- জান্নাত-জাহান্নাম
- লেখক : ড. ওমর সুলাইমান আল-আশকার
- প্রকাশনী : সমকালীন প্রকাশন
- বিষয় : পরকাল ও জান্নাত-জাহান্নাম
- অনুবাদক : উস্তায আকরাম হোসাইন
- সম্পাদক : মুফতি আবুল হাসানাত কাসিম, মুফতি সারোয়ার হুসাইন
- পৃষ্ঠা : 336, কভার : হার্ড কভার
- ভাষা : বাংলা
জান্নাত এমন এক শান্তিসুখের চিরস্থায়ী নিবাস, যা আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারি না। জান্নাতের শুরু আছে, শেষ নেই। সেখানে জীবন আছে, মৃত্যু নেই। যৌবন আছে, বার্ধক্য নেই। এমন সব নিয়ামত রয়েছে সেখানে, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি এবং কোনো হৃদয়ও কখনো কল্পনা করেনি। আর জাহান্নাম হচ্ছে চিরস্থায়ী শাস্তিভোগের এমন এক আবাস, যার কল্পনা করাও আমাদের সাধ্যের বাইরে। শাস্তির ভয়াবহতায় মানুষ সেখানে মরে যেতে চাইবে। মৃত্যুকে সেখানে সবার সামনে জবাই করা হবে। তাই চাইলেও কেউ আর মরে যেতে পারবে না। জাহান্নামের শাস্তি এতটাই প্রলয়ংকরী যে, এর বর্ণনা শুনলেও অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।
জান্নাত-জাহান্নামের স্বরূপ না জানলে আমরা আমাদের করণীয় নির্ধারণ করতে পারব না। তাই জান্নাতের অফুরন্ত নিয়ামত আর জাহান্নামের প্রচণ্ড ভয়াবহতার বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন—‘জান্নাত-জাহান্নাম ’।
জান্নাতের বিবরণ - জান্নাত অতুলনীয়
আল্লাহর যত সৃষ্টি রয়েছে, সেসবের মধ্যে মানুষ হলো সর্বোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ। মানুষের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, অন্য সৃষ্টিজীবের ক্ষেত্রে যেসব কল্পনাও করা যায় না। বুদ্ধিমত্তা ও কল্পনা করার ক্ষমতা হলো তেমনি দুটি ক্ষমতা। অন্যান্য জীবের বুদ্ধিমত্তার সাথে মানুষের বুদ্ধিমত্তার রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। আর কল্পনা করার ক্ষমতা হলো মানুষের অভিনব একটি ক্ষমতা।
ধরুন, নানামুখী চাপে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে আপনার জীবন। সংসারের বিভিন্ন দুশ্চিন্তা, অফিসের কাজের অতিরিক্ত চাপ, কষ্টকর আবহাওয়া, আশেপাশের মানুষগুলোর পীড়াদায়ক ব্যবহার, সব মিলিয়ে আপনার কাছে জীবনটাকে দুর্বিষহ বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন, দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে পারলে বেশ হতো; এমন কোনো জায়গায়, যেখানে কিনা স্বস্তি রয়েছে, শান্তি রয়েছে।
চোখ বুজে ভাবছেন—নীরব, নির্জন সবুজ এক প্রান্তরে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। প্রশান্তিদায়ক বাতাস আপনার শরীর-মনকে সতেজ করে তুলেছে। সুউচ্চ সব গাছে লোভনীয় ফল-ফলাদি পেকে রয়েছে। নানা বর্ণের, নানা গন্ধের ফুলের সুবাস আপনার মাঝে জাগিয়ে তুলেছে অপার্থিব এক অনুভূতি। কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ বারিধারা। নানা জাতের পাখির কল-কাকলিতে আপনার চিত্ত বিমোহিত হয়ে উঠেছে।
বাস্তবে এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই। আপনি আছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে। আপনি আসলে এতক্ষণ যা ভাবছিলেন, তার সবটুকুই আপনার কল্পনা। আর এখানেই অন্যান্য সৃষ্টিজীবের সাথে মানুষের পার্থক্য। মানুষ কল্পনা করতে পারে, যা সত্যিই বিস্ময়কর এক ক্ষমতা। মানুষ অনেক কিছুই কল্পনা করতে পারে। যেকোনো সময় ডুব দিতে পারে কল্পরাজ্যে।
তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, বিশেষ এই কল্পনাশক্তি দিয়েও জান্নাতের সৌন্দর্য মানুষ কখনো কল্পনাও করতে পারবে না! না জানি কী অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত হবে জান্নাত, যা কিনা কোনো হৃদয় কল্পনা করতেও অক্ষম!
