প তৈরির চর্চা কতটা প্রসারিত হয়েছে সেটা বাস্তবে তেমন দেখা না গেলেও বইয়ের পাতায় গা ছমছম করা গল্পগুলো পুঁজি করে যেভাবে সুন্দর রোমাঞ্চকর অনুভূতি লেখকরা দিয়ে যাচ্ছে পাঠকদের সেটার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা একান্ত কর্তব্য। আধিভৌতিক গল্পের প্রচলন সেই সৃষ্টির শুরু থেকে, মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত কাহিনি ঠাঁই নিয়েছে রূপকথা নামক কাল্পনিক কাব্যে কিন্তু লেখকরা সেটাকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। তারা চেয়েছেন বা বুঝিয়েছেন প্রত্যক মানুষের শৈশবের সাথে যে গল্পগুলোর ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে সেগুলোকে কীভাবে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায়? যে গল্পে ভয়ের অনুভূতি অনুভব করা যায়, ঘোর লাগানো সেই অন্ধকার জগতের কথা শুনতে কে না চাইবে? অন্ধকারে থাকা নিষিদ্ধ সব রহস্য যেভাবে ঘিরে থাকে প্রকৃতি সেইসব অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে তৈরি এই ❛ঘিরে থাকা অন্ধকার❜ বা অন্ধকার ট্রিলজির দ্বিতীয় গল্প।
সাধারণত চোখ বুলিয়ে দেখলে দেশিয় প্রেক্ষাপটে যত আধিভৌতিক গল্প, মিথ প্রচলিত রয়েছে তার চেয়ে দিগুণ রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত বেশকিছু আধিভৌতিক গল্পকাহিনি এই মানচিত্রে বন্দি হয়ে যায়। সে থেকে প্রচলিত ও প্রসারিত হয়েছে অনেকটাই। গ্রাম বাংলার কাহিনি ডালপালা গজাতে গজাতে ঢুকে গিয়েছে কবি সাহিত্যকের গল্প উপন্যাসে। ক্ষুরধার মস্তিষ্ক ও কলমের ছোঁয়াতে রূপান্তরিত হয়েছে অসংখ্য কল্পনা ও বাস্তবের মেলবন্ধনে লোকমুখে রটানো কিছু অন্ধকারের ঘটনা।
আধিভৌতিক কাহিনির প্রেক্ষাপটের ডালপালা বেশ সুবিস্তীর্ণ। প্রতিপাদ্য কারণে বা অন্ধতমিস্রে ঘটা ঘটনাবলি নিয়ে হোক লিখিত সব উপন্যাসে কম আগ্রহ কখনও দেখা যায়নি। সেই অমোঘ আকর্ষণের ফলে অসংশয়ে টিকে রয়েছে আধিভৌতিক সভ্যতার চিরচেনা ভয়ের স্তম্ভ। কাছে ঘেঁষা ভয়ের সঙ্গে দূরে থাকার যন্ত্রণা দুইয়ের মিশ্রণে সৃষ্ট সংশয়ের বিশ্বাস অবিশ্বাসের বোধও এক সময় হারিয়ে যায় অন্ধকারে। ফিরে আসে তখনি যখন কেটে যায় সব অন্ধকার, আলোরা গ্রাস করে নিবে আধিভৌতিকের ভয়ানক দুনিয়াকে। পবিত্র গ্রন্থাবলীতে উল্লেখিত সকল ধর্মের যে অন্ধকার শক্তির কথা বর্ণনা দেওয়া রয়েছে সেসব কখনও মিছে হতে পারে না।
সব অন্ধকার রহস্যের মীমাংসা হয় না। কিছু রহস্য থেকে যায়, সেই রহস্য থেকে জন্ম হয় নতুন আরেকটি রহ্যসের। এইভাবে চলমান থাকে অন্ধকারের অতিপ্রাকৃত সত্ত্বাদের সাথে সভ্য সমাজের যোগাযোগ।
➲ আখ্যান—
সিলেটের গহীন বনে দীর্ঘদিন পর জ্ঞান ফিরে পাওয়া মানুষটা কে? কিয়াসু কেন সেই মানুষটার প্রতি এত আগ্রহী? কিয়াসুর জীবনের অন্ধকার উপাখ্যান জানতে চান?
ওদিকে রাজস্থানের যে ঘটনা ‘সত্য-কলামে’ ঠাঁই নিয়েছে, তা কি আদৌ ঘটেছিল?
কুড়িগ্রামের সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলে রাতের গভীরে নেমে আসা নিশিবু’র অভিশাপ কতটা সত্যি?
বরিশালের ঝালকাঠিতে প্রতি আমাবস্যার রাতে অজ্ঞাত আক্রমনের জন্য দায়ী কে? এর জন্য স্থানীয় মন্ত্রীর কেন এত মাথা ব্যথা?
ওদিকে সাফওয়াত আর আইরিন সুন্দরবনের গভীরে এক চরে বন্দি। দূর থেকে ভেসে আসছে হিংস্র মায়াবাঘের হুংকার! কী করবে তারা? এমন অজস্র প্রশ্নকে পেছনে ফেলে সবার একটাই জিজ্ঞাসা। রফিক শিকদার কোথায়?
