"যে গল্পে ভালোবাসা নেই"
রাত গভীর হয়েছে। ঘড়িতে সময় কত সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। চাঁদটা পুব আকাশে ঢলে পড়ে মিটমিট করে জ্বলছে। বাতাসে নিস্তব্ধতার গন্ধ মিশে পরিবেশে এনে দিয়েছে মাদকতা। হাতে এক কাপ কড়া করে বানানো কফি নিয়ে সেই মাদকতায় ডুবে আছে কুহক। ছাদের এপাশ ওপাশ পায়চারি করছে সে। আর মাঝে মাঝে খুব সন্তর্পণে কাপের খোলা মুখটাতে চুমু একে দিচ্ছে সে। এ অবস্থায় যে কেউ দেখলে ভাববে হয়তো রাজ্যের দুশ্চিন্তায় ডুবে আছে সে। অথবা তার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে প্রবল উপকূলীয় ঝড়। যদিও এসবের কোনোটাই সত্যি নয়। সে আসলে ভাবতে ভালোবাসে। ভালোবাসে রাতের নিস্তব্ধতা নিংড়ানো ভালোলাগার অনুভূতিগুলো নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে। যান্ত্রিক এই পৃথিবীতে এই সুযোগটা রাতের এই সময়টাতেই কেবল পাওয়া যায়। মানুষজন ঘুমায়, ছুটি পায় একঘেঁয়ে কোলাহল আর যান্ত্রিক শব্দগুলোও।
যেন পুরো পৃথিবীটাই কাঁথা কম্বল মুড়িয়ে গভীর ঘুমে ব্যস্ত। জেগে থাকা বলতে শুধু কুহক আর রাস্তার কিছু নিয়ন আলোর ল্যাম্পোস্ট। এ সময় কুহকের সঙ্গী হিসেবে আরেকটা জিনিস থাকে। সেটি হচ্ছে তার প্রিয় একটা ডায়েরী। নিজের সমস্ত চিন্তা ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে রাখে ডায়েরীতে। যেভাবে একজন পরিপাটি গৃহবধু তার সাধের নতুন পুরাতন পোশাকাদি আলমারিতে গুছিয়ে রাখে ঠিক সেভাবেই। তার ধারণা ডায়েরীতে গুছিয়ে রাখা তার লেখাগুলো একদিন জীবন্ত হয়ে উঠবে। কথা বলবে। তার সাথে বসে চাঁদ দেখবে আর আড্ডা দেবে। অবশ্য এখনও যে সেটা করছেনা তা কে জানে?
কুহক আজকে শুধু কফি হাতে পায়চারিটাই করছে, লিখছে না কিছু। ভাবখানা এমন যে পায়চারি করাটা এখন তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার মাথায় অবশ্য বেশ কিছু বিষয় নিয়ম করে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই যেমন -
আজ সকালে সে যখন ভার্সিটিতে যাচ্ছিল তখন হুট করেই একটা দৃশ্য তার চোখে আটকে যায়। ফুটপাতে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে এক অর্ধনগ্ন বুড়ো লোক। তার মাথার নিচে দুখানা আধাপোড়া ইটের টুকরো। একখন্ড ছেড়া পলিথিনের টুকরো দিয়ে শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। তার পাশেই দেয়ালটাতে একটা গ্রাফিতি আঁকা। পাশে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে 'জীবনকে ভালোবাসাই জীবনের ধর্ম'। অথচ ব্যস্ত নগরীটা অতি সাবধানে একটা মুমূর্ষু জীবনকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ ফিরে তাকাবারও ফুসরত পাচ্ছে না। কুহক বুঝতে পারেনা এখানে কে জীবনহীন, ফুটপাতের লোকটা নাকি ব্যস্ত নগরীটা ?
ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে আরেকটা ঘটনা তার ক্ষুদ্র মস্তিস্কে বেশ নাড়া দিলো। রিকশা থেকে নেমে সে ভাড়া মেটাচ্ছিল। হঠাৎই সে লক্ষ করলো তার অদূরে দুটো লোক বাক্যযুদ্ধে ব্যস্ত। একজনের পরনে স্যুট, বুট আর টাই হাতে একটা ছোট অফিস ব্যাগ। আর অন্যজনের পরনে একটা লুঙ্গি আর কালশিটে পড়া সাদা গেঞ্জি। একটা লাল টুকটুকে গামছা লুঙ্গি আর গেঞ্জিটাকে লোকটার কোমড়ের কাছে জোড় বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখতে ব্যস্ত। রাজ্যের ধুলো ময়লার ভীরে গামছাটা অবশ্য এখন আর লাল নাই, কালচে হয়ে গেছে। ভাড়া মিটিয়ে কুহক সেদিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু তার পৌঁছানোর আগে ঠাস করে একটা শব্দ হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল। পাঁচ টাকার জন্য দুজনের মধ্যে মতের অমিল। আর বাকযুদ্ধের এক পর্যায়ে রিক্সাওয়ালার গালে চরটা বসে গেল আকস্মিকভাবেই। যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের মতোই রিক্সাওয়ালা তার রিক্সাটা নিয়ে পালিয়ে বাঁচলো যেন। আর ভদ্রলোকটা একটা চওড়া হাসি হেসে দুশো টাকায় এক প্যাকেট বেনসন সুইচ কিনে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। কুহক অবশ্য বুঝতে পারলো না যে ভদ্রলোক আসলে কোনটাতে জিতলো, রিক্সাওয়ালাকে পাঁচ টাকা কম দিয়ে নাকি দুশো টাকার সিগারেটে?
এরকমই বেশ কিছু ছোটো খাটো আর অতি সাধারণ ঘটনা ওর মাথার মধ্যে নাচানাচি করছে। কুহক ভাবছে ঘটনাগুলোর একটা গন্তব্য থাকা দরকার। কি সেই গন্তব্য? প্রশ্নটা মাথায় নিয়েই আরো দুই রাউন্ড পায়চারি করলো সে। তারপর হঠাৎ করে ছুটে গেল তার প্রিয় ডায়েরীটার কাছে। স্থির করলো আজ রাতে একটা গল্প লিখবে সে। আর তার গল্পের নাম হবে “যে গল্পে ভালোবাসা নেই” ।
~আসিফুল হক
(19/02/2021)
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....