জান্নাতের সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। এর সুখশান্তি অতুলনীয়। কল্পনাতীত তার নিয়ামতরাজি। অনন্য তার ব্যবহার-সামগ্রী ও ভোগ্য উপকরণ। মানুষ দুনিয়ায় যতই উন্নতি করুক না কেন এবং যতই বিলাসী উপকরণ প্রস্তুত করুক না কেন জান্নাতের নিয়ামতের তুলনায় সেগুলো একেবারেই নগণ্য। পৃথিবীর সাথে জান্নাত কোনোভাবেই তুলনীয় নয়।
একটি হাদিসে জান্নাতের অনিন্দ্য সৌন্দর্য ও অনিঃশেষ সুখসম্ভারের বর্ণনা বিধৃত হয়েছে এভাবে—কাবার রবের শপথ! জান্নাত হলো স্থায়ী বাসস্থানে ঝলমলে আলো, আন্দোলিত ফুল, সুরম্য প্রাসাদ, তরঙ্গায়িত নদী, পাকা ফল, সুন্দরী রমণী, প্রভৃত অলংকার, অনিঃশেষ আনন্দ, অপার্থিব সজীবতা, সুউচ্চ বাড়ি, নিরাপদ আশ্রয় এবং নয়নাভিরাম ঠিকানার নাম।[১]
সাহাবিরা একবার আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জান্নাতে নির্মিত প্রাসাদের বিবরণ জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে আল্লাহর রাসুল বলেছিলেন, ‘সেই প্রাসাদের এক ইট হবে স্বর্ণের; অন্য ইট হবে রুপার। সিমেন্ট হবে আফার নামক বিশেষ সুগন্ধির। পাথরকুচি হবে মুক্তা ও ইয়াকুতের। মাটি হবে জাফরানের। যে সেখানে প্রবেশ করবে, সে শুধু নিয়ামতই প্রাপ্ত হবে, কখনো দুর্ভোগের শিকার হবে না। সে স্থায়ী হবে, কখনো মৃত্যুবরণ করবে না। তার পোশাক কখনো পুরোনো
[১] সুনানু ইবনি মাজাহ: ৪৩৩২; জামিউল আহাদিস : ১৭১০৪; সহিহ্র ইবনি হিব্বান : ৭৩৮১; হাদিসের সনদ দূর্বল। এটি নবিজির বাণী কিনা তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কারো কারো মতে এটি সাহাবি বা তাবিয়ির বাণী।
হবে না এবং শেষ হবে না তার যৌবন।' [১] মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সত্য বলেছেন—
وإذا رأيت ثم رأيت نعيما وملكا كبيرا ©
তুমি যখন সেদিকে তাকাবে, দেখতে পাবে, ভোগবিলাসের উপকরণ এবং সুবিশাল রাজ্য [২]
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, 'আমি আমার সৎ বান্দাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি এমন প্রতিদান, যার সৌন্দর্য ও বিশালতা কোনো চোখ দেখেনি, যার বিবরণ কোনো কান শোনেনি; এমনকি যার কল্পনাও কারো হৃদয়ে উদিত হয়নি।”
এরপর আল্লাহর রাসুল বলেন, বিশ্বাস না হলে তোমরা এই আয়াতটি তিলাওয়াত করতে পারো—
فلا تعلم نفس ما أخفي لهم من قرة أعين جزاء بما كانوا يعملون *
কেউ জানে না, তাদের কর্মের প্রতিদান হিসেবে তাদের জন্য চোখ-জুড়ানো কী কী পুরস্কার লুকিয়ে রাখা হয়েছে![৩][৪]
জান্নাতের বিশালতা ও ব্যাপকতা কল্পনা করাও মানুষের পক্ষে অসম্ভব। আকারে সবচাইতে ছোট যে জান্নাত, সেটিও সমগ্র বিশ্বজগতের ১০ গুণ! এ সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। পৃথিবীর যত ভাষা রয়েছে, যত অলংকার রয়েছে, তার সবই জান্নাতের সৌন্দর্য বর্ণনায় নির্বাক হয়ে যাবে। জান্নাতের অবারিত প্রান্তর, বৃক্ষপল্লব থেকে ধ্বনিত হওয়া জান্নাতি সুরের অপূর্ব মূর্ছনা, জান্নাতের হৃদয়গ্রাহী খুশবু, সুরম্য সব অট্টালিকা,
[১] জামিউত তিরমিযি : ২৫২৬; মুসনাদু আহমাদ : ৮০৪৩ – হাদিসটি সহিহ।
[২] সুরা ইনসান, আয়াত : ২০
[৩] সুরা সাজদা, আয়াত : ১৭
[৪] সহিহুল বুখারি : ৩২৪৪; সহিহ মুসলিম : ২৮২৪