➤ পাঠ প্রতিক্রিয়া ও পর্যালোচনা—
❝অন্ধকার আমার জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে সবকিছু। এবার আমার রুখে দাঁড়ানোর পালা।❞
সাগরের বয়ে চলা ঢেউয়ের তালে তাল রেখে নৌকা যেভাবে সরল গতিতে এগিয়ে যায় ঠিক লেখকের লেখনশৈলীতে এই উপন্যাস সেইভাবে এগিয়ে গিয়েছে। মাখনের মতো বর্ণনাতে কোনদিক দিয়ে সময় উবে গিয়েছে টের পায়নি। মনে হয়েছে লেখকের বইটি লেখতে কোনোপ্রকার কষ্ট হয়নি, এই লেখতে বসেছেন আর লেখা শেষ করে ওঠেছেন। অথচ এত সুন্দর সাজানো প্রত্যকটি গল্পের পেছনে যে শ্রমের বলিরেখার দাগ স্পষ্ট। লেখক বুঝিয়েছেন সকল সূত্রের সমাধান রয়েছে এই উপন্যাসে। তবে চালাকিও যে করেননি বলাটা ভুল হবে। সব রহস্য তো এক উপন্যাসে উন্মোচিত করবেন না। রেখে দিয়েছেন কিছু কিছু!
কাহিনির শুরু হয় গল্পে হারিয়ে যাবে পাঠক যেভাবে আমি হারিয়েছি। অতিপ্রাকৃত গল্প ভীষণ পছন্দের তার ওপরে এত সাবলীল বর্ণনাতে দ্রুত গতিতে কিয়াসুর জীবনের উপ্যাখান আর কী ঘটেছিল তার জীবনে সেইসব পড়তে পড়তে আমি পুলকিত হয়েছি ভীষণ ভাবে। শুধু কী এইখানে শেষ? লেখকের চিন্তাশক্তি মাধ্যমে প্রধান প্লটের সাথে সাথে গড়ে উঠেছে আরও কিছু সাবপ্লট। এই সাবপ্লটে রয়েছে আধিভৌতিক ও রহস্যঘেরা দারুণ সব কাহিনি। প্রচলিত কিন্তু লেখকের অন্বেষণ করার দক্ষতাকে বাহবা জানাতে হচ্ছে।
বিচ্যুতি ঘটেনি কোনোভাবে। লেখক রসদ আগে থেকেই যোগান করে রেখেছেন বলে কোনোভাবে কাহিনির গতি কমেনি। যোগসূত্র স্থাপন করেছেন বেশ সুন্দর ভাবে। ট্রিলজির পূর্বের বই ❛হার না মানা অন্ধকার❜ থেকেও এই উপন্যাসে সর্বদিকে পরিপক্বতার ছাপ স্পষ্ট। ঘটনা ঠিক যেভাবে ঘটা দরকার সেইভাবে ঘটিয়েছেন। উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পেরেছেন। গল্পের গাঁথুনি, শব্দচয়নে ছিল রসবোধের ছোঁয়া। বয়স বেশি হয়ে যাচ্ছে বলে ভয় কম পেলেও মুগ্ধ হয়েছি অনেক এইখানে হয়তো লেখকের স্বার্থকতা। আদতে এইসব বই পড়া একবার শুরু করলে শুধু পড়েই যেতে ইচ্ছে করে।
প্রায় ছয়টি ঘটনার সমষ্টি ঘটেছে উপন্যাসে। প্রত্যকটি ঘটনার বিবরণ চমকপ্রদ। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বা কাটখোট্টা বিবরণ খুঁজে পাওয়া যায়নি তবে একটি বিষয় খুব প্যারা দিয়েছে কী সেটা অবশ্যই বলব। বইয়ে অনেকগুলো কবিতা ছিল, লেখক প্লটের সাথে সামঞ্জস্যতা রাখার জন্য মূলত সেগুলো দিয়েছেন। সব যে ভালো হয়েছে তেমন না তবে কিছু কিছু কবিতা ছিল ঘোর লাগানো। সব মিলিয়ে সুখানুভূতি নিয়ে বইটি সমাপ্তি দিয়ে পরবর্তী বইয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। কারণ, পিকচার যে এখনও বাকি!