গালিচা, খাট-পালঙ্ক আর অন্যান্য আসবাব, অন্তর শীতলকারী ঝরনাধারা, জান্নাতি ফলমূল ও খাদ্যসম্ভার, হুর ও গিলমানের বিস্ময়কর রূপ-লাবণ্য ও সৌন্দর্য, জান্নাতের আভিজাত্য, এর শান-শওকত, এর জাঁকজমক আর চাকচিক্য স্বচক্ষে দেখার পরে জান্নাতিরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হবে। কৃতজ্ঞচিত্তে তারা আল্লাহর প্রশংসায় বলে উঠবে, ‘আলহামদুলিল্লাহ”।
জান্নাতের দরজা
পৃথিবীতে যেকোনো প্রাসাদ বা সুউচ্চ ভবনে রাজকীয় প্রবেশদ্বার নির্মাণ করা হয়, যাতে করে বাইরে থেকেই এর আভিজাত্য ফুটে ওঠে যথার্থভাবে। পৃথিবীর সাথে জান্নাত কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। শুধু বোঝার সুবিধার্থে উদাহরণ দেওয়া। সুউচ্চ, সুবিশাল, সুবিস্তৃত জান্নাতের দরজা কতটা রাজকীয় হবে, কারুকার্যময় হবে তা কল্পনা করাও কোনো হৃদয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে, জান্নাতের প্রবেশদ্বার একটি নয়; এর রয়েছে বেশ কয়েকটি দরজা। আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও ফেরেশতাগণ এ সকল দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করবেন। মহান আল্লাহ বলেন—
وإن للمتقين لحسن مآب ﷺ جنات عدن مفتحة لهم الأبواب - متكئين فيها يدعون فيها بفاكهة كثيرة وشراب 2
আর মুত্তাকিদের জন্য রয়েছে উত্তম আবাস — চিরস্থায়ী জান্নাত। এর দরজাগুলো তাদের জন্য খোলা থাকবে। তারা সেখানে বসবে হেলান দিয়ে। সেখানে তারা নানারকম ফলমূল ও পানীয় চাইবে [১]
মুমিনগণ জান্নাতের নিকটবর্তী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজাগুলো খুলে দেওয়া হবে। ফেরেশতারা তাদের সাদর সম্ভাষণ জানাতে থাকবে—
حتى إذا جاءوها وفتحت أبوابها وقال لهم خزنتها سلام عليكم طبتم فادخلوها خالدين -
যখন তারা জান্নাতের কাছে পৌঁছাবে, তাদের জন্য জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হবে এবং জান্নাতের রক্ষীগণ তাদেরকে বলবে, “তোমাদের
[১] সুরা সাদ, আয়াত : ৪৯-৫১
প্রতি সালাম। তোমরা সুখী হও এবং জান্নাতে প্রবেশ করো স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাসের জন্য (১)
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘রামাদান শুরু হতেই জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়। [২]
জান্নাতের মোট আটটি দরজা রয়েছে। উমার ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ভালো করে ওযু করার পর এই দুআটি পড়বে—
أشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له ، وأشهد أن محمدا عبده ورسوله ، اللهم اجعلني من التوابين ، واجعلني من المتطهرين
উচ্চারণ : আশহাদু আল্লা- ইলা-হা ইল্লাল্ল-হু ওয়াহদাহু লা- শারীকা লাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ‘আব্দুহূ ওয়া রসূলুহ। আল্ল-হুম্মাজ ‘আলনী মিনাত তাওওয়া-বীনা ওয়াজ ‘আলনী মিনাল মুতাত্বহহিরীন।
অর্থ : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি এক, তাঁর কোনো শরিক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসুল। হে আল্লাহ, আমাকে তাওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন এবং জায়গা দিন পবিত্রতা অর্জনকারীদের দলে।
তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হবে। সে যেকোনো দরজা দিয়ে ইচ্ছামতো জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। [৩]
জান্নাতের দরজাসমূহের নাম
[এক] বাবুস সালাত (সালাতের দরজা) : যারা নিজেদের সালাতের ব্যাপারে
[১] সুরা যুমার, আয়াত : ৭২
[২] সহিহ মুসলিম : ১৮৭৯; জামিউত তিরমিযি : ৬৮২; সুনানু ইবনি মাজাহ : ১৬৪২; সহিহু ইবনি খুযাইমা : ১৮৮২; হাদিসটির সনদ সহিহ।
[৩] সহিহ মুসলিম : ২৩৪
সচেতন, আন্তরিক একনিষ্ঠতার সাথে সালাত আদায় করে, তাদের সম্মানে জান্নাতের এ দরজার নামকরণ করা হয়েছে।
[দুই] বাবুল জিহাদ (জিহাদের দরজা) : যারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর পথে তাদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে লড়াই ও সংগ্রাম করবে, তাদের সম্মানে জান্নাতের এই দরজার নামকরণ করা হয়েছে।
[তিন] বাবুর রাইয়ান (পরিতৃপ্তি লাভের দরজা) : এই দরজা দিয়ে কেবল সিয়াম পালনকারীগণ প্রবেশ করবে।
সাহল ইবনু সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, জান্নাতে আটটি দরজা রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে একটি দরজার নাম ‘রাইয়ান।’ কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে কেবল সিয়াম পালনকারীগণ প্রবেশ করবে। তারা ব্যতীত অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা করা হবে, সিয়ামপালনকারীগণ কোথায়? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। তারা প্রবেশ করলে, দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। আর কারো প্রবেশ করার সুযোগ থাকবে না।[১]
[চার] বাবুস সাদাকা (দানের দরজা) : মানুষের প্রয়োজনে যারা নিজেদের অর্থ-সম্পদ দিয়ে মানুষকে সাহায্য করেছে, তাদের সম্মানে জান্নাতের এই দরজার নামকরণ করা হয়েছে।
[পাঁচ] বাবুল ঈমান (ঈমানের দরজা) : এই দরজার নামকরণ করা হয়েছে তাদের সম্মানে, যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
[ছয়] বাবুল-কাযিমিন আল-গায়িজ ওয়াল আফিনা আনিন্নাস (রাগদমন ও মানুষের ভুল ক্ষমা করা লোকদের দরজা) : এই দরজার নামকরণ করা হয়েছে তাদের সম্মানে, যারা অন্যের ভুলকে ক্ষমা করে এবং নিজেদের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে।
[সাত] বাবুর-রাযিয়িন (সন্তুষ্টদের দরজা) : যারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপরে সন্তুষ্ট এবং আল্লাহও যাদের ওপরে সন্তুষ্ট, আর-রাযিয়িন তাদের সম্মানে নির্মিত দরজা।
[১] সহিহুল বুখারি : ১৮৯৬; সহিহ মুসলিম : ১১৫২
[আট] বাবুত তাওবা (ক্ষমাপ্রার্থনার দরজা) নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুপ্রাণিত হয়ে যারা আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে, তাদের সম্মানার্থে জান্নাতের এই দরজার নামকরণ করা হয়েছে।