উপন্যাসে লেখক বেশ কয়েকটি ম্যাজিক টার্ম ও মিথ ব্যবহার করেছেন। ম্যাজিক টার্ম বললেও সেটা ছিল মূলত তন্ত্রসাধনার একাংশ। কাহিনির সাথে সখ্যতা বজার রেখে এই টার্মগুলো ব্যবহার করেছেন। এবং যে মিথের আশ্রয় নিয়েছেন সেটি দেশিয় প্রেক্ষাপটের সাথে বেশ সম্পৃক্তা রয়েছে। বাংলিশ ব্যবহার তেমন ছিল না, যেটা পজেটিভ দিকের আরেকটি। সব মিলিয়ে কাহিনির যোগসূত্র ভালোই মেলাতে পেরেছেন।
আধিভৌতিক নিয়ে চর্চা বেশ সুন্দরভাবে অগ্রসর হচ্ছে দেখে ভালো লাগছে। এগিয়ে যাক দেশিয় সাহিত্য, আমাদের আধিভৌতিক প্রেক্ষাপট হয়তো বিশাল না আবার থাকলেও সীমাবদ্ধ তবে চাইলে লেখকরা অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন বলে বিশ্বাস। দরকার শুধু সাপোর্টের।
❛ঘিরে থাকা অন্ধকার❜ বইটি পড়ার পূর্বে অবশ্যই লেখকের অন্ধকার ট্রিলজির প্রথম বই ❛হার না মানা অন্ধকার❜ পড়ে নিবেন। নাহয় কাহিনির সাথে সামঞ্জস্যতা খুঁজে পেতে বেগ পাবেন।
➢ লেখক, বানান, অলঙ্করণ, প্রচ্ছদ, মলাট, বাঁধাই—
বাপ্পী ভাইয়ের ❛হার না মানা অন্ধকার❜ বই দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল। বইটি ছোটো ছিল বলে মন কিছুটা খারাপ লাগা থেকে গিয়েছিল কিন্তু ❛ঘিরে থাকা অন্ধকার❜ দিয়ে তিনি অনেকটাই পুষিয়ে দিয়েছেন। শুনেছি ওনার বই অর্থাৎ অন্ধকার ট্রিলজির শেষ বই ❛কেটে যাক অন্ধকার❜ হবে আরও বিশাল কলেবরে। প্রায় ৩০০+ পেজের বইটিতে ফ্যান্টাসির ছোঁয়া পাবেন পাঠকরা। এরপরে আসতে পারে প্রিক্যুয়েল ট্রিলজি! ধামাকা যে উনি দিবেন সেইটা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। উনার লেখনশৈলীতে প্রমাণ করে দিচ্ছেন এই জনরাতে পাকাপোক্ত আসন দখল করে নিয়েছে ইতোমধ্যে। সে পর্যন্ত শুভকামনা রইল লেখকের জন্য। আশা করছি দ্রুত অন্ধকার ট্রিলজির শেষ বই হাতে পেয়ে যাব।
সম্পাদনা নিয়ে তেমন অভিযোগ নেই কারণ বইয়ের বর্ণনাভঙ্গি স্মুথ ছিল এবং কোন বাধাবিপত্তি ঘটেনি। পড়তে অসুবিধা হয়েছে বানানের কারণে। নেগেটিভ মার্কিং দিলে এদিকে আমি দিব। যদিও যতটুকু জেনেছি তাড়াহুড়োর কারণে সেভাবে বইয়ের প্রুফিং দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই দ্বিতীয় মুদ্রণে যত্ত বানান ভুল সব আশা করছি ঠিকঠাক করে নেওয়া হবে। তাই আগে সর্তক করে দিব, যারা বইটি পড়বেন বানান ভুলের জায়গা ইগনোর করে বইটি পড়ার চেষ্টা করবেন। বইয়ের ভালো লাগাতে এইসব ভুলে থাকা যেমন দৃষ্টিকটু তেমনি ভালো বইয়ের এই অবস্থা খারাপ লাগা সৃষ্টি করে।
অলঙ্করণ নিয়ে আলাদা ভাবে না বললেই হচ্ছে না। ওয়াসিফ নূর ভাইয়ের আঁকা ইলোস্ট্রেশন গুলো এক কথায় দুর্দান্ত। দারুণ সব আর্টওয়ার্ক বইটিকে দিয়েছে করেছে জীবন্ত। পড়তে পড়তে কাহিনির সাথে রিলেটেড ছবিগুলো আকর্ষণ বাড়িয়ে দিবে নিঃসন্দেহে। ওনার এই আর্টওয়ার্ক ব্যক্তিগত ভাবে আমার অনেক পছন্দ। আসন্ন অনেক বইতে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন, আগামীতেও এই ধারা যাতে অব্যাহত থাকুক। শুভকামনা রইল।
জাহিদুল রাজু ভাইয়ের প্রচ্ছদ ছিল বেশ সাদামাটা। চাইলে আরও অনেক কিছু যুক্ত করতে পারতেন। বইয়ের ফ্রন্ট কভারে থাকা অবয়বের মালিক কে সেটা নাহয় বই পড়ে আন্দাজ করে নিবেন। আশা করছি আগামী বইগুলোতে কাজে নতুনত্ব নিয়ে আসবেন।
বাতিঘর প্রকাশনীর বইটি ছিল ক্রিম কালার পেপারের। প্রোডাকশন নিয়ে এই বইতে কোনো অভিযোগ নেই। তাই পড়তে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব হয়েছে। আশা করছি আগামী বৃহত্তর বই গুলোতে প্রকাশনীর প্রোডাকশন আরও উন্নতমানের হবে।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....