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতের উপরিউক্ত নামগুলো নির্দেশ করেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একই জাতীয় দুটি বস্তু ব্যয় করবে[১], তাকে জান্নাতের বিশেষ দরজা থেকে ডেকে বলা হবে, হে আল্লাহর বান্দা এটাই তোমার জন্য কল্যাণকর। যে নিয়মিত সালাত আদায় করে, তাকে বাবুস সালাত থেকে ডাকা হবে। যে জিহাদ করে, তাকে বাবুল জিহাদ থেকে ডাকা হবে। যে সাদাকা করে, তাকে বাবুস সাদাকা থেকে ডাকা হবে। যে সিয়াম পালন করে, তাকে বাবুর রাইয়ান[২] থেকে ডাকা হবে। এতটুকু শুনে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আল্লাহর কসম! যাকে জান্নাতের দরজা সমূহের মধ্যে থেকে একটি দরজা দিয়ে ডাকা হবে তার তো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এমন কেউ কি থাকবে, যাকে সবগুলো দরজা থেকে একসঙ্গে ডাকা হবে? আল্লাহর রাসুল বলেন, অবশ্যই। আর আমি আশা করি, তুমি হবে তাদেরই একজন!’[৩]
ডান দরজা
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত শাফাআত-সংক্রান্ত একটি হাদিসে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের আরো জানিয়েছেন, যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে, তারা ডান দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। বাকিরা অন্যান্য দরজা
[১] ইমাম নববি এই হাদিসের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন— কাযি ইয়ায বলেন, 'যাওজান’ দ্বারা উদ্দেশ্য এক জোড়া ঘোড়া বা এক জোড়া উট বা দুজন গোলাম। ইবনু আরাফা বলেন, 'একই জাতীয় দুটি জিনিস যা সাওয়াবের আশায় আল্লাহর রাস্তায় দান করা হয়। মোটকথা ইসলামের সব ভালো কাজই এর অন্তর্ভুক্ত। হতে পারে তা টাকা-পয়সা, খাদ্য-পানীয়, পোশাক-পরিচ্ছেদ ইত্যাদি সাদাকা করা বা অন্য যেকোনো ইবাদত যা একটিকে অন্যটির সাথে মিলিয়ে আদায় করা হয়। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা বলেছেন মূলত আল্লাহর রাস্তায় বেশি বেশি সাদাকার ফযিলত বর্ণনা করার জন্য। আর ‘ফি সাবিলিল্লাহ” দ্বারা উদ্দেশ্য ইসলামি শরিয়তের যেকোনো হালাল ক্ষেত্র। অনেকে আবার বলেছেন, এখানে একমাত্র জিহাদই উদ্দেশ্য। [শারহু মুসলিম, নববি, খণ্ড : ৭, পৃষ্ঠা : ১১৬]
[২] পরিতৃপ্তির দরজা
[৩] সহিহুল বুখারি : ১৮৯৭, ৩৬৬৬; সহিহ মুসলিম : ১০২৭
দিয়ে প্রবেশ করবে, ‘সুপারিশের একপর্যায়ে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ, আপনার উম্মতের মধ্যে যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে, তাদের ডান পাশের দরজা দিয়ে প্রবেশ করান। তবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে অন্যান্য দরজা দিয়েও তাদের প্রবেশাধিকার থাকবে। যার হাতে আমার প্রাণ, তার শপথ করে বলছি, জান্নাতের দরজাগুলোর দুই চৌকাঠের মধ্যবর্তী দূরত্ব মক্কা ও হাজার কিংবা মক্কা ও বুসরার মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান।”[১]
উতবা ইবনু গাযওয়ান বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে, জান্নাতের দরজাগুলোর দুই চৌকাঠের মধ্যবর্তী দূরত্ব চল্লিশ বছর ভ্রমণের সমপরিমাণ। এরপরও এমন একদিন আসবে, যেদিন ভিড়ের কারণে দরজাগুলো প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে যাবে। [২]
জান্নাতের মাটি
জল, বায়ুর মতো পৃথিবীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো মাটি। মাটির ওপরেই আমাদের বসবাস। ধূলিমাটি, কাদামাটি, বালুমাটি ইত্যাদি নানাজাতের মাটি রয়েছে দুনিয়ার বুকে। কোনোভাবে মাটি আমাদের শরীরে বা কাপড়ে লেগে গেলে তা আমাদের কাছে 'নোংরা' হিসেবে গণ্য হয়।
শুধু দুনিয়াতেই নয়, জান্নাতেও কিন্তু মাটি রয়েছে। তবে, দুনিয়ার মাটির সাথে জান্নাতের মাটির রয়েছে বিস্তর পার্থক্য।
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘একবার আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আপনার সাক্ষাতে এলে হৃদয় বিগলিত হয়; আমরা আক্ষরিক অর্থেই আখিরাতের মানুষ হয়ে যাই। কিন্তু যখনই আপনার থেকে পৃথক হই, তখনই দুনিয়া আমাদের বিমোহিত করে ফেলে। স্ত্রী-সন্তানের মায়া ও চিন্তা আমাদের ঘিরে ধরে। তিনি বললেন, আমার কাছে অবস্থানকালে তোমাদের যে অবস্থা হয়, সে অবস্থা সবসময় থাকলে ফেরেশতারা হাত বাড়িয়ে তোমাদের সাথে মুসাফাহা করত। বাড়িতে গিয়ে তোমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করত।
আর তোমরা যদি কোনো গুনাহ না করতে, তবে আল্লাহ তোমাদের পরিবর্তে এমন এক জাতি সৃষ্টি করতেন, যারা
[১] মুসনাদু আহমাদ : ৯৬২৩; জামিউত তিরমিযি : ২৪৩৪; হাদিসটির সনদ সহিহ।
[২] সহিহ মুসলিম : ২৯৬৭
গুনাহ করত। কারণ, তিনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, এবার আমাদের জান্নাত সম্পর্কে বলুন। জান্নাতের প্রাসাদগুলো কেমন হবে? তিনি বললেন, জান্নাতের প্রাসাদের এক ইট হবে স্বর্ণের; আরেক ইট হবে রুপার। সিমেন্ট হবে আযফার নামক বিশেষ সুগন্ধির। পাথরকুচি হবে মুক্তা ও ইয়াকুতের। মাটি হবে জাফরানের। যে সেখানে প্রবেশ করবে, সে শুধু নিয়ামতই প্রাপ্ত হবে। কখনো দুর্ভোগের শিকার হবে না। সে স্থায়ী হবে। কখনো মৃত্যুবরণ করবে না। তার পোশাক কখনো পুরোনো হবে না এবং তার যৌবন কখনো ফুরিয়ে যাবে না...। [১]
আবু যর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, মিরাজ-সংক্রান্ত দীর্ঘ হাদিসে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছিল। তখন সেখানে রাশি-রাশি মুক্তা ও মেশকের মাটি দেখেছি।’[২]
আবু সাইদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, একবার ইবনু সাইয়াদ আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জান্নাতের মাটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘জান্নাতের মাটি মিহি আটার মতো সাদা ও খাঁটি মেশকের মতো সুগন্ধময়।'[৩]
জান্নাতের নদীনালা
পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, বড় বড় সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছে নদ-নদীকে কেন্দ্র করে। মিশরীয় সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা, সুমেরু সভ্যতা, সেলটিক সভ্যতা এগুলোর সবকটিই গড়ে উঠেছে ‘নদী-সাগর বা মহাসাগরকে’ কেন্দ্র করে। পানি ছাড়া ভূমি উর্বরতা হারিয়ে ফেলে। গাছপালা, ফুল-ফসল কোনোটিই পানি ছাড়া সজীবতা লাভ করতে পারে না।
পানির ভূমিকা শুধু প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এর রয়েছে দৃষ্টি নান্দনিকতা ও প্রচণ্ড আকর্ষণী ক্ষমতা। তাই তো ভ্রমণপিয়াসু মানুষ সমুদ্রের অথৈ জলরাশি দেখতে প্রয়োজনে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে ছুটে যায় অপর প্রান্তে। অগাধ
[১] জামিউত তিরমিযি : ২৫২৬; মুসনাদু আহমাদ : ৮০৪৩; হাদিসটির সনদ সহিহ।
[২] সহিহুল বুখারি : ৩৩৪২; সহিহ মুসলিম : ১৬৩
[৩] সহিহ মুসলিম: ২৯২৮
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....